"পরের মুখে ঝাল খাওয়া"
অনুবাদের ব্যপারে এমন একটা কথা পাঠক মহলে চালু আছে। বাংলা অনুবাদ সাহিত্যের নিরিখে কথা ফেলে দেয়ার মত নয়।
হেরমান হেসে-র সিদ্ধার্থ পড়েছিলাম বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের অনুবাদে। জার্মান ভাষায় এর আগেই বইটি বার দু'এক পড়া ছিল। ছবিটিও পাঁচ বারের মত দেখেছি, জার্মান ভাষাতেই। তাই এর বাংলা অনুবাদটা আগ্রহ নেয়েই পড়তে থাকি। পড়ি আর মর্মাতহ হই। এমন নাম করা একটা প্রতিষ্ঠান হেরামার হেসে-র লেখার একী হাল করেছে! হয়তো এমন আরো অনুবাদ আছে, আমি কেবল একটার কথাই জানি!
আমার প্রিয় মানুষটি খুব পড়তে পছন্দ করে। ফোনে অনেক বই নিয়ে কথা হয়। এপার বাংলা ওপার বাংলার অনেক খ্যাতিমান লেখকদের লেখা নিয়ে কথা হয়। আমি গল্প শুনে চুপ করে থাকি। প্রিয়তমার ঝাড়ি খেয়ে দু'একটা বইয়ের কথা বলি। কিন্তু বাংলায় সে সব বইয়ের অনুবাদের মান সম্পর্কেও সাবধান করতে থাকি।
সে বলে "এত পন্ডিতি দেখাচ্ছো যখন, তাহলে নিজেই একটা অনুবাদ করো না কেন!" কথা ঠিক। পরের দোষ ধরা খুব সহজ কাজ। তার অনুপ্রেরনা আর আগ্রহে দ্যা লিটল প্রিন্স-এর অনুবাদ শুরু করি। কাজের ফাঁকে যে সময়টুকু পাই "খোকা বাবু" (আমার বিবেচনায় দ্যা লিটল প্রিন্স-এর বাংলা অনুবাদ) অনুবাদ করতে থাকি। হাতের লেখা অনুবাদটুকু কম্পিউটারে টাইপ করি, একে ওকে ধরে বিভিন্ন পরামর্শ চাই। অনেকে বলল একটা বাংলা অনুবাদ দেখে নিতে পারেন। কিন্তু আমি কাজটি করছি প্রিয়তমার জন্য। সে কাজ আমাকেই করতে হবে। তা ছাড়া করো অনুবাদ দেখে প্রভাবিতও হতে চাই না।
অনুবাদটার একটা প্রিন্ট আউট প্রিয়তমার হাতে দিয়ে বললাম; বই ছাপিয়ে দিতে পারলাম না, সরি।
সেটা পেয়েই তিনি খুব খুশী। আনন্দের আতিশয্যে যোগাযোগ শুরু করলো বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের সাথে। অনেক চেষ্টার পর কর্তাব্যাক্তিদের একজনকে পাওয়া গেল। প্রয়োজনে আর্থিক দায়িত্ব নেয়ার সংকল্প নিয়েও কোন লাভ হল না। কর্তাব্যক্তি বললেন; রূপকথা আমরা প্রকাশ করি না। তাছাড়া বইটি অন্য প্রতিষ্ঠান বের করেছে।
এবার খুব আগ্রহ হল, দেখি অন্য অনুবাদগুলো কেমন হল!
খোঁজ নিয়ে আজিজে গিয়ে পেলাম ছোট্ট এক রাজকুমার। অনুবাদক রতন বাঙালী, প্রকাশনায় জাগৃতি প্রকাশনী।
একটু ইর্ষা নিয়েই বইটির পাতা উল্টাতে শুরু করলাম। যতই পাতা উল্টাই ততই মন খারাপ হতে থাকে, একটা উদাহরণ দিলে ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়;
"কিন্তু আমার ভয় জোরালো হাওয়ার। তুমি কি আমার চার পাশে আচ্ছাদনের ব্যবস্থা করছ না?
খরার অতঙ্ক ফুলের জন্য দুর্ভাগ্যজনক।- রাজকুমার মন্তব্য করল। এই ফুলটি একটা নাজুক সৃষ্টি বটে...!
ফুলটি জোরালো হাওয়ার ভয়ে আচ্ছাদন চাইছে, সেখানে রাজকুমারের মন্তব্যে খরার আতঙ্ক ফুলটির জন্য দুর্ভাগ্যজনক কেন হবে! যে কোন উদ্ভিদের জন্যেই খরা একটি ভয়ঙ্কর ব্যপার। আসলে ফুলটি খরার আশংকা করেনি, করেছে জোরালো/ঝড়ো হাওয়ার।
এভাবে অনেক অসঙ্গতির আর একটা নমুনা নবম অধ্যায়ে
"মূলবই-এর প্রথম কভারের ভেতরের চিত্র-পাখির সাহায্যে উড়ে যাওয়ার ছবিটি।"
এই বাক্যটি এখানে কম্পোজারের উদ্দেশ্যে অনুবাদকের উক্তি। এখানে কোন ছবিই যুক্ত হয়নি। ছবিটি আছে অন্য জায়গায় যেখানে থাকার কথা নয়। এভাবে এক জায়গার ছবি অন্য জায়গায় ছাপা হয়েছে। ছবি, বাক্যগঠন, শব্দচয়ন সব কিছু খুব অবহেলায় অযত্নে করা হয়েছে।
মাথা নীচু করে আজিজ ছেড়ে ধীরে ধীরে হাঁটতে লাগলাম বাংলা একাডেমীর দিকে। সেখান থেকে কবি আসাদ চৌধুরীর অনুবাদ "ছোট্ট রাজপুত্র" সংগ্রহ করলাম। জ্ঞ্যান পাপী কথাটা কেন চালু হল তার কারন বুঝতে পারলাম ছোট্ট রাজপুত্রের সতেরো অধ্যায়ে এসে।
ছোট্ট রাজপুত্র: "তুমি মোটেই প্রবল শক্তির অধিকারী নও, তোমার পা পর্যন্ত নেই, তুমি কোথাও যেতেও পারনা...।"
সাপ বলল, "একটা ভেড়ার পিঠে চেপে তুমি যতদূর যাবে তার চেয়ে একটু বেশী দূরেই আমি তোমাকে নিয়ে যেতে পারি।"
ছোট্ট রাজপুত্র-কে তিনি গাধার পিঠে নয় ভেড়ার পিঠে চড়িয়ে সম্মান করলেন! মূল বইতে ভেড়া বা গাধার কোন কথাই আসেনি। সাপ বলেছে একটা দ্রুতগামী "জাহাজ" তোমাকে যতদূর নিয়ে যেতে না পারবে, আমি তোমাকে তার চেয়ে বেশীদূর পৌঁছে দিতে পারব।
তবুও পাঠক এদেরটাই কিনবে। আমার অনুবাদ অজ্ঞাত কুলশীল হয়ে ধুলোর আচ্ছাদনে ঢাকা পরবে। পাঠক কেন এসব বই পড়ে আপ্লুত হয় না, সেটা মর্মে মর্মে টের পাচ্ছি। অনুবাদের এমন হাল দেখেই হয়তো পাঠক বুঝতে পারেন না, কেন একজন লেখকের ছবি সে দেশের টাকায় ছাপা হয়! পরের মুখে ঝাল খাওয়া, কথার সার্থকতা খুঁজে পেলাম!
লেখক পরিচিতি:
অনটোয়ান্ দ্যে সা এক্সউপেরী উনিশ সালের ২৯ জুন ফ্রান্সের লিয়নে জন্ম গ্রহন করেন। পাঁচ ভাই-বোনের মধ্যে তৃতীয় সা-এক্সউপেরী চার বছর বয়সে পিতাকে হারান। উনিশ নয় সালে মাত্র ন'বছর বয়সে ছোট ভাইকে সাথে নিয়ে এতিমখানায় ভর্তি হন। উনিশশো বারো সালে প্রথম বিমান যাত্রা। ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষার পর নেভাল অফিসার হওয়ার স্বপ্ন দেখেন। প্রস্তুতির জন্য একটা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হয়েও পাস করতে ব্যার্থ হন। এ ব্যার্থতার সাথে যোগ হয় ছোট ভাইটির অকাল মৃত্যূর আঘাত। কয়েক বছর স্থাপত্যবিদ্যায় পড়াশুনা করেও শেষ করতে পারেননি। বাধ্যতামূলক সেনা প্রশিক্ষনের অংশ হিসাবে বিমানবাহিনীতে যোগ দেন। প্রথমে প্রকৌশলী ও পরে পাইলটে উন্নীত করেন নিজেকে।
রচনা সমগ্র:
দ্যা পাইলট -১৯২৬
সাউথ কুরিয়ার -১৯২৮
নাইট ফ্লাইট -১৯৩১
উইন্ড, সেন্ড এন্ড স্টার -১৯৩৯
লেটার অব ফ্রেন্ডশীপ -১৯৪১
ফ্লাই টু আরাস -১৯৪২
দ্যা লিটল প্রিন্স -১৯৪৩ সর্বশেষ সম্পূর্ণ রচনা
সিটি অব ডেজারট্ -অসমাপ্ত।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ দিকে ১৯৪৪ সালের ৩১ জুলাই "স্যাঁ-এক্সউপেরী" শেষ বারের মত পাইলটের আসনে বসেন। এ যাত্রা থেকে তিনি আর ফিরে আসেননি।
উনিশ'শ আটানববই সালে মাছ ধরতে গিয়ে জন-ক্লাউডে বিয়াঙ্কো নামের এক জেলে "সা এক্সউপেরী" নামাঙ্কিত হাতের ব্রেসলেটটি খুঁজে পান। জেলের কথামত ২০০৩ সালে "সা এক্সউপেরীর" বিমানটি উদ্ধার করে ২০০৪ সালে বিমান যাদুঘরে রাখা হয়।
ফরাসী জাতি ১৯৭৫ সালে আষ্টেরোইড নম্বর ২৫৭৮ কে "সা-এক্সউপেরী" এবং ২০০০ সালে লিয়ন বিমান বন্দরকে "সা এক্সউপেরী" নাম দিয়ে এই লেখককে অমর করে রাখে। অধুনালুপ্ত ফরাসী ৫০ ফ্রাঙ্কের নোটের একদিকে সা এক্সোপেরীর ছবি অন্যপিঠে তার বিমানের ছবি ছাপ ছিল।
খোকা বাবু তাঁর সর্বশেষ পূর্ণাঙ্গ রচনা। বইটি এ যাবৎ ১৪০টি ভাষায় অনুদিত হয়েছে। এর মধ্যে জার্মান ভাষায় শততম অনুবাদটি বের হল দিন কয়েক আগে। আমার জানা মতে বাংলায় বইটির চারটি অনুবদ আছে। আমি বইটি জার্মান ভাষা থেকে অনুবাদ করেছি।
বই নিয়ে কিছু বলতে যাব না। শুধু এটুকু বলতে চাই; কল্প-বাস্তব আর বাস্তবের বুনন কেমন হতে পারে তা তিনি এই বইয়ে দেখিয়েছেন।
বইটি অনুবাদের সময় অনেকেই আমাকে বিভিন্ন ভাবে উৎসাহিত করেছেন। তাদের সকলের কাছে আমি কৃতজ্ঞ।
বইটা পড়তে
Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে অক্টোবর, ২০০৮ বিকাল ৪:৩৩