আজ প্রায় তিন বছর হতে চললো, রুদমিলার থেকে আমি দূরে, দূর প্রবাসে। রুদমিলাকে ছেড়ে এসে আমি খুব ভালো নেই। বউ এর অঢেল অর্থে বিলাস বহুল জীবন যাপনের অভ্যস্থতা আমাকে যে কি পরিমান পঙ্গু করে তুলেছিলো তার পরিনাম বেশ ভালোই ভোগ করতে হয়েছে আমাকে এই ক'বছরে। এ তিন বছরে নানা ঘাটে ধাক্কা খেতে খেতে শেষ পর্যন্ত আমি তরী ভিড়িয়েছি দুবাই শহরের ছোট্ট একটি বারে। এই জবটাও পাওয়া গেছে একজন সহৃদয় বন্ধুর সহায়তায়। আমার শিক্ষাগত যোগ্যতা যা আছে তাতে এর চাইতে বহুগুণ ভালো চাকুরী যোগাড় করাটা আমার জন্য আসলে তেমন কষ্টকর ছিলো না। কিন্তু ইচ্ছেটাই মরে গেছে। আসলে মরে গেছে মনটা। নতুন উদ্যম, প্রতিযোগীতা বা যে কোনো কিছুতে এগিয়ে থাকবার সদিচ্ছাটা ছেড়ে গেছে আমাকে রুদমিলার আমাকে ছেড়ে যাবার সাথে সাথে।
সারাদিন ঝিম মেরে বসে বসে ক্যাশবাক্স পাহারা দেই। মাতালদের মাতলামী দেখি। মদ খেয়ে কেউ হয় রাজা উজির কেউ বা জীবনের সব অপ্রাপ্তির স্মৃতি রোমন্থনে গলা ছেড়ে হাউ মাউ কাঁদে। এই বারে যা কিছু পাই তা দিয়ে আমার একটা পেট বেশ চলে যায়। এখানের সবচেয়ে বড় যে ব্যাপারটা তা হলো ইচ্ছেমত মদ খাওয়া যায়। আমি প্রানপন ভাবতে চেষ্টা করি আমি ভালো আছি, সুখে আছি। মাঝে মাঝে রুদমিলার কথা ভেবে আমার খারাপ লাগে। কি অন্যায়টাই না করেছি আমি তার সাথে। অকথ্য সব ব্লেমিং, অকারণ সন্দেহ। আমার যাচ্ছেতাই দূর্ব্যাবহার মুখ বুজে সহ্য করেছে মেয়েটা। চরম উপেক্ষা ও একই সাথে সহ্যের এক আশ্চর্য্য আঁধার এই মানবী। রুদমিলার কাছে ক্ষমা চাইতে ইচ্ছে করে আমার। যদি পারতাম ওর পা দুটো ধরে ক্ষমা চেয়ে নিতাম একটাবার।
দেশে ছাপা হওয়া যে সব পত্রিকা বিশেষ করে রুদমিলার খবরাখবর আর ছবি ছাপানো পত্রিকাগুলি যতটা সম্ভব পাওয়া যায় কিনে কিনে জমিয়ে রাখি আমি। তাকিয়ে থাকি ওর নানা ভঙ্গিমার হাসিখুশীমুখী ছবির দিকে। ওর ঘাড় কাৎ করে তাকানোর ভঙ্গিমা কিংবা হাসলে গালে টোল পড়ার তিল তিল সৌন্দর্য্যগুলি মনে পড়ে আমার। আমি ওর মেইলগুলি খুলে তন্ন তন্ন করে খুঁজি ওর সব খবরাখবর। কোথায় কি করছে সব তথ্যাদি। ওর ফেসবুকের ওয়ালে ভক্তদের শুভেচ্ছা, ওর ফ্যান পেইজগুলোতে নানা বয়সী মানুষের প্রেম নিবেদন সব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ি আমি। আমার এখন সেই আগের জেলাসীটা কাজ করেনা। আগে কোনো ক্ষুদে ভক্তও তাকে ভালোবাসা জানালে আমার মাথায় খুন চেপে যেত। কেউ ফ্লার্ট করার চেষ্টা করলে তাকে পঙ্গু করে দিতে মন চাইত।কিন্তু এখন সেসব ইচ্ছে চলে গিয়ে একরকম কৌতুক অনুভব করি।
রুদমিলার ইনবক্সগুলি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ি এমনকি আদার বক্সের মেসেজগুলোও। কি এক অদ্ভুত কারণে রুদমিলা তার মেইল, ফেসবুক , টুইটার বা সব রকম পাসওয়ার্ডগুলো ওর সাথে বিচ্ছেদের পরেও কেনো যেন কোনোটাই চেঞ্জ করে দেয়নি। এই কারণে আমি রুদমিলার প্রতি কৃতজ্ঞতা বোধ করি।কারণ আমি জানতে পারি সে ঠিক কি অবস্থায় কাটাচ্ছে বর্তমান সময়টা।ওর বোন বা সহকর্মী কারো সাথেই কোনো কনভারসেশনে রুদমিলাকে কখনও আমার নামে একটা কটু বা মিঠা কোনো কথাও বলতে দেখিনা। ওর আত্মীয় স্বজন বন্ধু বান্ধবেরাও কখনও ওর কাছে ভুলেও জানতে চায়না আমার কথা বা আমাদের বিচ্ছেদের কথা। কি সুনিপুন ভাবে রুদমিলা মুছে ফেলেছে আমাকে তার জীবন থেকে। অবাক হয়ে দেখি। হাসছে, মজা করছে, ঘুরছে, এখানে সেখানে খেতে যাচ্ছে। ফেসবুকে প্রতিদিনের ওর সব ছবি আর স্ট্যাটাস আপডেট দেখাই আমার একমাত্র অনিবার্য্য কাজ হয়ে পড়ে।
বেশ কিছুদিন যাবৎ রাত ১১টা বাজলে রুদমিলার ইনবক্স চ্যাটে একজন রোমিও দেখা যাচ্ছে। বেটা তার নানারকম হিরোগিরি দিয়ে রুদমিকে পটাতে চেষ্টা করছে। নিজেকে সে বিশ্বহনু প্রমানের চেষ্টায় সদা ব্যাস্ত। সাথে চলছে রুদমিলার রুপ ও গুণের ভূয়সী প্রশংসা। আমার একটু আধটু মেজাজ খারাপ হয় কিন্তু আগের সেই তীব্র খুন চাপা ভাবটা নেই আর। আসলে আমিও চাই জীবনে সুখী হোক মেয়েটা। অনেক দুঃখ পেয়েছে সে আমাকে ভালোবেসে। ওর একজন সত্যিকারের প্রেমিক দরকার। যার কাছে থাকবে তার আস্থা, প্রয়োজন ও সর্বপোরি সন্মান। আমি এসবের কোনোটাই দিতে পারিনি তাকে। আমার অপ্রয়োজনীয় ভালোবাসা বা উপস্থিতি আসলে রুদমিলার জীবনে একটা গলদকাল। ডার্কটাইমের মাঝে দিয়ে গেছে রুদমিলা সেই কটা বছর। আমি না থাকলে ওর আরও ভালো কিছু হত। উন্নতি হত আরও হয়তো।
রুদমিলা এখন বেশ আছে। বেশ তরতর করে উন্নতির শিখরে উঠছে সে। এই তিন বছরে আমার ধারণা সর্বোচ্চ খ্যাতির শিখরে পৌছেচে সে। আমি থাকলে এমনটা হতনা। আমি ছিলাম ওর জীবনের প্রতিবন্ধক। ওর অসাধারণ মেধা চর্চার বাঁধা। শিল্পকলা বা বিজ্ঞান চর্চা যে কোনো কিছুতেই মন লাগিয়ে কাজ করাটাই উন্নতির প্রথম শর্ত। রুদমিলা রোজ মন খারাপ করে থাকতো। মন দিয়ে তখন সে অভিনয় করতে পারতোনা। আমি ছিলাম তার মন খারাপের কারণ। আমি ছিলাম তার প্রতিবন্ধকতা। ওর জীবনের অনেকগুলো বছর নষ্ট করে দেবার পরে এই উপলদ্ধি হয়েছে আমার। এখন সে মুক্ত বিহঙ্গের মত তার জীবনটা নিয়ে ভাবতে পারবে। মন দিয়ে উপহার দিতে পারবে দারুন কিছু ওর ভক্তকুলের জন্য, সমাজের জন্য, দেশের জন্যও। রুদমিলা ভালো থাকুক । আনন্দে থাকুক। দূর থেকে চেয়ে চেয়ে দেখবো আমি। এই আমার চাওয়া।
এই রোমিয়ের সাথে প্রায় রোজ রাতেই দারুন কিছু সময় কাটাচ্ছে আজকাল রুদমিলা। রোমিও একটু পাগলা টাইপ। জনি ব্রেভো স্টাইলে মেয়েদেরকে পটাবার চেষ্টা করে।একটু ইমম্যাচিউরড। রুদমিলা মজা পাচ্ছে। সে বেশ আনন্দ নিয়ে বা কৌতুক নিয়ে কথা বলে ছেলেটার সাথে। আমি চুপচাপ দেখি। রুদমিলা কি কখনও আঁচ করেছে আমি যে ওর পাসওয়ার্ড দিয়ে ওর ফেসবুকের ইনবক্স দেখছি। রুদমিলার তো ভুলে যাবার কথা না যে আমাকে ওর পাসওয়ার্ড সেই দিয়েছিলো। রুদমিলা তার প্রাত্যহিক, দৈনন্দিন জীবনের নানা কর্মকান্ড শেয়ার করে ওই রোমিওর সাথে। আনন্দ, বেদনা বা পরিশ্রম, সাফল্যের গল্প শুনায়। কিন্তু ছেলেটা সব সময় তাকে প্রেমে ফেলানোর চেষ্টা করে চলে। রুদমিলা বুঝতে পারে কিনা জানিনা। পাক্কা অভিনেত্রীদের কোনটা অভিনয় আর কোনটা রিয়েল বোঝা কষ্টকর। এতগুলো বছর এক ছাদের নীচে কাটিয়েও আমি তা কখনও বুঝিনি। কিন্তু কিছু অভিনয় শিখেছি। তবে আমি মন থেকেই চাই। রুদমিলা কারুর ভালোবাসা পাক। সংসার পাক। একটি নারীর জীবনে সংসার, সন্তান বা ভালোবাসা যা কিছু জরুরী তার কিছুই আমি দিতে পারিনি তাকে।
রুদমিলা যদি এই ছেলেকে ভালোবেসে ঘর বাঁধে, সুখী হয় আমি হব সেদিন এই পৃথিবীর সবচাইতে সুখী মানুষ। আমার পাপের ভারা হয়তোবা কিছুটা ভার মুক্ত হবে কিন্তু এই রোমিও এর মাঝে কিছু গলদ আছে মনে হচ্ছে। সে দুদিনের মাঝেই প্রেম প্রস্তাব দিয়ে বসেছে। রুদমিলা অস্বীকৃতি জানাতেই সে রুদমিলার সাথে দূর্ব্যাবহার করে বসলো। চরম দূর্ব্যাবহার। ঝম করে রক্ত চড়ে গেলো আমার মাথায়। বহু কষ্টে মাথা ঠান্ডা রাখছি। নিজেকে সংযত রাখার চেষ্টা করছি। না রুদমিলার জীবনে আর কোনো কষ্ট দায়ক উৎপীড়ক আমি চাইনা। আমি আমার রুদমিলাকে সুখী দেখতে চাই। নিজের জীবনের বিনিময়ে হলেও রুদমিলাকে সুখী দেখে যেতে চাই আমি। ওর জীবন হতেই হবে সকল কলুষতাবিহীন নিষ্কন্টক....
কি করবো আমি?
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই অক্টোবর, ২০১৫ দুপুর ২:২৫