সিপাহী বিপ্লবের দিন দুয়েক আগে- পুরো ক্যান্টনমেন্ট ছেয়ে যায় লিফলেট এ। বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার কর্মীরা ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের সর্বত্রই লিফলেট ছড়িয়ে দেন। লিফলেটের ভাষা ছিল:
"সৈনিক ভাইয়েরা,
আমরা আর ধনিক শ্রেণীর হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হইতে চাই না। নিগৃহীত, অধিকারবঞ্চিত সিপাইরা আর কামানের খোরাক হইবে না। আসুন আমরা একটি অভ্যুত্থান ঘটাই। আমাদের এই অভ্যুত্থান শুধুমাত্র নেতৃত্বের পরিবর্তন করিবার জন্য হইবে না বরং এই অভ্যুত্থান হইবে সমাজের দরিদ্র শ্রেণীর স্বার্থরক্ষার জন্য। এই অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়া আমরা ঔপনিবেশিক আমলের রীতিনীতি বদলাইয়া ফেলিয়া সশস্ত্র বাহিনীকে জনগণের স্বার্থরক্ষাকারী একটি বাহিনীতে পরিণত করিব। আমরা রাজবন্দিদের মুক্ত করিব, দুর্নীতিবাজদের অবৈধ সম্পদ বাজেয়াপ্ত করিব। মনে রাখিবেন এখন সিপাই আর জনতার ভাগ্য এক। তাই সিপাই জনতার বিপ্লবের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করিতে হইবে। সিপাই সিপাই ভাই ভাই, সুতরাং সিপাইদের ঐক্যবদ্ধভাবে অফিসারদের এই ক্ষমতার লড়াইকে রুখিয়া দাঁড়াইতে হইব. যদি অফিসাররা নির্দেশ দেয় আরেক সৈনিক ভায়ের বিরুদ্ধে বন্দুক ধরিবার তাহা হইলে আপনারা বন্দুক ধরিবেন না। আসুন ঐক্যবদ্ধভাবে বিদ্রোহ করি"।
- কর্ণেল তাহেরের উপস্থিতিতে লিফলেট তৈরী করেন ট্যাঙ্ক রেজিমেন্টের হাবিলদার বারী এবং নায়েক সুবেদার জালাল। পরে অবশ্য জাসদ কিছু ঘষামাজা করে দেয়।
এমনিতেই সৈনিকরা ফুসছিল। এই লিফলেট পেয়ে তারা আরো উত্তেজিত হয়ে উঠে। তাহেরও যেন এর জন্য পুরো প্রস্তুত ছিল না। জাসদের নেতৃস্থানীয় বৈঠকে জানান- ৭ তারিখেই বিপ্লব সংগঠিত করতে হবে- নাহলে সৈনিকরা নিজেরাই একটি অভ্যুত্থান ঘটিয়ে ফেলতে পারে। জাসদের অনেক নেতাই আপত্তি তুলেন প্রস্তুতির ঘাটতির কথা জানিয়ে। এমনকি ৯ তারিখের পূর্বঘোষিত হরতালের পরে বিপ্লব সংঘটনের প্রস্তাব আসে। কিন্তু, তাহের জানতেন অতটা সময় পাওয়া যাবে না। সৈনিকরা রীতিমত জ্বলছে। পার্টির নেতারা মত দিলেন।
বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার বৈঠকে বসেন তাহের। এলিফ্যান্ট রোডস্থ বাসায় কর্ণেল তাহের এক এক করে অভ্যুত্থানের নির্দিষ্ট কর্মসূচি বর্ণনা করেন সিপাইদের কাছে:
১। রাত বারোটায় ফাঁকা গুলি ছুড়ে বিপ্লবের সূচনা করা হবে।
২। জীবন বাঁচানোর অনিবার্য প্রয়োজন ছাড়া কাউকে গুলি করা যাবে না।
৩। খালেদ মোশাররফকে গ্রেপ্তার করা হবে।
৪। জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করা হবে এবং নিয়ে আসা হবে এলিফ্যান্ট রোডের বাসায়।
৫। সৈনিকরা বিপ্লবের পক্ষে শ্লোগান দিয়ে ট্রাকে ট্রাকে শহর প্রদক্ষিণ করবে।
৬। প্রতিটি ট্রাকে অন্তত একজন সৈনিক সংস্থার লোক থাকবে।
৭। ৭ তারিখ সকালে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সৈনিকদের সমাবেশ হবে।
৮। বিপ্লবের পর বেতার টেলিভিশনে নেতাদের বক্তব্য প্রচার করা হবে।
৯। কোনো লুটপাটে অংশগ্রহণ করলে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।
১০। বিপ্লবের পর বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার ইউনিট এবং নেতাদের নিয়ে বিপ্লবী পরিষদ বা রেভ্যুলেশন কমাণ্ড কাউন্সিল গঠন করা হবে।
১১। সামরিক অফিসারদের বিপ্লব সমর্থন করার আহবান জানানো হবে। যারা করবে না তাদের গ্রেপ্তার করা হবে।
১২। কর্ণেল তাহের বিপ্লবের সর্বাধিনায়ক হিসাবে দায়িত্ব পালন করবেন।
যে ১২ দফা দাবি বাস্তবায়নের জন্য বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীসমূহের সাধারণ সৈনিকরা ৭ নভেম্বর অভ্যুথানে সামিল হয়েছিল, সে দাবিগুলো ছিল:
১। আমাদের বিপ্লব নেতা বদলের জন্য নয়। এই বিপ্লব গরিব শ্রেণীর স্বার্থের জন্য। এতোদিন আমরা ছিলাম ধনীদের বাহিনী। ধনীরা তাদের স্বার্থে আমাদের ব্যবহার করেছে, ১৫ আগস্ট তার প্রমাণ। তাই এবার আমরা ধনীদের দ্বারা বা ধনীদের স্বার্থে অভ্যুথান করিনি। আমরা বিপ্লব করেছি। আমরা জনতার সঙ্গে একত্র হয়েই বিপ্লবে নেমেছি। আমরা জনতার সঙ্গে থাকতে চাই। আজ থেকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী হবে গরিব শ্রেনীর স্বার্থরক্ষার একটি গণবাহিনী।
২। অবিলম্বে রাজবন্দিদের মুক্তি দিতে হবে।
৩। রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে আলোচনা না করে কোনো সিদ্ধান্ত দেওয়া যাবে না। অফিসার ও জোয়ানদের ভেদাভেদ দূর করতে হবে।
৪। অফিসারদের আলাদাভাবে নিযুক্ত না করে সামরিক শিক্ষা ও যোগ্যতা অনুযায়ী সামরিক বাহিনী থেকেই পদমর্যদা নির্ণয় করতে হবে।
৫। অফিসার ও জোয়ানদের একই রেশন ও একই রকম থাকার ব্যবস্খা করতে হবে।
৬। অফিসারদের জন্য আর্মির কোনো জোয়ানকে ব্যাটম্যান হিসেবে নিযুক্ত করা চলবে না।
৭। মুক্তিযুদ্ধ, গণঅভ্যুথান এবং আজকের বিপ্লবে যে সমস্ত দেশপ্রেমিক ভাই শহীদ হয়েছেন তাদের পরিবারের জন্য উপযুক্ত ব্যবস্খা করতে হবে।
৮। ব্রিটিশ আমলের আইন কানুন বদলাতে হবে।
৯। সমস্ত দুর্নীতিবাজদের সম্পত্তিবাজেয়াপ্ত করতে হবে। বিদেশে যারা টাকা জমিয়েছে তাদের টাকা বাংলাদেশে ফেরত আনতে হবে।
১০। যেসমস্ত সামরিক অফিসার ও জোয়ানদের বিদেশে পাঠানো হয়েছে তাদের দেশে ফেরত আনার ব্যবস্খা করতে হবে।
১১। জোয়ানদের বেতন ৭ম গ্রেড করতে হবে এবং ফ্যামিলি একোমডেশন ফিন্স দিতে হবে।
১২। পাকিস্তান ফেরত সামরিক বাহিনীর লোকদের ১৮ মাসের বেতন দিতে হবে।
- কর্নেল আবু তাহের বা জাসদ এই ১২ দফা দাবিনামাও প্রণয়ন করেনি। সৈনিক সংস্খা তা তৈরি করেছিলো। জাসদ তাতে সামান্যই সম্পাদনা করেছে।
সৈনিকরা বিপ্লবের কাজটি সফলভাবে সমাপ্ত করেন, কিন্তু শেষে দেখা গেল আসলেই জাসদের প্রস্তুতির ভালো ঘাটতি। তার মধ্যে যে জিয়াউর রহমানকে বিশ্বাস করেছিলেন কর্ণেল তাহের- দেখা গেল সেই জিয়া বিশ্বাসঘাতকতা করলেন; ধীরে ধীরে প্রেক্ষাপট ঘুরে গেল- জিয়া নিজের অবস্থানকে শক্তিশালী করে ফেলেন।
বাংলাদেশ আর্মি থেকে আর ব্রিটিশ প্রেতাত্মাকে দূর করা সম্ভব হলো না।
কর্ণেল তাহের আজো প্রাসঙ্গিক ১: কর্ণেল তাহেরের পিপলস আর্মি ( Click This Link)
তথ্যসূত্রঃ
১। ক্রাচের কর্ণেল, শাহাদুজ্জামান
২। http://www.col-taher.com/shephi_biplob.html