তৃতীয় দিন থেকে লাশ উদ্ধার করা বাদ। কেবল জীবিত মালিকদের অনুসন্ধান। ধ্বসে পড়া কংক্রীটের ফাকে ফাকে অসংখ্য লাশের অস্তিত্ব। ধ্বসে পড়া ভবনের বাইরে দামী গাড়ি নিয়ে কোটিপতি মালিকদের আত্মীয় স্বজনের উৎকন্ঠিত অবস্থান। উদ্ধারকাজের ধীর গতি, অপ্রতুল যন্ত্রপাতি, সমন্বয় হীনতা ইত্যাদি দেখে বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠা। কোটিপতি মালিকদের কোটিপতি আত্মীয় স্বজনের উপর পুলিশের লাঠি চার্জ, রাবার বুলেট, টিয়ার গ্যাস। আর্মি কর্তৃক ঘাড় ধরে ধরে অনেক কে দুরে সরিয়ে দেয়া। পঞ্চম দিনের মাথায় ভারী যন্ত্রপাতি ব্যাবহার। ভেতরে তখনও জীবিত মানুষ থাকার অভিযোগ। সাবধানে কাজের আশ্বাস।
তার আগে কয়েকটি আবেগ ঘন উদ্ধার অভিযানের লাইভ টেলিকাষ্ট। দুই একজনকে উদ্ধার করার আপ্রাণ আন্তরিক চেষ্টার লাইভ দৃশ্য দেখে আমাদের মুগ্ধ হয়ে যাওয়া, অসংখ্য মালিককে সময় মতো উদ্ধার করার যথাযথ চেষ্টা না করা ও উদ্ধার কাজে রাষ্ট্রীয় অবহেলাকে ভুলে যাওয়া। আল্লাহর ওয়াস্তে আড়াই হাজার মালিক উদ্ধার হওয়ার কাহিনী দিয়ে অন্য দুই/তিন হাজার কোটিপতি মালিক উদ্ধার না হওয়ার নির্মমতা কে আড়াল করা, মানবিকতার ক্রেডিট নেয়া। ক্রেন, বুলডোজার দিয়ে কাজ শুরুর আগে স্বেচ্ছাসেবক, সাংবাদিক সবাইকে সরিয়ে দেয়া। ভারী যন্ত্র দিয়ে কাজ শুরুর দুই দিন পরও দেড়/দুই হাজার কোটিপতি মালিকের কোন খোজ না পাওয়া, লাশ উদ্ধার না হওয়া। বাইরে নিখোজ কোটিপতি মালিকদের বিক্ষুব্ধ কোটিপতি আত্মীয় স্বজনের উপর পুলিশের নির্মম লাঠি চার্জ……….
গার্মেন্টস মালিকদের নিয়ে উপরের কল্পিত দৃশ্যপট যতটা অবাস্তব, শ্রমিকদের ক্ষেত্রে ঠিক ততটাই বাস্তব। বিজিএমইএ ভবনের বদলে রানা প্লাজা এবং মালিকের বদলে শ্রমিক শব্দটি বসিয়ে নিলেই উপরের কল্পনাটুকু নির্মম বাস্তব হয়ে উঠে।
ছবি: রানা প্লাজায় উদ্ধার তৎপরতার মধ্যে বিক্ষোভরত হাজার খানেক মানুষকে লাঠিপেটা করে ছত্রভঙ্গ করে দিয়েছে পুলিশ। বিডিনিউজ২৪, ৩০ এপ্রিল ২০১৩।
ছবি: ধ্বংসস্তূপ সরাতে ভারী যন্ত্রপাতি ব্যবহার শুরুর ২০ ঘণ্টায়ও লাশ না পেয়ে রানা প্লাজার কাছে বিক্ষোভ শুরু করেছে নিখোঁজদের স্বজনরা। উদ্ধার অভিযানের নেতৃত্বে থাকা সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে স্লোগানও দিচ্ছে তারা। বিডিনিউজ২৪, ২৯ এপ্রিল ২০১৩।
এক বছর আগে ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল রানাপ্লাজা ধ্বসের পর রানাপ্লাজাকে কেন্দ্র করে ঠিক এমনই দৃশ্যের অবতারণা হয়েছিলো। ঘটনার একদিন আগেই ভবনটিতে ফাটল দেখা দিয়েছিলো, সাভার উপজেলার ইউএনও কবির হোসেন ভবনটির তিন তালার গার্মেন্টস কারখানার দেয়ালের ফাটল পরিদর্শনও করেছিলেন। ভবনের মালিক যুবলীগ নেতা সোহেল রানা গণমাধ্যমে বলেছিলেন: “সামান্য একটু প্লাস্টার খুলে পড়েছে।এটা তেমন কিছু নয়” । ইউএনও সাহেবও তাল মিলিয়ে সাংবাদিকদের বলেছিলেন: “ভবনটি ভেঙে পড়ার কোনো কারণ নেই।” রানা প্লাজার প্রথম ও দ্বিতীয় তলায় ব্যাংক, অফিস ও দোকান ছিল। তৃতীয় থেকে সপ্তম তলা পর্যন্ত গার্মেন্টস কারখানায় ৫ থেকে ৬ হাজার শ্রমিক কাজ করতেন। প্রশাসন জানতো, ভবনের মালিক জানতো, গার্মেন্টস এর মালিকরাও জানতো কিন্তু কি নিদারুণ অবহেলায় ভবনের হাজার হাজার গার্মেন্টস শ্রমিক, এবং অফিস ও বিপনী বিতানের কর্মকতা- কর্মচারীদের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলা হলো যার পরিণতিতে ভবন ধ্বসে পড়ল, সহশ্রাধিক শ্রমিক খুন হলেন, হাত পা ভেঙে পঙ্গু জীবনের অভিশাপ নামলো হাজারো শ্রমিকের জীবনে।রানা প্লাজার সেই খসে পড়া প্লাস্টারের মতোই এদেশের সাধারণ মানুষ, শ্রমিক, কর্মচারীর জীবন ‘মূল্যহীন’, ‘তেমন কিছু না’!
২. রানা প্লাজা ধ্বসের ১৭ দিন পর ধ্বংসস্তুপ থেকে উদ্ধার হয়েছিলো আটকে পরা শ্রমিক রেশমা। ১৭ দিন ধরে রেশমার এই বেচে থাকার লড়াই ও উদ্ধার যেমন ভীষণ আনন্দজাগানিয়া তেমন ভীষণ আফসোসেরও ব্যাপার ছিল। আফসোস ভীষণ, কারণ, আরো অসংখ্য রেশমা ভবনের পেছন দিকটা থেকে জীবিত উদ্ধার হতে পারতো যদি, পেছন দিকটাতে সরকারি বাহিনী সময় মতো উদ্ধার তৎপরতা চালাতো।
ভবনের পেছন দিকের সিড়ি দিয়েই মূলত শ্রমিকরা উঠা নামা করত। ফলে বেশির ভাগ শ্রমিক ঐ দিকটাতেই আটকা পড়েছিল। কিন্তু অনেক বলে কয়ে, মানুষের অনেক ক্ষোভ বিক্ষোভ দেখিয়েও কোন বাহিনীকে রাজী করানো যায়নি পেছন দিকে উদ্ধার তৎপরতা চালাতে। যদি বিভিন্ন ভাবে চেষ্টা করে, নানান বিশেষজ্ঞ মতামত নিয়েও কোন কাজ না হতো তাহলে হয়তো এই আফসোসটা থাকতো না। কিন্তু শ্রমিকরা এলিট শ্রেণীর নন এবং তাদের আত্মীয় স্বজনও কেউ এলিট শ্রেণীর নন যে তাদের চাপে এইটুকু চেষ্টা অন্তত হবে। ফলে পেছন দিক থেকেই সবচেয়ে বেশি লাশ উদ্ধার হয়েছে ... কিংবা হয় নাই। প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্যের শিক্ষক মাতলুবা খান এ বিষয়ে লিখেছেন: "ভবনের পেছনের অংশে দুই ফ্লোরের মাঝের উচ্চতা অন্যান্য অংশের তুলনায় বেশি। যেকোনো দুর্যোগে মানুষের স্বাভাবিক প্রবণতা থাকে সিঁড়ির কাছে পৌঁছানো, যা ভবনের পেছনের অংশে অবস্থিত। এর থেকে ধারণা করা যায়, সেই অংশে অনেকে আটকা পড়ে ছিলেন। এই ধ্বংসস্তূপের কোথাও যদি একটুখানি ফাঁকা জায়গা থাকে, সেখানটাতেই জীবিতের সন্ধান পাওয়ার সম্ভাবনা ছিল। অথচ সেই অংশটাতে কোনোভাবে উদ্ধারকাজ করা সম্ভব হয়নি। "
ছবি:ধ্বংসস্তুপের পেছন দিকে সাধারণ মানুষের উদ্ধার তৎপরতা, ২৪ এপ্রিল ২০১৩।
৩. রানা প্লাজা ধ্বসের প্রায় আট মাস পরের একদিনের ঘটনা। ঘটনা স্থল রানা প্লাজার ধ্বংস স্তুপের পেছন দিক। খুব যত্নের সাথে একটা একটা করে হাড় ব্যাগে ভরছিলেন এক বৃদ্ধা। তার চোখে জল। পুলিশ তাড়া দিচ্ছে। তাদের ডিউটি আছে। কোন এক জজ সাহেবকে নাকি এসকোর্ট করতে হবে। একটু পর পর ফোন আসছে। একটা একটা করে হাড় গুনে গুনে সিজার লিস্ট বা জব্দ তালিকা তৈরী করার সময় নাই। কিন্তু বৃদ্ধার কোন তাড়া নেই, তিনি ধীরে ধীরে গুনে গুনে হাড়গুলো ব্যাগে ভরছেন। হয়তো এই হাড়গুলো তার মেয়ে নূরজাহানের। ছোট ছোট দাতের চোয়াল, পাজরের হাড়, মেরুদন্ডের কশেরুকা, হাত পায়ের হাড় – সব মিলে এক জায়গা থেকেই পাওয়া গেছে ৫২টা হাড়। রানা প্লাজার ধ্বংস স্তুপ যে পুকুরে ডাম্প করা হয়েছে, সেই পুকুরের কিনারার দিকেই পাওয়া গেছে হাড়গুলো।
ছবি: রানাপ্লাজার ধ্বংসস্তুপের পেছন থেকে হাড়-কংকাল উদ্ধার,২৮ ডিসেম্বর ২০১৩।
নূরজাহান রানা প্লাজার একটা গার্মেন্টস এ কাজ করতো। আট মাস হয়ে গেলেও মেয়েটার কোন হদিস নেই। এতদিন পরেও রানা প্লাজার ধ্বংসস্তুপ থেকে একের পর এক হাড় পাওয়ার ঘটনা। তার বিশ্বাস এখানেই কোথাও পাওয়া যাবে তার মেয়ের হাড়-গোড়। পুলিশদেরকে তাই বার বার অনুরোধ করছেন- যেন প্রতিটা হাড়ের ডিএনএ টেস্ট করা হয়। সেইদিন উদ্ধার হওয়া মোট ১০২ টা হাড় তিনি নিজ হাতে দুই ব্যাগে ভরে পুলিশের গাড়িতে তুলে দিলেন।
স্থানীয় টোকাইরা লোহার টুকরা, ভাঙা যন্ত্রপাতি ইত্যাদি খুজতে এসে প্রথমে এই হাড় খুলি কংকালের সন্ধান পায়। এরপর নিয়মিতই অল্প অল্প করে হাড় উদ্ধার হয়েছে, সাংবাদিকদের খবর দেয়া হলে তারা এসে সংবাদ নিয়ে গেছে আর পুলিশ এসে হাড় নিয়ে গেছে থানায় । কিন্তু সেই খবর পত্রিকার প্রথম পাতায় ছাপা হয়নি, দেশে তেমন আলোড়নও ওঠেনি-যেন উদ্ধার অভিযান সমাপ্ত হওয়ার আট মাস পরও রানা প্লাজার ধ্বংস স্তুপ থেকে মাঝে মাঝে নিখোজ শ্রমিকের হাড়-খুলি-কংকাল উদ্ধার হওয়া খুব স্বাভাবিক একটা ঘটনা!
৪. রানপ্লাজা ধ্বসের পর, বাতাসে লাশের গন্ধ মিলায়ে যাওয়ার আগেই,এমনকি আনুষ্ঠানিক ভাবে উদ্ধার তৎপরতা সমাপ্ত হওয়ার আগেই শ্রমিক শোষণকারী মালিক শ্রেণীর সংগঠন বিজিএমইএ মুখ মুছে ফেলেছে, চোখ উল্টে দিয়েছে। চিকিৎসা, ক্ষতিপূরণ, পূনর্বাসনের ব্যাবস্থা তো দূরের কথা স্রেফ পাওনা বকেয়া মজুরী র জন্যই রাস্তায় নামতে হয়েছিলো রানা প্লাজার গার্মেন্টস এর ক্ষতিগ্রস্থ, আহত, কর্মসংস্থান হারনো অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মুখোমুখী দাড়ানো শ্রমিকদের।মালিক শ্রেণীর প্রতিনিধিত্বকারী রাষ্ট্রও দ্রুত হাত গুটিয়ে নিয়েছে। শ্রমিকরা হাসপাতালে ফোলা পেট নিয়ে ডায়ালাইসিসের অভাবে কাতরিয়েছেন, ইনফেকশান হয়ে ব্লিডিং হয়ে মরেছেন, যন্ত্রণা আর ট্রমা সইতে না পেরে অনেকে মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছেন , এমনকি কয়েকদিন আগে সালমা নামের এক আহত শ্রমিক যথাযথ চিকিৎসার অভাবে যন্ত্রণা সইতে না পেরে আত্মহত্যা করেছেন।
ঘটনার পরপর মালিক শ্রেণী সহ সরকারি বেসরকারি দেশী বিদেশী বিভিন্ন পক্ষ থেকে কোটি কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসনের প্রতিশ্রুতি দেয়া হলেও তার খুব সামান্যই বাস্তবায়িত হয়েছে বা শ্রমিকদের কাছে পৌছেছে। বিচ্ছিন্ন ভাবে কোন কোন শ্রমিকের কাছে দান/সহায়তার আকারে কিছু অর্থ পৌছলেও এখন পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় ভাবে রানা প্লাজার নিহত ও আহত শ্রমিকদের জন্য কোন ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসনের কোন সুনির্দিষ্ট নীতিমালা ঘোষিতই হয়নি। অর্থ-কড়ি কিংবা অন্যকোন কিছু যদিও কোন অর্থেই জীবনের ক্ষতিপূরণ হতে পারেনা- তবু শ্রেণী বিভক্ত সমাজে রাষ্ট্র কোন শ্রেণীকে কেমন দৃষ্টিতে দেখে তা নগ্নভাবে ফুটে ওঠে জীবণের ক্ষতিপূরণ প্রশ্নে রাষ্ট্রীয় তৎপরতা/আগ্রহ থাকা না থাকার মধ্যে।
বিডিআর বিদ্রোহের পর নিহত সেনা কর্মকর্তাদের ক্ষতিপূরণের পরিমাণ, ধরণ ও পরিবারগুলোকে পুনর্বাসন কার্যক্রমের সাথে গার্মেন্টস শ্রমিক আগুণে পুড়ে কিংবা ভবন ধ্বসে নিহত হওয়ার পর ক্ষতিপূরণের পরিমাণ ও ধরণ মিলিয়ে দেখলে এক্ষেত্রে শ্রেণী বৈষম্য খুব স্পষ্ট হয়ে উঠে। নিহত সেনা কর্মকর্তাদের পরিবারের জন্য এককালীন ৫০ থেকে ৯০ লাখ টাকা, ১০ বছর পর্যন্ত মাসে মাসে ৪০ হাজার টাকা, পরিবারের আবাসনের ব্যাবস্থা, সন্তানদের শিক্ষার দ্বায়িত্ব, গোটা পরিবারের চিকিৎসার ব্যাবস্থা ইত্যাদি সরকারি ও বেসরকারি তরফ থেকে করা হয়েছে। কিন্তু এই যে এতো এতো শ্রমিক নিয়মিত মরছে তাদের জন্য কি করা হয়েছে? তারা কি ক্ষতিপূরণ পেয়েছে, রাষ্ট্র ও মালিকদের তরফ থেকে কি শ্রমিক ও তার পরিবারের দ্বায়িত্ব নেয়া হয়েছে? তাদের কর্মসংস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসার দ্বায়িত্ব নেয়া হয়েছে? বলাই বাহুল্য, আর সব গার্মেন্টস হত্যাকান্ডের মতো রানাপ্লাজার ঘটনার ক্ষেত্রেও এই প্রশ্নগুলোর উত্তর আজও না বোধক।
এটা নিশ্চিত যে, শ্রেণী বিভক্ত সমাজে এলিট সামরিক বাহিনী ও রফতানি মুখী ‘শ্রম মেশিন’ গার্মেন্টস শ্রমিকদেরকে রাষ্ট্র এক ভাবে ট্রিট করবে না, করার কথাও না। কিন্তু তাই বলে এত বৈষম্য! মাসে মাসে ৪০ হাজার টাকা মাসোহারা না হোক, অন্তত ৮-১০ হাজার টাকা করে দেয়া হোক, এককালীন ৯০ লাখ টাকা করে না হোক শ্রমিকদের তোলা দাবী অনুযায়ী একজীবনের আয়ের সম পরিমাণ অন্তত: ৩০ লাখ টাকা করে তো দিতে হবে, সিএমইএচ না হোক পরিবারের সবার চিকিৎসার জন্য সরকারি হাসপাতাল গুলোতে ব্যাবস্থা হোক, ডিওএইচএস এ না হোক শ্রমিক কলোনি বানিয়ে তাদের আবাসনের ব্যাবস্থা হোক, নর্থ সাউথ ইস্ট ওয়েষ্ট এ না হোক সরকারি স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে শ্রমিকের সন্তান, ভাইবোনদের পড়াশোনার ব্যাবস্থা তো হতে পারতো!
৫. মালিকদের বিজিএমএইএ ভবন কিংবা বসুন্ধরা সিটি বা রাইফেল স্কয়ারের মতো শপিং কমপ্লেক্স যদি ধ্বসে পড়তো এবং ধ্বসে পড়ার এতদিন পরেও যদি নিখোজ মধ্যবিত্ত উচ্চবিত্ত এলিটশ্রেণীর মানুষদের হাড়গোড় এভাবে টোকাইদের হাতে উদ্ধার হতো কিংবা বিডিআর বিদ্রোহের পর নিহত আর্মি অফিসারদের হাড়গোড় যদি এভাবে এদো পুকুরের কিনারা থেকে উদ্ধার হতো তাহলে কি ঘটতো! কি ঘটতো যদি তাদেরকে ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসনের কোন ব্যবস্থাই না করা হতো! স্রেফ শ্রমিক বলেই তাদের হাড় গোড় এভাবে বুলডোজার দিয়ে চাপা দেয়া ধ্বংসস্তুপের মধ্যে পড়ে থাকা ‘স্বাভাবিক’ ঘটনা। শ্রমিক বলেই এর জন্য উদ্ধার অভিযান পরিচালনাকারী সরকারি কোন বাহিনী বা কর্তৃপক্ষকে কোন জবাব দিহি করতে হয় নি। নিখোজ শ্রমিকের আত্মীয় স্বজনের ক্ষমতা কাঠামোর সাথে কোন যোগাযোগ নেই বলে, সুশিল সমাজের কারো আত্মীয় স্বজন তারা নন বলে, মধ্যবিত্ত-উচ্চবিত্ত সমাজের কেউ নন বলেই তাদের হাড়গোড় এভাবে ধ্বংসস্তুপের মতো পড়ে থাকতে পারে। এক বার দুই বার না, একটা দুইটা না, কয়েক দিন ধরে কয়েক শত হাড় উদ্ধার হওয়ার পরও তাই নতুন করে উদ্ধার কর্মকান্ড পরিচালনার নিখোজ শ্রমিকের দেহাবশেষ অনুসন্ধানের কোন কথা শোনা যায়নি, এই বিষয়ে সমাজের মধ্যে তেমন কোন প্রতিক্রিয়াও দেখা যায়নি না, এমনকি যে মানুষেরা রানা প্লাজা ধ্বসের পর পর উদ্ধার তৎপরতা সহ নানান ধরণের কাজে যুক্ত হয়েছিলেন তাদেরও যেন এ বিষয়ে আর কোন দায় নেই! শ্রমিক বলেই, তাদের হত্যাকারীদের আজো কোন সাজা হয় নি, জনবিক্ষোভ সামাল দেয়ার জন্য স্রেফ লোক দেখানো গ্রেফতার করা হয়েছে এবং সময় ক্ষেপন করে এখন জামিন দেয়া ও ছেড়ে দেয়ার তৎপরতা চলছে। শ্রমিক বলেই ক্ষতিপূরণ পাওয়াটা আজো তাদের অধিকার নয়- যেন মালিক শ্রেণীর দেয়া লিল্লাহ বা ভিক্ষা!
রানা প্লাজার ধ্বংস স্তুপের সামনে দাড়ালে, এতদিন পর বিচ্ছিন্ন ভাবে উদ্ধার হওয়া খুলি-কংকালের দিকে তাকালে মনে হয় এটা যেন কাটাতার ঘেরা কোন বধ্যভূমি। যেন কোন হানাদার বাহিনী গণহত্যা চালিয়ে গণকবর দিয়েছে শত শত মানুষকে। অথচ রানাপ্লাজার ধ্বংসযজ্ঞ কোন বিদেশী হানাদারের হাতে ঘটেনি, ঘটেছে দেশীয় শাসক-পুজিপতির হাতেই। শ্রমিক শ্রেণীর সাথে পুজিপতি শ্রেণীর যে নিরন্তর শ্রেণী যুদ্ধ চলে, শ্রমিকের শ্রমের ফসল ব্যাক্তিগত মুনফা রুপে দখলের যে লড়াই চলে, সেই শ্রেণী যুদ্ধের ধ্বংস যজ্ঞেরই একটা নির্মম দৃষ্টান্ত রানা প্লাজার এই ধ্বংসস্তুপ। রানা প্লাজার এই ধ্বংসস্তুপ তাই শ্রেণী যুদ্ধের এক বধ্যভূমি যেখানে এসে সভ্যতা, মানবিকতা, মানবাধিকার ইত্যাদি শ্রমিকের হাড়-কংকালের মতোই এদো পুকুরের তলায় পচতে থাকে।