আজ থেকে পাঁচ বছর আগের কথা।সিনেমার ডিভিডি বাছাই করছি একটা এক সুন্দরীর ছবি মনে ধরেছে।সিনেমার নাম ম্যানিলা আর ঐ সুন্দরি ছিলেন মনিকা বেলুচ্চি ।একটা টিনএজ ছেলের লুকিয়ে তাকে দেখতে যায়। বেলুচ্চি কে ভেবে রাতে মাস্টারবেশন করে । তার পরিবারের সবাই বিষয়টা জেনে ছেলেটাকে একদিন বাবা নিজেই পতিতালয়ে নিয়ে যায়।এই বয়সের একটা ছেলের চিন্তা ভাবনা,কাজ নিয়ে যে একটা সিনেমা হতে পারে চিন্তা করি নাই। ঐতিহাসিক অনেক কাহিনী ছিল সবটা মনে নেই। সিনেমাটা ভাল লেগেছি খুব এই টুকুই মনে আছে। আর মনে আছে সিনেমার সুন্দরি নায়িকার মুখ।
একটা নাম যত বেশি শুনা হবে ততই তার প্রতি এক ধরনের দুর্বলতা তৈরী হয়। নিজের নামটা তাই মানুষের খুব প্রিয়।
মিডিয়াতে এত সব পণ্যের যে বিজ্ঞাপন দেয়।আপনি হয়তো খুব বিরক্ত। আমিও বিরক্ত কোন অনুষ্ঠান এই বিজ্ঞাপনের জ্বালায় দেখতে পারিনা। অনেক বিজ্ঞাপন আবার এতই জঘন্য দেখলে বমি আসে। আর মনে মনে আমার মতো হয়তো আপনিও ভাবেন যতই বিজ্ঞাপন দিক এই পণ্য আমি কোন ভাবেই কিনব না,। কিন্তু যখন দোকানে এই পণ্যটা আপনি ঝুলাতে দেখবেন আপনি মনে মনেই এই চেনা নামটার প্রতি এক ধরনের দুর্বলতা অনুভব করবেন। আপনি না চাইলেও এই দুর্বলতায় আপনি আক্রান্ত হবেন। এই মনস্তত্ত্বের ভিত্তিতেই কোটি কোটি টাকা বিজ্ঞাপনের পেছনে খরচ করেন। নাহলে এই যে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা এই পণ্য গুলোর জন্য খরচ করে তার আর কি কারন থাকতে পারে?
লাইব্রেরি যখন এই ম্যানিলা নামটা দেখি আমিও এই নামের প্রতি দুর্বলতা বোধ করি। নিজের অজান্তেই মনিকা বেলুচ্চির মুখটা মনে পড়ছিল। বইটার নাম ম্যানিলার চিঠি। লেখক জামসেদ ফয়েজি।এই নামে তিনি পত্রিকায় লিখতেন। তার আসল নাম মোহাম্মদ আবদুল মুঈদ।USAID এর বৃত্তি নিয়ে ১৯৬৪ সালে এক বছরের একটি কোর্স করার জন্য ম্যানিলায় গিয়েছিলেন। তখন কার লেখা ডাইরি থেকে ১৯৮৮ সালে দৈনিক নব অভিযান পত্রিকায় ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশ পায়। এবং বই আকারে বের হয় ২০০২ সালে।এই হল ম্যানিলার চিঠির পেছনের কথা।
ভ্রমন কাহিনী লেখকদের মাঝে সবচেয়ে প্রিয় অন্নদাশঙ্কর রায়। তার পরেই সৈয়দ মুজতবা আলি। আর কাউকে এমন প্রিয় তালিকায় নিতে পারছিলাম না। এই ম্যানিলার চিঠি পড়ার পরে এই তালিকায় আর একজনকে সংযুক্তি করে নিলাম। যদিও তিনি লিখেছেন অল্প কয়েকটি বই। আর ভ্রমন কাহিনী এই একটিই।
এই অঞ্চলের লাইব্রেরি গুলাতে আঞ্চলিক অনেক লেখকের বই শোভা পায়। সিলেটে অনেক লন্ডনি বই মেলার সময় দেশে আসেন। এক সাথে অনেক গুলো বই বাজারে প্রকাশ করে আবার চলে যান। শুনেছি এখানে নাকি কার কয়টা বই প্রকাশিত হলো এই নিয়ে লন্ডনে এক ধরনের অসুস্থ প্রতিযোগিতা হয়। এর ফল স্বরূপ স্থানীর লাইব্রেরিতে বাজে বই এর স্তুপ জমে থাকে।আঞ্চলিক লেখকের বই কিনে তাই উৎসাহ পাই না। তার মাঝে ভাল যে লিখেন না এমনটা বলছি না। কিন্তু এত আবর্জনার ভেতরে একটা সুই খুঁজে পাওয়া সত্যিই কষ্টকর। কিন্তু আমার কোন কাজ নেই বলে অবসর সময় আড্ডা দিতে যাই এই লাইব্রেরিতে। এমন এক কোণে দাঁড়িয়ে এই বই সেই বই পালা উল্টাতে থাকি। বিখ্যাতদের বই তো নাম দেখেই কিনি। কিন্তু যাদের এত নাম ডাক হয়নি,বাজারে বই এর কাটতি ভাল নেই। যারা নির্জনে ই সাহিত্য সাধনা করে যান তারা আমাদের আড়ালেই থাকেন। চায়ের দেশে থেকেও যেহেতু খাঁটি চা এখানে সুলভ না। এমনটাই ঘটে আমার ক্ষেত্রে। বই নিয়েই সময় আমার কাটে কিন্তু তবু অনেক মূল্যবান বই আমার হাত দিয়েই মানুষ নেয় অথচ আমি জানি না।
মি.ফয়জী একবছর ছিলেন ফিলিপিনের,ঘুড়ে বেড়িয়েছে সাগর থেকে পাহাড়,গ্রাম থেকে শহর। খেয়েছেন রেস্তোরাঁর থেকে রাজ ভোজন।মিশেছেন দেশী বিদেশী বহু মানুষের সাথে। ফিলিপিনে আছে বহু জাতির বাস। সেই সময় সেখানে বাস করতে হেড হান্টারা এবঙ একই সাথে হলিউডের সিনেমা আমেরিকায় মুক্তি পাওয়ার আগে ফিলিপিনে মুক্তি পেত। এত বৈচিত্র্য মানুষের দেশ ফিলিপাইন।
স্পেন দেশীয় নাবিক ম্যাজালান ১৫২১ খৃষ্টাব্দে পৌঁছে কলম্বাসের মতো মনে করলেন যে তিনি একটা নতুন দেশে পৌঁছে গেছেন। এশীয়দের কাছে সুপরিচিত হলেও তখন পর্যন্ত ঐ দ্বীপ গুলোর সমষ্টিগত কোনো নাম ছিলনা। সে সময় অস্ট্রিয়ার রাজকুমার ফিলিপ ছিলেন স্পেনের রাজসিংহাসনের উত্তরাধিকারী। ম্যাজালান সে কারণে এই দ্বীপপুঞ্জের নাম রাখলেন ফিলিপিনস।
ফিলিপিনের শহর থেকে গ্রাম। ফুল থেকে নদী। পাহাড় থেকে সাগর,গাছ থেকে প্রাণী,ফুল থেকে অস্ত্র,ইতিহাস থেকে নৃতত্ত্ব ,শিক্ষা থেকে কুসংস্কার,ধর্ম থেকে সংস্কৃতি,সভ্যতা থাকে বর্বরতা,বিনয় থেকে নিষ্ঠুরতা,প্রেম থেকে সেক্স। সব বিষয়েই তিনি তুলে এনেছেন গল্পের ছন্দে। বইটা পড়তে পড়তে বার বারই মনে হয়েছিল অন্নদাশঙ্কর রায়ের পথে প্রবাসে,জাপানে পড়ে যেমন প্যারি সম্পর্কে,জাপান সম্পর্কে,ব্রিটেন সম্পর্কে নিখুঁত ধারনা পাই। তেমনি এই ম্যানিলার চিঠিটা পড়েও একটা মলাটে পেয়ে যাই পুরো ফিলিপিন কে। নিজের চোখে না দেখেও কোন একটা দেশকে এভাবে চোখের সামনে কল্পনা করিয়ে নেয়া সহজ কাজ মোটেও না। কত সহজ জিনিস বোঝাতে পৃষ্ঠার পৃষ্ঠা লিখি কিন্তু আমি রাম একতারা বাজায় শ্যাম এমন অবস্থা।
বইটার বর্ণনা দেয়া আমার উদ্দেশ্য না। আর আমি যদি বইটার বর্ণনা করে সব বোঝাতে পারতাম তাহলে তো একটা বইই লিখতে পারতাম, তাই না? এটা হচ্ছে আমার ভাল লাগা এবং বইটা পড়তে পড়তে আমার মনের মধ্যে যেসব ভাবনা উঁকি ঝুঁকি মারছিল তাদের কিছু অংশ তুলে দেয়া।তবে শেষ কথা হচ্ছে যারা ভ্রমন কাহিনী পড়তে পছন্দ করেন।অন্নদাশঙ্কর রায়,সৈয়দ মুজতবা আলী যাদের প্রিয় তারা নিরাশ হবে না।