পরীক্ষিতের ব্রহ্মশাপঃ
এরপর সৌতি বললেন- অনেক বছর পর পান্ডু বংশে পরীক্ষিত নামে রাজা জন্মালেন। যিনি মহা পূণ্যবান এবং যার সূর্যের মত প্রতাপ। কৃপাচার্যের শিক্ষায় তিনি সকল শাস্ত্র আয়ত্ত করেন।
সর্বগুণ যুক্ত রাজা ছিলেন সত্যব্রত। অনেকদিন ধরে তিনি বনে বনে মৃগয়া করছিলেন। একদিন এক হরিণকে বাণ মারলেন। হরিণটি পালিয়ে গেল, রাজা তার পিছু নিলেন। পরীক্ষিতের বাণে কেউ বাঁচে না, তবু দৈবের বলে হরিণটি হারিয়ে গেল।
রাজা বনের অনেক গভীরে ঢুকে পড়লেন। তার প্রচন্ড জল তেষ্টা পেল। শেষে তিনি এক গোচারণভূমিতে উপস্থিত হলেন এবং দেখলেন বাছুররা দুধ পান করছে। আর তাদের মুখ থেকে যে ফেনা বের হচ্ছে তা পান করছেন একজন ঋষি।
ঋষিকে দেখে রাজা কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন তিনি কোন বাণবিদ্ধ মৃগ দেখেছেন কিনা। তিনি নিজের পরিচয়ও দিলেন এবং ক্ষুধা ও তৃষ্ণার কথা বললেন। মৌণ ঋষি কোন উত্তর দিলেন না। রাজা তবু বারবার হরিণটি কোন পথে গেছে তা জিজ্ঞেস করতে লাগলেন।
রাজা জানতেন না ঋষি মৌনব্রত করছেন, ফলে উত্তর না পেয়ে তিনি রেগে গেলেন। একে তিনি রাজা, তার উপর অতিথি! রাজা ঋষিকে দুষ্ট প্রতিপন্ন করলেন এবং রেগে একটি মৃত সাপ ধনুকের সামনে দিয়ে তুলে ঋষির গলায় পরিয়ে দিলেন। শেষে রাজা ঘোড়ায় চেপে হস্তিনানগরে ফিরে গেলেন।
ঋষির এক ব্রাহ্মণ পুত্র ছিলো, তাঁর নাম শৃঙ্গী। তার বন্ধু কৃশ তাকে বললো -তুমি কিসের গর্ব কর! বনে গিয়ে দেখ রাজা তোমার পিতার সাথে কি ব্যবহার করেছেন!
বনে এসে শৃঙ্গী দেখে বাবার গলায় মৃত সাপের মালা। এই দেখে সে রেগে গেল এবং হাতে জল নিয়ে রাজাকে শাপ দিল –আজ থেকে সাতদিনের মধ্যে রাজা পরীক্ষিত তক্ষক সাপের কামড়ে মারা যাবে।
পুত্রের এই শাপ শুনে ঋষির মনে দুঃখ হল। মৌনভঙ্গের পর তিনি অনুতাপ করতে লাগলেন। সন্তানকে রাগের মাথায় শাপ দেওয়ার জন্য শাসন করলেন।
তিনি বললেন -রাজাকে শাপ দেওয়া অনুচিত। তিনি প্রজাপালন করেন। তিনি ব্রাহ্মণদের যজ্ঞে সাহায্য করেন। দুষ্ট, দৈত্য, চোর ও ভয় দুর হয় রাজার হস্তক্ষেপে। রাজ্য রক্ষার জন্যই বিধাতা রাজাকে সৃষ্টি করেছেন। রাজা বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণ অর্থাৎ শ্রোত্রিয়, তাকে শাপ দেওয়া পাপ।
তাছাড়া পরীক্ষিত অন্য রাজাদের মত নন। তিনি পিতামহের মতনই স্বধর্মে পন্ডিত। আমি মৌনব্রতে আছি তা রাজা জানতেন না। সে সময় তিনি ক্ষুধার্তও ছিলেন, তাই ভুল করে ফেলেছেন। তাছাড়া তিনি আমাদের অতিথি। আমিই অতিথিসেবা করিনি। এই বলে তিনি হাহাকার করতে লাগলেন এবং পুত্রকে দুঃখ ভুলে ক্ষমা করে দিতে বললেন।
এত শুনে শৃঙ্গী বললেন –আমার কথা সহজ়ে খন্ডন হবে না। যা বলে ফেলেছি তা ফলবেই।
এত শুনে ঋষি চিন্তিত হলেন এবং যখন বুঝলেন অভিশাপ আর খন্ডিত হবে না, তখন তার শিষ্য গৌরমুখকে রাজার কাছে সব জানিয়ে আসতে বললেন।
হস্তিনাপুরে গৌরমুখ পরীক্ষিতের সাথে দেখা করতে গেলেন। রাজা তার পা ধুইয়ে দিলেন। তারপর কোথা থেকে, কি কারণে এসেছেন জানতে চাইলেন।
গৌরমুখ বললেন –রাজা মন দিয়ে শুন। মৃগয়া করতে তুমি বনে গেছিলে এবং এক ঋষির গলায় মৃত সাপ জড়িয়ে এলে। তা দেখে তার পুত্র ক্রোধিত হয় এবং তোমায় শাপ দেয়। তার পিতা তখন তা জানতেন না। পরে সব শুনে খুবই দুঃখিত হন এবং আমায় তোমার কাছে পাঠান। পুত্রকে অনেক বুঝিয়েও তিনি শাপমোচন করতে পারেন নি। সাতদিনের মধ্যেই তোমার তক্ষকের কামড়ে মৃত্যু হবে। এর একটা উপায় এখন থেকেই কর।
সব শুনে রাজা বজ্রাহত হলেন এবং নিজেকে ধিক্কার দিয়ে বললেন –হিংসা করে আমি কি পাপই না করলাম! মৃত্যুর চিন্তা আমি আর করি না। সেই ঋষি ও তার পুত্রকে কষ্ট দেওয়ার জন্য আমি দুঃখিত। তিনি যে মৌনব্রতে ছিলেন তা আমি জানতাম না। তবে যে শাস্তি আমার হল তা আমি নেব। আপনি ঋষিকে আমার প্রণাম জানাবেন। দৈবের বাক্য খন্ডন করা সম্ভব নয়। এত সব বলে গৌরমুখকে তিনি বিদায় সম্ভাষণ জানালেন।
সব মন্ত্রীরা এসে সব শুনে আলোচনা শুরু করলো। কি উপায়ে তাদের রাজাকে বাঁচান যায়। তারা ঠিক করলেন একটি উঁচু মঞ্চে করা যাক। সেখানে রাজাকে ঘিরে সব মন্ত্রীরা পাহারায় বসবেন। সাপ থেকে তাকে দুরে রাখার চেষ্টা হল। বেদজ্ঞ পন্ডিতদের এনে রাজা তার চারদিকে রাখলেন এবং দানধ্যান করে ও হরির নামগান শুনতে লাগলেন।
তক্ষকনাগ
..........................................
উৎসর্গ: সকল ব্লগার বন্ধুকে
..........................................
আগের পর্ব:
কথাচ্ছলে মহাভারত - ১০
Click This Link