ক্লাসঘরে সুমিতার সঙ্গে শালিক ‘সোনা’
সুমিতার সঙ্গেই প্রোমোশন পেয়ে ক্লাস সিক্সে উঠল সোনা। কিন্তু পরীক্ষা না দিয়েই।
তা কেমন করে হয়?
কেন? বন্ধুত্বের জোরে।
তিন বছর ধরে সোনা যে সুমিতার ছায়াসঙ্গী। সুমিতার সঙ্গেই ঘুমায়, তার সঙ্গেই ঘুম থেকে ওঠে, সুমিতার হাতেই খায়, স্কুলেও যায় সুমিতার সঙ্গে। ফেরেও এক সঙ্গে। তিন বছর ধরে এমনটাই দেখে আসছে রায়গড়ার জঙ্গল ঘেরা মুনিসিংহ গ্রামের লোকজন। সুমিত ও সোনার সখ্য এ অঞ্চলে এখন গল্পকথা।
ইন্টারনেট, শপিং মল, সাইবার কাফে, ঝাঁ চকচকে গাড়িবাড়ির অনেক অনেক দূরে ওড়িশার এক প্রত্যন্ত গ্রাম মুনিসিংহ। এ যেন এক অন্য বসুন্ধরা। যেখানে এখনও মেলে জঙ্গলের নিবিড় গন্ধ, বনের পাখি এসে মিতালি পাতায় মানুষের সঙ্গে। বসুন্ধরার এই অংশে এখনও টাকাকড়ির থেকে বেশি দাম পায় হৃদয়ের সম্পর্ক। আর তারই প্রমাণ ১১বছরের ছোট্ট মেয়ে সুমিতা প্রধানের সঙ্গে শালিক পাখি সোনার এই অমলিন সখ্য।
এই বন্ধুত্বের সূচনা তিন বছর আগে। রায়গড়ার মুনিগুড়া ব্লকের মুনিসিংহ গ্রামের আদিবাসী শ্যামলবরণ কন্যা সুমিতা লাজুক হাসির সঙ্গে নিজেই জানাল সেই কথা। তার কথায়,“বছর তিনেক আগে গ্রামের পুকুরে স্নান করতে নেমেছি, হঠাৎ কোথা থেকে উড়ে এসে কাঁধে বসল একটা শালিক। কাঁধ থেকে নামতেই চায় না। আমার সঙ্গেই বাড়িতে এল। সেই যে এল, আর যায়নি। ওর নাম রাখি সোনা। বাড়িতে থাকলে সারাদিন আমার কাছেই ঘুরঘুর করে। এমন কী আমার সঙ্গেই স্কুলে যায়। পড়ার সময় খাতা ও বইয়ের উপরেও বসে পড়ে মাঝেমধ্যে। সারাদিন যতক্ষণ স্কুলে থাকি, সোনা ক্লাসের মধ্যেই থাকে। আবার আমার সঙ্গেই বাড়ি ফেরে। খায় শুধু আমার হাতে। রাতে আমার বিছানাতেই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘুমায়। ও আমার দিনেরাতে অষ্টপ্রহরের সাথী। কি ভালই যে বাসে আমাকে।”
বাড়ির লোক মেনে নিলেও গোড়ার দিকে স্কুলে শিক্ষকরা বিরক্ত হতেন সুমিতার সঙ্গে সোনাকে দেখে। সুমিতাকে বলতেন,“যাও পাখিটাকে বাইরে রেখে এসো।”
কিন্তু এমনিতে শান্ত হলেও সোনা তার বন্ধু সুমিতার কাছছাড়া হতে নারাজ। তাড়া দিলেও ক্লাস থেকে যেত না। শেষে হাল ছেড়ে দেন শিক্ষকরা। এখন অবশ্য সুমিতার অন্য সহপাঠীরাতো বটেই, শিক্ষকরাও ভালবেসে ফেলেছেন সোনাকে। আর তাই তো, চতুর্থ শ্রেণি থেকে পঞ্চম, তারপর ষষ্ঠ শ্রেণির ক্লাস রুমেও সোনার অবাধ প্রবেশাধিকার। সুমিতার ক্লাসের অন্য বন্ধুরা বলে,“পরীক্ষা না দিয়েই সোনা ক্লাসে প্রমোশন পেয়ে যায়। কী মজা ওর।”
মুনিসিংহ এখন শুধু অখ্যাত গ্রামের নাম নয়। প্রাণী ও মানবের সখ্যের হৃদয়ভূমি।
সুমিতার দৃষ্টান্ত দেখে এই গ্রামে ছোটবড় সবাই এখন অনুপ্রাণিত। আর তাই জঙ্গলঘেরা এ গ্রামে পা দিলে বনের সোঁদা গন্ধের সঙ্গে মিলবে ভালবাসারও গন্ধ। বসুন্ধরার সব থেকে বড় সম্পদ।
-অনমিত্রা সেনগুপ্ত, ভুবনেশ্বর: আনন্দবাজার; ২২/৩/১০।