সকালে নাস্তা দিতে এসে কয়েদীটা খুব মায়াভরা চোখে তাকাল। যত খারাপ লোকই হোক মৃত্যুর পর সবাই তাকে ভাল বলে! আমার অবস্থাটা অনেকটা সেরকমই। দাড়ি-গোঁফ কামাইনা অনেকদিন হল। এ অবস্থায় টুপি পরে তবলীগে ঢুকে গেলে, আমাকে আর কেউ খুনী বলে কল্পনাও করতে পারবে না। বেশ-ভূষা এমনি জিনিস, মানুষকে অন্ততঃ বাহ্যিক ভাবে আমূল পরিবর্তন করে ফেলে!
আমাকে যমটুপি পরানো হচ্ছে, দুধ-কলা মাখানো দড়িতে ঝুলানো হবে। আমি ভয়ে লাইলাহা ইল্লালাহু মোহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ পড়তে পড়তে কাপড় নষ্ট করে ফেলব। এসব ভাবতেই গায়ের লোম খাড়া হয়ে যায়!
গ্রামের হিন্দুরা ধীরে ধীরে নিজের বাড়ী-ঘরে ফিরে আসছে। যাদের সহায়সম্পত্তি উদ্ধার করা গেল, তারা তা ফেরৎ পেলেন। কিন্তু বেশীর ভাগ হিন্দু এবং মুক্তিযোদ্ধা পরিবার, বিশেষ করে বাসস্থানের ব্যাবস্থাটি শূন্য থেকে শুরু করতে হল। কারণ; রাজাকার আর পাক হানাদাররা বেশীর ভাগ ঘর-বাড়ী পুড়িয়ে দিয়েছিল। জীবন নিয়ে যেখানে সংশয়, সেখানে আমনের পরিচর্যার মত বাহুল্য কেউ করেনি। তাই অনেক জমিতে ফসলতো দূরের কথা, আবাদই হয়নি। স্বাধীনতার নব ঘন আনন্দের হিল্লোলে অনেক পরিবারই যোগদিতে পারছে না। হিন্দুদের প্রায় প্রতি ঘরে প্রতি রাতে স্বজন হারানোর বিলাপ। বেশীর ভাগ হিন্দু কোন না কোন ছোট খাট ব্যাবসা বানিজ্য নিয়ে থাকত। সেক্ষেত্রে প্রায় সবগুলো পরিবার ব্যাবসার সাথে সাথে কর্তাটিকে হারিয়ে, এখন দিশেহারা। মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকই এখনো ঘরে ফেরেনি। তাদের মায়ের আশা সময়ের সাথে সংকীর্ণ হয়ে উঠে।
সেই ঘর পালানো দামাল ছেলেদের মায়েরা রাতবিরাতে কান্নার সুরে ডাকে; খোকা শূন্য এ বুকে আয় ফিরে আয়। ওরে অবুঝ তোর জ্বালায় নয়, তোর বিরহে তোকে বকি। লাউয়ের মাঁচায় মৌচাক ঝুলছে, কিচ্ছু বলবনা, পেরে পুরোটা তুই একাই খাবি। তালের শাঁস অনেক জমিয়েছি। শিমের বিঁচি, খেজুরের রস সবটুকুই পাবি। দোহারীর মত পাশ থেকে কিশোরী বোনটি বলে, ভাইয়া মাটির ব্যাংকে জমানো টাকা নিয়ে গেছিস বলে কিচ্ছু বলবনা। তুই এলে আমার মুরগীর ডিম আর কেউ পাবে না। দুঃখের রাগিণীর মুদ্ধ শ্রোতাদের মত গ্রামের মানুষগুলো তাদের কান্না শুনে ক্ষনিকের জন্য স্তব্দ হয়ে থাকে। রাগিণীর মুগ্ধতায় মূর্ছিত শ্রোতাদের স্বতঃস্ফূর্ত করতালিতে ঘর পালানো ছেলেদের শোক ধীরে ধীরে স্মৃতির আড়ালে আশ্রয় নিতে থাকে।
নব জাতকের চিৎকারে মায়ের প্রসব বেদনা আনন্দে পরিনত হয়। হয়তো সদ্য স্বাধীন এই দেশে শহীদের বিসর্জণ অনেকটা সে ভাবেই আমাদের মুক্তির আনন্দে পরিণত হয়েছে। মৃত্যু, ধ্বংস, ধষর্ন, সব যুদ্ধের এইতো উপকরণ। না ফোটা বোমার মত যুদ্ধের কত প্রশ্ন অমিমাংসীত থেকে যায়! অনেক প্রশ্ন যুদ্ধের পরে নতুন করে জাগে।
হয়তঃ এমন একটা প্রশ্নের জন্ম দিতে শেরালীর মায়ের প্রসব বেদনা শুরু হল। কেবা পিতা কেবা জন্ম দাতা তার খোঁজ কে জানে! অথচ জীবনের স্পন্দনে পৃথিবীর পথে পা রাখতে ব্যাকুল শিশুটি আঁকুপাঁকু করে। ঐ জন্মের পেছনে লজ্জার কী আছে শিশু কি তা জানে! পৃথিবীকে তার অস্তিত্ব জানাতে সেও মুষ্টিবদ্ধ হাতে অধীকারের দাবীতে চীৎকার করে। মা ব্যাকুল হন। বেশী লোক জানাজানি না হলেই বাঁচি।
দিন কয়েকের মধ্যেই প্রথমে পাড়ায় পরে গ্রামে আরো পরে গ্রাম ছেড়ে এসব শিশুদের খবর পৌঁছে যায় মাদার তেরেসার উদ্ধার কর্মীদের কানে। সে সব শিশুদের, যারা এখনো বেঁচে আছে, তাদের অনাথ আশ্রমে নিয়ে যেতে, আসেন মাদার তেরেসার সেবিকারা।
কে বলবে এই শিশুটি কারো পাপের ফসল! আমাদের এক রকম করুনা করেই ছনের চালা দু'টো এখনো আশ্রয় দিচ্ছে। এই অন্ধকার আশ্রয়টুকু আলো করে রেখেছে "মায়া"। আমার খুব মায়া হচ্ছিল নবজাতিকার জন্য। তাই তার নাম দিয়ে ফেললাম মায়া। নিশ্বাসের বাতাস ছাড়া তাকে আর কিছুই আমরা দেইনি। মায়ের স্তন্য পাওয়ার অধিকার টুকু অনেক সময় ক্ষুধার কারণে রক্ষিত হয়নি।
তবু আজ বিদায়ের দিনে শেষবারের মত মায়ের স্তন্য পান করে যখন অচেনা আশ্রয়ের খোঁজে অপরিচিতের কোলে উঠল মায়া, তখন আমাদের কান্না দেখে ঘাবড়ে গেল সেবিকা ভদ্র মহিলা। মায়ের আঁচলটুকু অথৈ জলে ভাসা অনাথ শিশু কিছুতেই ছাড়তে চাইল না। আমারও মেজাজ গেল বিগড়ে। বললাম: শেরালীর বোন, ভাইয়ের কাছেই থাকবে।
চলবে.....
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে মার্চ, ২০০৮ ভোর ৪:১৭