: তোমার সঙ্গে আমি সেপারেশন চাচ্ছি মানে ডিভোর্স।
আজ রাতে ডিনারের পরে আমি যখন টিভিতে নিউজ দেখছিলাম, দু মাগ কফি হাতে নিয়ে এসে সামনের সোফাটিতে বসলো রুদমিলা এবং খুব নির্লিপ্ত ও শান্ত ভঙ্গিতে কথাগুলো বললো। নিজের কফিতে চুমুক দিয়ে অন্য কফি মাগটি ইষৎ ঠেলে দিলো আমার দিকে। আমি সেদিকে তাকিয়ে রইলাম। নির্লিপ্ততার অভিনয় করতে চাইলাম। আজ তিন তিনটা বছর একজন মঞ্চ কাঁপানো পাক্কা অভিনেত্রীর সাথে বসবাস করে এতটুকু অভিনয় না শিখলে কি আমার চলে?
আমি ওর দিকে তাকালাম। গাঢ় নীল রঙের সাদা লেস লাগানো অদ্বুৎ টাইপের একটা লং ড্রেস পরেছে রুদমিলা।দীর্ঘ চুলগুলো ছড়িয়ে আছে সাদা বকপাখির মত ওর দু বাহুর দু কুনুই এর প্রান্ত জুড়ে। ফ্যানের বাতাসে কফিমাগ ধরা হাতের উপরে উপচে পড়া চুলগুলো তিরতির করে কাঁপছে। মনে হয় সবেমাত্র গোসল সেরে হেয়ার ড্রায়ারে চুল শুকিয়ে এসেছে। সবকিছু ভুলে আমার ভেতরে একটি কথাই জেগে উঠলো- রুদমিলা তুমি এত সুন্দর! সেই ইউনিভার্সিটিতে দেখা প্রথম দিনটিতে লাভ এ্যাট ফার্স্ট সাইটের মত সুন্দর তুমি। তুমি রোজ রোজ নতুন ভোরে নতুন করে জেগে ওঠো। আমি বার বার তোমার প্রেমে পড়ি। মনে মনে এসব প্রেমবাণী উথলে উঠলেও এসব বলার সময় যে এখন নয় সে আমি বেশ জানি। এই অপূর্ব কমনীয় মায়াবতী চেহারার মেয়েটির ভেতরটা বড় নিষ্ঠুর। আমার এসব কোনো রকম প্রেমাবেগের মূল্য দেবেনা সে এখন। এই ৮ বছর চেনাজানা এবং ৩ বছরের সংসারে সে আমি বেশ ভালোই জেনেছি। এই ভুল সময়ে অতি সত্য কথাগুলো মনের মাঝারে উগরে ওঠায় আমার নিজের উপর বেশ রাগ হলো। তবুও সেই প্রেম, রাগ, মুগ্ধতা এবং এক গাদা কষ্ট ঢোক গিলে ফেলে আমি জিজ্ঞাসু চোখে ওর দিকে তাকালাম। জানতে চাইলাম-
: কেনো?
রুদমিলা অবাক হলো না। আমি জানি ওর জায়গায় অন্য কোনো মেয়ে হলে এই মুহুর্তে তীব্র ক্ষোভে ফেঁটে পড়তো। হয়তো আঁচড়ে কামড়ে শেষ করে ফেলতো। কিন্তু রুদমিলা সেসব কিছুই করলো না। সে পাক্কা অভিনেত্রী। আমার সহস্র কোটি অত্যাচার, অমানুষিক নির্যাতন সে মুখ বুজে সহ্য করেছে এতদিন। আমি জানি আমি দোষী। এই প্রেম ও সংসার মিলিয়ে ১১ বছরের জানাশোনা ও একসাথে বসবাসকালীন সময়ে আমাদের ভেতরে যত সংঘাত, দ্বন্দ, মনোমালিন্য হয়েছে সব কিছুর জন্য আমি দায়ী। আমি জানি, আমি অমানুষ। মনুষ্য সমাজে আমার জায়গা নেই। আমি খ্যাতনামা স্ত্রীর টাকায় বাড়ি, গাড়ি ও বিলাসবহুল জীবনযাপনরত একজন অযোগ্য স্বামী। কিন্তু কি করবো? আমি রুদমিলাকে ভালোবাসি। ওর ব্যাপারে আমি দারুন অসহিষ্ণু, দারুন ক্ষেপাটে, একজন বদ্ধ উন্মাদ।
কন্ঠে আরও বেশি নির্লিপ্ততা ফুটিয়ে রুদমিলা জবাব দিলো। নিষ্ঠুর জবাব-
: তোমাকে আমি সহ্য করতে পারছি না।
আমি শেষবার চেষ্টা করলাম। অব্যার্থ বিশ্বাসযোগ্য অভিনয়ের চেষ্টা। আমার মঞ্চ কাঁপানো পাক্কা অভিনেত্রী বউ এর থেকেও গলায় বেশি দীনতা ফুটিয়ে বললাম-
: আমি তোমাকে ভালোবাসি রুদমিলা।
রুদমিলার চোখ ঝলসে উঠলো এবার। দুচোখের ঝকঝকে দুটি হীরকখন্ডে দ্যুতি চমকালো। এক ঝলক ঘৃনার আগুনে ভস্মীভুত হলাম আমি। আমার কষ্ট হচ্ছে। ওর চোখে ঘৃনা। এক রাশ ঘৃনা। এ ঘৃনা আমার জন্য। ঢাকতে পারলোনা রুদমিলা। ওর অসাধারণ অভিনয় ক্ষমতা দিয়েও ঢাকতে পারলোনা ওর ঘৃনাটুকু যা তিলতিল করে অনেক দিন হলো আমার জন্য সঞ্চয় করেছে সে। হিস হিস করে উঠলো ও-
: তোমার মত অমানুষ, জানোয়ার,বদ্ধ উন্মাদের ভালোবাসা, আমার দরকার নেই।
আমি নার্ভ শান্ত রাখার চেষ্টা করলাম। গম্ভীর কঠোর গলায় বললাম-
: তোমার দরকার না থাকতে পারে কিন্তু আমার দরকার আছে। তোমার ভালোবাসা আমার দরকার আছে রুদমিলা। তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচবোনা।
রুদমিলা জ্ঞান হারালো। রাগে কাঁপছিলো ও । ওর ভক্তরা কেউই জানেনা ওর একটি মারাত্মক কঠিন রোগ আছে।কিছুটা হিস্ট্রেরিয়া টাইপ। খুব বেশি উত্তেজিত হলে সে জ্ঞান হারায়। কিছুক্ষন পরে আপনা আপনি জ্ঞান ফেরে ওর। সে ওর এই অসুখটার জন্য আমাকেই দায়ী করে। তবে এই অদ্ভুৎ টাইপর অসুখের অদ্ভুৎ রকম ট্রিটমেন্ট আমি জানি। বলতে গেলে যা আমি নিজেই আবিষ্কার করেছি।
আমি ওকে পাঁজাকোলা করে তুলে নিয়ে এসে বেডে শুইয়ে দিলাম। এসি অন করে, বেডরুমের সব লাইট অফ করে জিরো পাওয়ারের নীল বাল্বটা জ্বালিয়ে এসে বসলাম ওর পাশে। ফুটফুটে একটি নীল অপরাজিতার মত ঘুমিয়ে আছে ও। যেন এক ঘুমন্ত রাজকন্যা।
আমি ওর গোলাপী পেলব ঠোঁটে ঠোঁট ডুবালাম। প্রগাঢ় চুম্বনে শুষে নিতে চাইলাম ওর ভেতরে জমে থাকা সব ক্ষোভ, ক্রোধ, দুঃখ, বেদনা আর আমার প্রতি তিল তিল করে জমে ওঠা সব ঘৃনাটুকু.....
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই অক্টোবর, ২০১৫ দুপুর ২:২৭