প্রথমেই শ্রদ্ধা এবং কৃতজ্ঞতা জানাই গত ১৯ জুলাই আমাদের মধ্য থেকে চির বিদায় নেওয়া প্রিয় মানুষ " হুমায়ূন আহমেদ " স্যারকে। উনার বিদায়ের সাথে আমাদের বিদায় জানালো কল্পনার জগতের আরো কিছু চরিত্র। " হিমু, মিসির আলী এবং আর অনেক।"
সুয়া উড়িল, উড়িল , জীবেরও জীবন। সুয়া উড়িল রে। "
গানটার মধ্যে দিয়েই শুরু হয় ঘেঁটুপুত্র কমলা। তার আগেই ১ মিনিট নীরবতা পালন করা হয় " হুমায়ূন আহমেদের " আত্মার শান্তি কামনা করে।
ছবির প্রথমেই যে বিবরণ আছে তা থেকেই জানা যায় " আজ থেকে শতবছর পূর্বে সিলেটের হবিগঞ্জের হাওড় অঞ্চলের এক বৈষ্ণব আখড়ায় ঘেঁটু-গানের উদ্ভব হয় যাতে কিছুটা উচ্চাঙ্গসঙ্গীত প্রভাবিত ছিলো। সে গানের সাথে নাচের প্রচলন ছিলো। তখনকার সময়ে মেয়ে মানুষদের অবাধ চলাচল কিংবা নাচ গানে তাদের অংশগ্রহন ছিল না। কিন্তু পুরুষ তান্ত্রিক সমাজে মেয়ে মানুষের চাহিদা এই ঘেঁটু গানের আসরেও দেখা দেয়। আর তাতেই ছেলেদের মেয়েদের সাজে অংশ নিতে দেখা যায়। যা পরবর্তীতে বিত্তশালী পুরুষদের শৌখিনতা কিংবা কামনায় রূপ নেয়। সেই গানের দলে মেয়ে চরিত্রে নাচ গান করতো দরিদ্র পরিবারের সুন্দর চেহারার কিশোর ছেলেরা। আর নাচ গানের পর সঙ্গী হতো বিত্তশালীদের। আর্থিক অভাবের জন্য অনেক পরিবার তাদের সন্তানদের এই কাজে নিয়োজিত করে থাকতেন।
ছেলে মেয়েদের অংশগ্রহনে এতে কিছু অশ্লীলতা ঢুকে পড়ে। আর এতে করে ঘেঁটু নামের সাথে একধরণের ঘৃণা তৈরি হয় সেই সময়ের সাধারণ মানুষের আছে। গান কিংবা শৌখিনতার আড়ালে মুখ্য হয়ে যায় যৌন লালসা। যার কারনেই এই সব ঘেঁটু পুত্রদের সতীন হিসেবেই দেখতেন সেই সব শৌখিন চৌধুরীর স্ত্রীরা।
সাধারনেই মাঝেও এমন লালসা তৈরি হয় আর যার পরিনামে একদিন এই যৌন কর্মের আড়ালে ঢাকা পড়ে ঐতিহ্য, সেই সব ঘেঁটু গান। ঠিক যেমন এই ছবিটির অনেক গুণই অনেকেই হারিয়ে ফেলেছেন সমকামিতাকে মুখ্য করে।
এই অসচ্ছল পরিবারের সুন্দর ছেলে পরিবারের ভার কাঁধে নিতেই নামের সাথে একরাশ ঘৃণা যুক্ত নাম " ঘেঁটুপুত্র " ধারন করতে হয়েছিল। হাজার মায়ার বাঁধন ফেলে তাকে কাটাতে হয়েছিল মানসিক নির্যাতনের মধ্যে। কিশোরের দুরন্তপনায় তাকে দেখা যায়নি শুধু তার পরিবারের অসচ্ছলতার কারনে।
সেই সময়ের পয়সাওয়ালা মানুষ ইচ্ছা মতো তাদের ব্যাবহার করেন আবার ইচ্ছা মতো অনেকেই সেটা সহ্য না করতে পেরে চির বিদায়ের দিকে ঠেলে দেন। ধ্বংস করেদেন এক মায়াকে, এক পরিবারকে, একটা স্বপ্নকে।
" আমার যমুনার জল দেখতে কালো, স্নান করিতে লাগে ভালো, যৌবন মিশিয়া গেল জলে......... "
আবহ সঙ্গীত আমাকে অসম্ভব মুগ্ধ করছিল। সাথে গান গুলাও। ইমন সাহার সঙ্গীত পরিচালনায় সেই সময়ের গানের এই একটি ধারা আজ আমরা খুঁজে পাইনা সেটা বুঝাই যায়। হারিয়ে যাওয়া কিছু গান এই ছবির মাঝে ফিরে এসেছে। হল ভর্তি দর্শক গানের তালে তালেই দুলেছে। এমন কোন দর্শক পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ যে সিনেমাটা দেখে হল থেকে বাহির হয়ে মাথায় গানটা বাজাননি। আসলে ছবিতে সেই সময়ের সংস্কৃতি কিছুটা তুলে ধরা হয়েছে।
রসগোল্লা, মুরগ লড়াই এর মাধ্যমে দেখা দিয়েছে গ্রামবাংলার চিরচেনা রূপ যা আজকে আমরা আর দেখতে পাই না। ছবিতে একটা গান আমি খুব মিস করেছি যেটা থাকলে ভালই হতো " আগেকি সুন্দর দিন কাটাইতাম আমারা "
ছবিতে মেকআপ, পোশাকের দিক থেকে ১০০ বছর পূর্বের কথা মাথায় রেখেছেন বলেই এই বিষয়টি প্রশংসা পাবার যোগ্য।
অভিনয়ের দিক থেকে খুবই ভালো অভিনয় যে হয়েছে সেটা বলবো না। তবে মুখ্য চরিত্র ঘেটুপুত্র এবং চৌধুরীর অভিনয় খুব ভালো হবার কারনেই অন্যদের খারাপ অভিনয়ের দিকটা ঢাকা পড়েছে।
পুত্র শোক খুবই বিরাট একটা জিনিস। আর চলচ্চিত্রে তার প্রভাবতা খুব একটা দেখতে পেলাম না। কৌতুকের ভিড়ে হারিয়ে গেছে কিশোরের সেই জীবন।
কিশোরদের স্বাভাবিক আচরন এই চলচ্চিত্রে লক্ষ করা যায়নি। এর মূল কারণ যে দরিদ্রতা সেটা স্পষ্ট করেই বুঝা যাচ্ছিল। কিশোরের দুরন্তপনা হারিয়ে ছিল টাকা পয়সার চিন্তা আর নাচ গানের মাঝে।
গানের দিক থেকে চলচ্চিত্রটি খুবই প্রশংসা পাবার যোগ্য। চলচ্চিত্রের মধ্যে ধর্মের কিছুটা অলিখিত নিয়মের বিরোধিতা করা হয়েছে। আবার নাচের দিক থেকে শাওনের কোরিওগ্রাফি আমার এখানে মোটেই ভালোলাগেনি। যেহেতু কমলা ঘেঁটু পুত্র সেহেতু নাচে তার দক্ষতা যাচাই করা উচিত ছিল।
তবে পূর্বের হুমায়ূন আহমেদকে এই চলচ্চিত্রে খোঁজতে গিয়ে বার বার আঘাত পেয়েছি। মাঝে মাঝে ধৈর্য হারিয়ে ফেলেছি। কৌতুকের মাঝে নির্যাতনের প্রকাশ ব্যাহত হয়েছে। তবে বিত্তবানদের সেই সময়কার অবস্থা সম্পর্কে কিছুটা ধরনাও পেয়েছি। আবার পানিবন্দি মানুষের সেই সময়কার জীবনধারণের কষ্ট বুঝতে পেরেছি।
এবং সেই সময়ে সমকামিতা বা ঘেঁটু গান যে অনেক অনেক দিন ধরে চলছিল এই গান বাজনার আড়ালে সেটা বুঝা গিয়েছে নৃত্য প্রশিক্ষকের ঘেঁটু থাকার কথা শুনে।
ঘেঁটু গান পরবর্তীতে যৌন লালসায় গিয়ে ঠেকেছে সেটা খুব স্পষ্ট ভাবেই দেখান হয়েছে ঘোড়ার পালকের চরিত্রে। নির্যাতনের অবাধ ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছিল এই শৌখিনতা। আর সে জন্যই হারিয়ে গেছে সেই গান আর হারিয়ে গেছে সেই সমকামিতা।
অন্যদিকে চলচ্চিত্রের প্রিন্ট সেই সময়টাকে খুব ভালো করে ফুটিয়ে তুলেছে। ধর্মীয় দিক থেকে ছবিতে তেমন ধর্মের প্রভাব না থাকলেও ধর্মীয় গুরামির বিপক্ষে অবস্থান দেখে ভালো লাগলো। পোশাক, গান-বাজনার যন্ত্র কিংবা সাজসজ্জার দিক থেকে সেই সময়টা স্পষ্ট করে ফুটেছে। অবহেলিত নারী সমাজের প্রতিনিধিত্ব করেছে চৌধুরী পত্নী। প্রকাশ পেয়েছে মাতৃ মমতা আর সহোদর প্রীতি। মায়ের ভালোবাসা যে কত গভীর তার প্রকাশ পেয়েছে তমালিকার চরিত্রে। সর্বোপরি সকল শ্রেণীর প্রতিনিধিত্ব আছে এই চলচ্চিত্রে।
মুক্তির তারিখ :
৭ সেপ্টেম্বর ২০১২
শ্রেষ্ঠাংশে :
• তারিক আনাম খান - জমিদার
• মুনমুন আহমেদ - জমিদার পত্নী
• শুচিস্মিতা আনোয়ার প্রাপ্তি - জমিদার কন্যা
• মামুন - ঘেটুপুত্র কমলা (আসল নাম- জহির)
• প্রাণ রায় - ঘেটুদলের নৃত্য প্রশিক্ষক
• জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায় - ঘেটুদলের প্রধান (কমলার বাবা)
• আগুন - শাহ আলম (চিত্রশিল্পী)
• শামীমা নাজনীন - জমিদার পত্নী'র দাসী
• কুদ্দুস বয়াতি - ঘেটুদলের সদস্য
• ইসলাম উদ্দিন বয়াতী - ঘেটুদলের সদস্য
• তমালিকা কর্মকার - কমলার মা
• মাসুদ আখন্দ -
• প্রান্তি -
• রুশো -
• যুথি -
• রাজু -
• পুষ্প -
কলাকুশলীবৃন্দ :
• পরিচালনা: হুমায়ূন আহমেদ
• কাহিনি: হুমায়ূন আহমেদ
• সংলাপ: হুমায়ূন আহমেদ
• চিত্রনাট্য: হুমায়ূন আহমেদ
• নির্বাহী প্রযোজক: ফরিদুর রেজা সাগর ও ইবনে হাসান খান
• চিত্রগ্রহণ: মাহফুজুর রহমান খান
• ধারা বর্ণনা: আসাদুজ্জামান নূর (কাহিনী প্রবাহ)
• কোরিওগ্রাফি: মেহের আফরোজ শাওন
• কণ্ঠশিল্পী: ফজলুর রহমান বাবু, শফি মন্ডল, প্রান্তি
• গীতিকার: হুমায়ূন আহমেদ ("বাজে বংশী"), শিতালং শাহ ("শুয়া উড়িল"), সংগ্রহ ("সাবান আইনা" ও "যমুনার জল")
• সুরকার: মকসুদ জামিল মিন্টু ("বাজে বংশী"), রাম কানাই দাস ("শুয়া উড়িল"), সংগ্রহ ("সাবান আইনা" ও "যমুনার জল")
• সঙ্গীত পরিচালক: মকসুদ জামিল মিন্টু ও এস আই টুটুল ("শুয়া উড়িল")
• আবহ সঙ্গীত: ইমন সাহা
• শিল্প নির্দেশক ও টাইটেল: মাসুম রহমান
• প্রধান সহকারী পরিচালক: জুয়েল রানা
• সহকারী পরিচালক: মোহাম্মদ ইব্রাহিম ও চন্দন খান
• রূপসজ্জা: খলিলুর রহমান
• পোশাক সরবরাহ: অঞ্জনস
• পোস্ট প্রোডাকশন: মাহফুজুর রহমান খান ও জুয়েল রানা
• পরিস্ফুটন: সিয়াম ফিল্ম ডেভেলপমেন্ট কো. ডল. ব্যাংকক, থাইল্যান্ড
• মুদ্রণ: সিয়াম ফিল্ম ডেভেলপমেন্ট কো. ডল. ব্যাংকক, থাইল্যান্ড
• কালার এনালিস্ট: সিয়াম ফিল্ম ডেভেলপমেন্ট কো. ডল. ব্যাংকক, থাইল্যান্ড
• শব্দগ্রহণ: ধ্বনিচিত্র লিমিটেড
• পুন:শব্দ ধ্বনিচিত্র লিমিটেড
• সম্পাদনা: লীলাচিত্র
• কৃতজ্ঞতা স্বীকার: ফারুক আহমেদ ও প্রজ্ঞা ঐশ্বরিয়া
• নৃত্য প্রশিক্ষক: আব্দুর রহিম রয়
• প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান: ইমপ্রেস টেলিফিল্ম
আমার কাছে স্যার এর শেষ কাজটা খুবই অবহেলার মাধ্যমে করা হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। নয়তো ছবিটা আর আকর্ষণী হতো।
সপরিবারে দেখতে মানা ছিল বলেই অনেকেই ছবিটা অধীর আগ্রহ নিয়ে দেখেছেন আর তার ফল স্বরূপ নিষিদ্ধ জিনিসকে খুজেছেন বার বার। আর এতে করেই ঘেঁটুপুত্র কমলার জীবন থেকে সমকামিতা প্রাধান্য পেয়েছে অনেকের কাছে।