রাজা বলেন –কন্যা তুমি পরমা সুন্দরী। তুমি রাজার যোগ্য, তাই আমার নারী হও। গাছের বাকল ত্যাগ করে, পট্টবস্ত্র পরিধান কর। অঙ্গে রত্ন-অলঙ্কার ধারণ কর।
একথা শুনে শকুন্তলা লজ্জিত হলেন। মৃদু ভাষে জানালেন তিনি অঙ্গীকার করছেন পিতা এসে তাকে রাজার হাতেই সম্প্রদান করবেন।
শুনে ব্যাকুল দুষ্মন্ত বলেন মুনির অপেক্ষা করতে করতে তিনি হয়ত মারাই যাবেন। বেদে আট প্রকার বিবাহের কথা আছে। গন্ধর্ব মতেও ক্ষত্রিয়েরা বিবাহ করেন। সেই মতে তাদের বিবাহ হলে মুনির বচনে দোষ হবে না।
রাজার কথায় শকুন্তলা আশ্বস্ত হলেন এবং রাজাকে সত্যবচন করতে বললেন যে তিনি শাস্ত্র মেনে গান্ধর্ব মতে বিবাহ করতে প্রস্তুত, কিন্তু রাজাকে কথা দিতে হবে যে তার গর্ভজাত সন্তানকেই রাজা করা হবে।
কামে মত্ত রাজা অঙ্গীকার করলেন।
গান্ধর্ব মতে তাদের বিবাহ হল এবং তারা শৃঙ্গারে মত্ত হলেন।
রাজা ফিরে যাওয়ার সময় বললেন লোক পাঠিয়ে তিনি শকুন্তলাকে রাজ্যে নিয়ে যাবেন।
পথে যেতে যেতে নৃপতি ভীত হলেন মুনি আশ্রমে ফিরে কি বলবেন একথা ভেবে।
এদিকে কণ্বমুনি আশ্রমে ফিরে কন্যাকে কাছে ডাকলেন। লজ্জায় শকুন্তলা পিতার সামনে এলেন না।
বিস্মিত মুনি ধ্যানের মাধ্যমে সকল ঘটনা জানতে পারলেন।
হেসে তিনি কন্যাকে বললেন –আমাকে না বলে এই কর্ম করলে!
নির্জনে বিনা মন্ত্রপাঠে সকাম পুরুষের সকামা স্ত্রীর সঙ্গে যে মিলন তাকেই গান্ধর্ব বিবাহ বলে, ক্ষত্রিয়ের পক্ষে তাই শ্রেষ্ঠ।
তোমায় কন্যা স্নেহে পালন করেছি তাই ক্ষমা করলাম।
শকুন্তলা করজোড়ে বললেন –ক্ষমা করুন, পিতা!
তিনি আরো বললেন, দুষ্মন্তই তার যোগ্য পাত্র। তারা গন্ধর্ব মতে বিবাহ করেছেন। রাজাকেও যেন মুনি ক্ষমা করেন।
এত শুনে মুনি কন্যাকে আশ্বাস দিলেন এবং রাজাকেও ক্ষমা করে দিলেন।
তিনি শকুন্তলাকে বর প্রার্থনা করতে বললেন।
শকুন্তলা বললেন –পিতা, প্রসন্ন হয়ে এই বর দিন যেন অতুল প্রতাপে পৌরব অর্থাৎ পুরু বংশ পৃথিবী শাসন করে। রাজ্য চ্যুত অথবা অধর্ম পরায়ণ যেন পুরু বংশীয়েরা কোনদিন না হয়।
শকুন্তলার মুখে এই বাণী শুনে মুনি ‘তথাস্তু’ বলে বর দিলেন। এভাবে কণ্বমুনির কাছে শকুন্তলা রয়ে গেলেন।
এদিকে রাজভোগে দুষ্মন্ত শকুন্তলাকে ভুলে গেলেন।
কিছুকাল পর শকুন্তলা এক পরম সুন্দর পুত্র সন্তান প্রসব করলেন। সেই পুত্র দিনে দিনে মুনিগৃহে বাড়তে লাগলো। ছয় বছর এভাবে কেটে গেল। রাজা কিছুই জানতে পারলেন না।
সেই শিশু ক্রমে মহা পরাক্রমী বীর হয়ে উঠল। বাঘ-সিংহ কিছুতেই তার ভয় নেই। সে বাঘ, সিংহ, মহিষ, হাতি প্রভৃতি ধরে এনে আশ্রমের বৃক্ষে বেঁধে রাখে। তার বিক্রম দেখে মুনি চমৎকৃত হলেন। সকল জন্তুকেই সে দমন করে তাই দমনক নাম রাখা হল সেই পুত্রের।
মুনি শকুন্তলার সাথে আলোচনা করলেন পুত্র যুবরাজের যোগ্য হয়ে উঠেছে, এবার তাকে নিয়ে রাজগৃহে যাওয়া উচিত। কন্যাকে বুঝিয়ে এক শিষ্যের সাথে তাকে দুষ্মন্তের কাছে পাঠালেন।
শকুন্তলা পুত্র নিয়ে রাজার সামনে উপস্থিত হলেন। পাত্র-মিত্র নিয়ে সভাগৃহে দুষ্মন্ত বসেছিলেন। রাজাকে দেখে শকুন্তলা তার পুত্রকে দেখালেন এবং পূর্বে করা প্রতিজ্ঞার কথা স্মরণ করালেন।
সভাসদরা বিস্মিত হল।
রাজা হেসে শকুন্তলাকে চিনতে অস্বীকার করলেন।
এই অপমানে শকুন্তলা লজ্জায় ও দুঃখে সংজ্ঞাহীন স্তম্ভের মত দাঁড়িয়ে রইলেন। তাঁর চক্ষু রক্তবর্ণ হল, ওষ্ঠ কাঁপতে লাগল, কটাক্ষে তিনি যেন রাজাকে দগ্ধ করতে লাগলেন। তবু ক্রোধ সম্বরণ করে তিনি রাজাকে বোঝাতে লাগলেন।
দৈবের কারণে তাদের কথা কেউ যানে না কিন্তু রাজা নিজের মনকে প্রশ্ন করুক।
জ়েনে শুনে যে ব্যক্তি মিথ্যা বলে সে সহস্র বৎসর নরক গমন করে। লুকিয়ে যে পাপ কর্ম করে লোকে না জানুক ধর্ম সব জানে।
চন্দ্র, সূর্য, বায়ু, অগ্নি, পৃথিবী আর জল-আকাশ, দিন, রাত্রি, সন্ধ্যা, প্রাতঃ-শমন, ধর্ম জানেন সব জন।
বালক বৃদ্ধ সকলেই জানে ধর্মাধর্ম অনুসারে তার ফল শমন(যম) ঠিকই দেন।
তাই মিথ্যা বাক্য রাজার উচিত কাজ নয়। মিথ্যার মত পাপ নেই-একথা সকল শাস্ত্র মানে।
পতিব্রতা শকুন্তলাকে রাজার এমন নীচ ভাবা উচিত নয়। পুত্ররূপে পিতাই স্ত্রীর গর্ভে জন্মায়-শাস্ত্রে এর প্রমাণ আছে। সে কারণে ভার্যাকে জননীর সমান দেখা উচিত।
তাকে উপেক্ষা করে রাজা বিস্তর দোষ করলেন-কারণ সর্ব শাস্ত্রে স্ত্রীকে পুরুষের অর্ধেক শরীর বলা হয়। তাই ভার্যার সমান বন্ধু পৃথিবীতে আর হয় না। সে কারণে পুরুষের পতিব্রতা নারী হল পরম সহায়। তার সাহায্যেই সর্ব ধর্ম সুসম্পন্ন হয়।
ভার্যাবিনা গৃহ, শূণ্য অরণ্যের মত। আবার বনে ভার্যার সঙ্গ থাকলে গৃহস্থের বেষ্টনী মেলে। স্ত্রীহীন ব্যক্তিকে কেউ বিশ্বাসও করে না। সর্বদা এরা দুঃখিত ও উদাস থাকে।
স্ত্রীযুক্ত ব্যক্তি সুখে ইহলোকে বাস করে।
স্বামী জীবিত অবস্থায় স্ত্রীর মৃত্যু হলে, সে স্বামীর পথ চেয়ে থাকে, তাকে অনুসরণ করে।
স্বামী মারা গেলে স্বামীকে উদ্ধার করে স্বর্গে নিয়ে যায়।
একথা দেবতারাও স্বীকার করেন।
ভার্যার দ্বারাই রাজা পুত্র মুখ দেখা সম্ভব। সন্তান হলেই মানুষ সব দুঃখ ভুলে সুখ পায়। স্ত্রী বিনা কারো সন্তান গ্রহণ সম্ভব নয়-দেবতা, ঋষি, মুনি প্রমুখ যতই মহামতি হোন।
পুত্রের সমান রাজা সংসারে আর কিছুই নেই। সন্তানের জন্মের পর তার মুখ দেখে পিতামাতা স্বর্গসুখ পান। পিন্ডদানের মাধ্যমে পুত্র তাদের উদ্ধার করে-এই নির্দেশ বেদে ব্রহ্মা দিয়েছেন।
চতুষ্পদের মধ্যে গাভী শ্রেষ্ঠ, দ্বিপদে ব্রাহ্মণ, অধ্যয়নে গুরু শ্রেষ্ঠ, আলিঙ্গনে পুত্র। ধূলায় ধূসর পুত্রকে আলিঙ্গন করে হৃদয়ের সর্ব দুঃখ অন্তর্হিত হয়।
সেই পুত্র তোমার সামনে দাড়িয়ে, রাজন! তাকে পরমানন্দে আলিঙ্গন কর। একে নীচ পুত্র ভেবে অবজ্ঞা করো না। এর মহিমাগীত একদিন জগৎ গাইবে। শত শত অশ্বমেধ যজ্ঞ হবে। সসাগর ধরার রাজ্য পাবে। এই পুত্রের দ্বারাই বংশ উজ্জ্বল হবে। ভাল করে প্রত্যক্ষ কর রাজা, এই দ্বিতীয় তপন।
পিতার অভাবে পুত্র সদা দুঃখ পায়-সে কারণেই তাকে এখানে আনা হয়েছে। একে আপনার কুমার রূপে আলিঙ্গন কর।
দুঃখ নেই তুমি আমাকে গ্রহণ কর বা ত্যাগ কর। কারণ পিতা বিশ্বামিত্র এবং মাতা মেনকা আমায় বনে ত্যাগ করেছেন। আমায় পূর্বেই জননী ত্যাগ করলেন! এখন তুমিও করো! আমার মৃত্যুতে দুঃখ নেই, কিন্তু এই পুত্র বিচ্ছেদই আমায় শত দুঃখ দিচ্ছে।
এত শুনে দুষ্মন্ত প্রত্যুত্তর করলেন, কেন তাকে বারবার এসকল কথা শোনান হচ্ছে! এসকল বাক্য শুনেও কেউ শকুন্তলাকে শ্রদ্ধা করবে না। কারণ, তার পিতা বিশ্বামিত্র ছিলেন পরম লোভী এবং মাতা মেনকা গণিকা। তাদের পথই শকুন্তলা অনুসরণ করেছে।
শকুন্তলার সকল বাক্য মিথ্যা প্রতিপন্ন করতে চান রাজা।
শকুন্তলা রাজাকে দেবলোকের নিন্দা করতে বারণ করেন।
বিশ্বামিত্র মহাঋষি সকলেই তা জানেন।
অন্যদিকে দেব-অপ্সরা মেনকাকে দেবতারাও পূজা করেন।
তাছাড়া শকুন্তলার নিজেরও অন্তরে অনেক শক্তি আছে। তিনি ইচ্ছা করলেই সব স্থানে যেতে পারেন।
তবু স্বামীর জন্যই আজ সকল নিন্দা সহ্য করছেন। কিন্তু মুনিকন্যা কখনও মিথ্যা কথন করে না-এত বলে তিনি প্রস্থানে উদ্যত হলেন।
এসময় আকাশ থেকে বাণী ঘোষিত হল -শকুন্তলার সকল বাক্য সত্য, তিনি প্রকৃতই দুষ্মন্তের স্ত্রী। তিনি পতিব্রতা এবং তার পুত্রের পিতা রাজা দুষ্মন্ত।
স্বামী বলেই শকুন্তলা আজ তোমায় ক্ষমা করলেন। তার ক্রোধে রাজার কখনও ভাল হবে না। এই পুত্রই তার বংশের তিলক। আজ থেকে এর নাম হল-ভরত। এর মাধ্যমেই দুষ্মন্তের বংশোজ্জ্বল হবে।
এই আকাশবাণী শুনে রাজা বলেন –মন্ত্রীরা সব অবগত হলেন! আমি এ সত্য প্রকৃতই জানতাম। কিন্তু লোকাচারের ভয়ে শকুন্তলাকে গ্রহণে অক্ষম ছিলাম। তাকে অপমান করলাম।
এত বলে তিনি সিংহাসন থেকে নেমে শকুন্তলার হাত ধরলেন এবং তাকে ফিরিয়ে আনলেন। পুত্রকে ক্রোড়ে তুলে শত শত চুম্বন একে দিলেন
কপোলে।
শকুন্তলা হলেন রাজ পাটেশ্বরী। পরমানন্দে তারা রাজ্য শাসন করতে লাগলেন। বৃদ্ধ বয়সে তারা রাজ্যভার ভরতের হাতে অর্পণ করে বনবাসে গেলেন।
পৃথিবীর মহারাজ হলেন ভরত। তিনি অশ্বম্বেধ যজ্ঞ করেন। দানধ্যান করেন। দাতারূপে জগৎ খ্যাত হন। তার ঘোষিত ভূমি ভারতভূমি নামে খ্যাতি লাভ করে।
ভরত–উপাখ্যান যারা করেন শ্রবণ, আয়ুর্যশ পূণ্যযশ তাদের বাড়ে দিন দিন।।
..........................................
উৎসর্গ: সকল ব্লগার বন্ধুকে
..........................................
আগের পর্ব:
কথাচ্ছলে মহাভারত - ২৩
Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই সেপ্টেম্বর, ২০১০ রাত ১১:৫৭