মিনিট বিশেক পরে মৃদু কেঁপে উঠলো রুদমিলা। চোখ মেললো। একটি ঘুমন্ত প্রজাপতি যেন সদ্য ঘুম ভেঙ্গে পাখা মেলে উড়ে বসলো ওর গাঢ় অক্ষি পল্লব জুড়ে। ওর স্তনাগ্র থেকে মুখ তুললাম আমি। নিবিড় আলিঙ্গনে আবদ্ধ করলাম ধীরে ধীরে ওর নগ্ন শরীর। পাকা শিকারীর মত আমার ব্যাধে খুব সন্তর্পনে আটকালাম ওকে। ফের ঠোঁট ডুবিয়ে দিলাম ওর স্বেদসিক্ত কাঁপা ওষ্ঠে। বাঁধা দিলো না রুদমিলা।
সে এখন বড্ড ক্লান্ত। পরিশ্রান্ত হিংস্র বাঘিনী । বার বার হেরেছে সে আমার ভালোবাসার কাছে। ওর নিষ্ঠুর নিয়তির মুক্তি নেই। আমার ভালোবাসার বাঁধন শুধু শক্তই না বড়ই সুকৌশলে সুগঠিত। এই ১১ বছরে ১১ শতবার চলে গেছে রুদমিলা আমাকে ছেড়ে। আবার তাকে ফিরতে হয়েছে অদৃশ্য সুতোর টানে। আমি বার বার ভাবি, আমার ভাবতে ইচ্ছে করে রুদমিলা আমাকে বড় ভালোবাসে তাই সে ফিরে এসেছে বার বার কিন্তু মাথায় রক্ত চড়ে যায়, যখনই পত্রিকায় ওকে নিয়ে রমরমা নিউজ দেখি। ছবি দেখি ওর অন্য যুবকের সাথে। অকারণ আক্রোশ জাগে আমার।
এ কথা আমি জানিয়েছিও ওকে। বড় বড় চোখ দুটো মেলে আমার দিকে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থেকেছে সে।যেন এমন অবাক করা কথা সে জীবনে শোনেনি বা আমি কোনো মূর্খ উন্মাদ। কোনো প্রতিবাদ করেনি রুদমিলা। ওর এই ব্যাপারটা আমাকে আরও বেশি ক্রোধন্মাদ করে তোলে।ও যদি চিৎকার করতো। আত্মপক্ষ সমর্থন করতো কিংবা সাফাই গাইতো বা গালাগালি করতো তবুও আমার এত আক্রোশ জন্মাতো না। আমি পাগল হয়ে যাই যখন সে আমার হিংসা, ক্ষেদ বা উন্মত্ততা দেখে প্রথমে বিস্মিত হয় ও পরে পরম তাচ্ছিল্যভরে উপেক্ষা করে। আমাকে জবাবদিহি বা নিজেকে নির্দোষ প্রমানের বিন্দুমাত্র চেষ্টা করেনা। ওর এই উপেক্ষা আমি সইতে পারিনা।
রুদমিলা প্রচন্ড আত্মাভিমানী মেয়ে। বিয়ের পর প্রথম যেদিন আমি মাতাল হয়ে বাড়ি ফিরে ওকে অকথ্য গালাগাল করেছিলাম । মনের আঁশ মিটিয়ে আমি যাচ্ছেতাই ভাষায় মনের অক্ষম ক্ষেদ ঝেড়েছিলাম। যদিও আমি অপ্রকৃতিস্থ ছিলাম কিন্তু আমি জানি সেদিন থেকেই রুদমিলা আমাকে ত্যাগ করেছে। ওর মনে মনে করা এই ত্যাগ আমি টের পাই। চেতনা ফিরে আসবার পরে আমি নিজের কাছে নিজে লজ্জায় কুকড়ে গেছি। ছোট হয়ে থেকেছি। বার বার ক্ষমা চেয়েছি রুদমিলার কাছে। প্রচন্ড অভিমানে চুপ করে থেকেছে সে। ওর কাছে যখন আমি বার বার জানতে চেয়েছিলাম ক্ষমা করেছে কিনা সে আমাকে । সে অনেক কষ্ট করে জবাব দিয়েছিলো করেছে। আসলে সে আমাকে মন থেকে কখনও ক্ষমা করতে পারেনি।
আমি তো জেনে শুনেই ওকে বিয়ে করেছিলাম। রুদমিলা একজন সেলিব্রেটি।এই শহরের প্রতিটা মানুষ চেনে ওকে। সে তো আজ থেকে নয় অভিনয় তো করছে সে আমাদের পরিচয়ের শুরু থেকেই। ওর নাটক দেখতে গিয়েই তো ওর সাথে পরিচয়। ওর টাকায় খাচ্ছি দাচ্ছি ঘুরছি তবুও কেনো আমি ওর পেশা নিয়ে সদা ও সর্বদা ওকে যাচ্ছেতাই বলি? কেনো আমি রুদমিলার পাশে কোনো মানুষকে সহ্য করতে পারি না? রুদমিলা ঘুমুচ্ছে। সম্ভভত অপরিসীম ক্রোধ, ক্ষোভ আর অভিমানের পরে আমার উন্মত্ত শরীরের ভালোবাসা অন্যান্য বারের মতন এবারেও ভুলিয়ে দিয়েছে আমার ওপরে ওর সুতীব্র অভিমানটুকু।
কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে, ভোরবেলা ঘুম ঘুম চোখে দেখলাম, রুদমিলা ব্যাগ গোছাচ্ছে। আমার ঘুম ছুটে গেলো। তবুও ঘুম ভাব করে আড়চোখে ওকে দেখে নিয়ে মনে মনে ফন্দী আটতে লাগলাম কি করে ওকে আটকানো যায়। আবার ভাবলাম যাক না আবার তো ফিরে আসবে। আমাকে ছেড়ে সে কি থাকতে পারবে? কখনও না .....
রুদমিলা চলে গেলো....
একদিন, দুদিন, তিনদিন, সপ্তাহ গড়িয়ে মাস পেরুলো। এবারে রুদমিলা ফিরলোনা। ফোন বন্ধ। অফিসে ফোন করলে কেউ ডেকে দিলো না। আমি নিজে যেচে ওর বাড়ি বা অফিসে হানা দিতে পারতাম। তবে একটু আত্মসন্মানে লাগলো। এত ভালোবাসা যে পায়ে দলে যেতে পারে থাক না সে তার মতই .....
মনে মনে অপেক্ষা করে যেতে থাকলাম। রুদমিলা ফিরবে। কিন্তু ফিরলোনা রুদমিলা। রুদমিলার রেখে যাওয়া টাকা পয়সা যা ছিলো সব তলানিতে এসে ঠেকলো। রুদমিলা ডিভোর্স লেটার পাঠালো। বাড়িটা ওর নামে। আমি ডিভোর্স লেটার সাইন করে আপোসে ওকে মুক্তি দিয়ে দিলাম।
একদিন রাতে বাড়ির মেইন গেইটে তালা লাগিয়ে চাবিটা পাশের বাড়ির ভাবীকে দিয়ে বলে এলাম। যদি রুদমিলা আসে তাকে চাবিটা দিয়ে দিতে। আমি কপর্দকশূন্য হাতে সেই রাতে চলে এলাম রমনা পার্কের গেটে। পার্কের বেঞ্চিতে শুয়ে পড়লাম। নিস্বের মত। নিস্বের নিস্বতার একটা আনন্দ আছে। মুক্তির আনন্দ। পিছুটানহীন। বন্ধনহীন। আমার চিৎকার করে গান গাইতে ইচ্ছা হচ্ছিলো।
আমি বন্ধনহীন, জন্মস্বাধীন, চিত্ত মুক্ত শতদল.......
রাতপরীরা উঁকি ঝুকি দিচ্ছিলো। কিন্তু কেন যেন তারা বুঝে গেলো আমি নিস্ব। আমি অসহায়। তাই আর বিরক্ত করলোনা। এরপর আমি পার্কের বেঞ্চিতে শুয়ে অঘোরে ঘুমিয়ে পড়লাম।
তারপর .....
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই অক্টোবর, ২০১৫ রাত ১১:৩২