১ম পর্ব
Click This Link
২য় পর্ব
Click This Link
পুরুষ নির্যাতন কাহিনী - ৩.
সন তারিখ ঠিকই মনে আছে। বলবো না। তখন আমি থাকতাম টঙ্গীতে। দিনটা ছিল মার্চ মাসের এক রাত। প্রায় সাড়ে দশটা। বন্ধুটি আসল। ঘনিষ্ট বন্ধু। তার মায়ের সাথে ছিল আমার মায়ের বন্ধুত্ব। সেই পরিচয়ে আমাদের বন্ধু হওয়া। আর এ কারণে মাদরাসায় এক সাথে লেখা পড়া করা। আমি বরিশালে, সেও বরিশালে। আমি পড়াশুনার জন্য চট্টগ্রামে, সেও সেখানে। আশ্চর্য এক মমতাবোধ। কেউ কাউকে ছেড়ে থাকতে রাজী না। তারপরও ছাড়তে হয়েছিল। সে ১৯৮৭ সালের কথা। আমরা ছয় জন বন্ধু মিলে পাসপোর্ট করলাম। আফগানিস্তানে জিহাদ করতে যাবো হানাদার রুশদের বিরুদ্ধে। পরিবারের কাউকে জানাবো না। হঠাত উধাও হয়ে যাবো একদিন। পাঁচ জন গেল ঠিকই, পিছনে রয়ে গেলাম আমি। আব্বা টের পেয়ে গিয়েছিল পালিয়ে জিহাদে যাবার পরিকল্পনা। যে অফিসার পাসপোর্ট করে দিয়েছিল, সে কথা প্রসঙ্গে একদিন আব্বাকে খবর দিল পাসপোর্টের। আর যাওয়া হয়নি।
আফগানিস্তান মুক্ত হওয়ার পর বন্ধুটি ফিরে আসল। তার নামের একটি অংশ শহীদ। আমি তাকে বলতাম, আপনি নামে শহীদ আর কামে গাজী। এমন ভাগ্য ক জনার? যাক, তার কথা বলার জন্য এ লেখা নয়।
এসেছে, সাথে কিছু নেই। পরনে শুধু পাজামা আর পানজাবী। লক্ষ করলাম, পায়ে জুতো নেই। কোন কিছু একটা লুকাতে চাচ্ছে। আমি লুকাতে দিলাম। কোন প্রশ্ন না করে, বললাম, এশার নামাজ পড়েছেন? অজু করে আগে নামাজ পড়ুন। সে বলল, আমাকে রাতে থাকতে দিতে হবে। আমি বললাম, শুধু থাকতে নয়, খেতেও দেব। ভোরে নাশতাও।
রাতে খাবার টেবিলে বসে বললাম, আসলে কী হয়েছে? কোথাও ধাওয়া খেয়ে এসেছেন মনে হয়? বলল, হ্যা, এরকমই। বাবুর্চির দিকে ইঙ্গিত করে বলল, ওর যাওয়ার পর ঘটনা বলব।
খাবার শেষ করে বাবুর্চি চলে গেল। সে বলা শুরু করল কাহিনী :
এসেছিলাম বোর্ড বাজারে একটি অপারেশনে। অপারেশন ব্যর্থ। দু জন ধরা পড়েছে। দু জন পালাতে পেরেছে।
বললাম, কী অপারেশন?
বলতে থাকল, আপনি তো জালাল ভাইকে চিনতেন। সে আমাদের সাথে পাকিস্তান গিয়েছিল। পড়াশুনা বাদ দিয়ে সেখানে সে একটি পোশাক কারখানায় চাকুরী নিল। এক বছর চাকুরী করার পর ছুটিতে দেশে এসে তার এক আত্নীয়ের মাধ্যমে বোর্ড বাজারে একটি মেয়েকে বিয়ে করল। একমাস বউয়ের সাথে কাটিয়ে আবার পাকিস্তানে। ওখানে চাকুরী করে আর মাসে মাসে বউয়ের কাছে টাকা পাঠায়। বউ তাকে বলেছে, বোর্ড বাজারে তোমার নামে পাঁচ কাঠা জমি রাখবো। বেশী করে টাকা পাঠাও। সে টাকা পাঠালো চার বছরে পাঁচ লাখ। চার বছর পর একেবারে দেশে চলে আসল। এসে দেখে, বউ অন্য রকম। স্বামীর সাথে কথা বলতে চায় না। তার টাকা দিয়ে জমি কিনেছে ঠিকই। কিন্তু নিজের নামে। হানীফা বেগমের নামে জমি। শ্বশুর শাশুড়ি তাকে বলল, হানীফা তোমার সাথে সংসার করবে না। ডিভোর্স দাও।
সে বলল, তার সাথে আমাকে একান্তে কথা বলতে দিন। কিন্তু তারা হানীফাকে একান্তে কথা বলতে দেবে না।
জালাল ভাই এ ব্যাপারে আমাদের সাহায্য চাইল। সে বলল, হানীফাকে এনে যদি আমার কাছে একটি দিন রাখা যায় তাহলে ও ঠিক হয়ে যাবে।
আমরা পরিকল্পনা নিলাম, একটি অপারেশনের। চার জন ঠিক হলাম। দু জন আফগান ফেরত যোদ্ধা আর মাস্তানী স্বভাবের দুটো ছেলে। ওরা দশম শ্রেণীতে পড়ে। এ রকম কাজে ওদের আগ্রহ আছে। সারা বছর সিনেমাতে মাস্তানী দেখে চেয়ে চেয়ে, এখন আমল করতে চায়। একটি মাইক্রো ভাড়া করা হল। ড্রাইভারকে অবহিত করা হল বিষয়টি।
পরিকল্পনা মাফিক মাইক্রো নিয়ে আমরা বরিশাল থেকে ঢাকায়। সন্ধার পর আমরা বোর্ড বাজারে পৌছে গেলাম। পূর্ব পরিকল্পনা মত রুবেল ও জুয়েলকে দায়িত্ব দেয়া হল হানীফার মুখ চেপে কোলে করে গাড়ীতে নিয়ে আসবে।
ওরা ঘরে ঢুকল। রুবেল ঢুকেই হানীফার মাকে হানীফা মনে করে মুখ চেপে ধরল। জুয়েল বলে উঠল, আরে ওটা না, ওটা মায়োই!
অন্য রূমে বসা ছিল হানীফা। সে উকি দিয়ে দেখা মাত্রই চিৎকার দিয়ে উঠল, ডাকাত! ডাকাত!!
আর যায় কোথা! ওরা দুজনে ধরা খেল লোকজনের হাতে। আর বাকী আফগানী যোদ্ধা দু জন পালাতে সক্ষম হল। লোকজন ছোট খাট মার দিল। ওরা বার বার বলে যাচ্ছিল, আমরা ডাকাত নয়, আমরা আমাদের ভাবীকে নিতে এসেছি। পরে পুলিশে সোপর্দ করা হল।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, এভাবে জোর করে কি প্রেম-মহব্বত, ঘর-সংসার করা যায়?
সে বলল, জালাল ভাই বলেছে, তার কাছে আসলে সে ঠিক হয়ে যাবে। এক মাসের দাম্পত্য স্মৃতিগুলো স্মরণ করে সে ঠিক হয়ে যেতে পারে, আমরা মনে করলাম। তাই চেষ্টা করেছি একটি সংসার গড়ার, একটি পরিবার রক্ষার।
এরপর দু বছর চলে গেছে। আমি আর আপডেট জানতে চেষ্টা করিনি। আসলে এমন এক সভ্যতা আমরা অতিক্রম করছি, কেহ কারো খোঁজ-খবর রাখতে চায় না আগের মত। শুধু ঠেকা পড়লে দেখা-সাক্ষাত আর খোঁজ নেয়া। এ সভ্যতা নির্মাণে মোবাইল ফোনের ভূমিকা আছে যথেষ্ট। আমিও কি এর ব্যতিক্রম? সমাজ সেবা করব বলে একটি এনজিওতে যোগ দিয়েছি। এখন তার কাজের ব্যস্ততায় সমাজ সেবা করার একটু সময়ও পাই না। তখন সমাজের অসহায়, বঞ্চিতদের খবর নেয়া তো অনেক দূরের ভাবনা।
একদিন বিকালে ঘর থেকে বের হলাম নদীর তীরে যাবো বলে। ছোটকাল থেকে আমার এ অভ্যাস, আছর থেকে মাগরিব নদীর পারে কাটানো। যখন ঢাকাতে থাকি তখনতো আর নদী পাই না। পেলেও নাকে রূমাল দিয়ে তাড়াতাড়ি অতিক্রম করি। আর বাড়ীতে গেলে কীর্তনখোলা নদীর তীরে যেতে ভুল করি না।
কীর্তনখোলা-কে নদী বলে মনে হয় ভুল করলাম। পন্ডিতদের বলতে শুনেছি, পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, সুরমা, কুশিয়ারা হল নদী। আর আড়িয়াল খাঁ, পায়রা, দামোদর, ধানসিড়ি, বলেশ্বর হল নদ। মনে হয় এ নিয়মে কীর্তনখোলাও নদ।
বাড়ী থেকে নদীর তীরে যেতে সরকারি পথে প্রায় এক কিলোমিটার পথ। আর সোজাসুজি পথে আধা কিলোর কম। হাটতে ছিলাম। দেখি একটি চায়ের দোকানের বাঁশের বেঞ্চিতে জবুথবু হয়ে বসে আছে জালাল ভাই। দেখে বললাম, কি জালাল ভাই কেমন আছেন? বলল, আছি, আল্লায় রাখছে!
আমি যতটা আগ্রহ নিয়ে কুশল জানতে চাই তার যেন কথা বলতে তেমন আগ্রহ নেই। লোকটা তো এমন ছিল না কখনো, ভাবি।
বলল, এক সপ্তাহ আগে জেল থেকে ছাড়া পেলাম। দেড় বছর জেলে ছিলাম।
আমি বললাম, ভাবীকে নিয়ে সমস্যা ছিল শুনেছি, এখন কি অবস্থা?
বলল, তার অবস্থা তো ভালোই। আমার অবস্থা খারাপ। তার দেয়া মামলায় আমি জেল খাটলাম, আর সে এখন অন্যকে বিয়ে করে আমার জমিতে ঘর বেধেছে।
কি মামলা দিয়েছিল?
বলল, নারী নির্যাতন আর যৌতুক দাবী।
আপনি কি যৌতুক দাবী করেছিলেন?
না, যখন দেখলাম, সে আমাকে আর গ্রহণ করছে না, তখন আত্নীয়-স্বজন মারফত চাপ দিয়েছিলাম, আমাকে যেন কিছু টাকা ফেরত দেয়। আর এটাই হল যৌতুক। আমি আমার সব উপার্জন ওর কাছে জমা রেখেছিলাম। এখন আমি আগের মতই নি:স্ব। পাচটি বছর সাথে আরো দুটি বছর একেবারে বেকার।
জালাল ভাইকে সান্তনা দেয়ার ভাষা আমার কাছে ছিল না।
আসলে আমাদের আইন আদালত অধিকাংশ সময় নির্যাতিত, অসহায়দের পক্ষে থাকে না। তারা নিরপেক্ষ। তাই তাদের রায় চলে যায় শক্তির পক্ষে।
আমি বললাম, এখন কি পরিকল্পনা?
বলল, কাফফারা আদায় করবো। যে ভুল করেছি সেই ভুলের কাফফারা।
আমি বললাম, সেটা কি?
বলল, আবার পাকিস্তান যাবো। এবার জিহাদ করবো। আর কামাই করবো না। যখন পাকিস্তানে ছিলাম, তখন সাথী-বন্ধুরা কত বলল, চলো, আফগানিস্তানে কিছুদিন জিহাদ করে আসি। যদি একটি সোভিয়েট সৈন্যকেও খতম করতে পারো তাহলে তা তোমার জীবনের জন্য হবে একটা বড় অর্জন।
সাথীরা সবাই যুদ্ধে গেছে, আমি যাইনি। তাদের বলেছি, আমি সংসারের একমাত্র ছেলে। আমি জিহাদে যেয়ে শেষ হয়ে গেলে আমার পরিবারের অবস্থা কী হবে? আসলে মুখে বলেছি এ কথা, কিন্তু ভিতরের কথা ছিল ভিন্ন। যখনই বন্ধুদের মুখে জিহাদে যাওয়ার ডাক শুনতাম, তখনই হানীফার মায়াবী মুখ, অশ্রু ভেজা চোখ, শুকনো ঠোট, ঘামে ভেজা কপালে লেপ্টে থাকা কেশ চোখের সামনে দেখতে পেতাম। আর ভাবতাম, যারা নতুন বিয়ে করেছে আল্লাহ যদি তাদের জিহাদে যেতে নিষেধ করতেন!
হানীফার মহব্বতে আমি সেদিন বার বার জিহাদ থেকে পালিয়ে থেকেছি। আর হানীফা সব কিছু নিয়ে আমার থেকে পালিয়ে গেল।
আমি তাকে বললাম, জালাল ভাই! আপনি আমার সিনিয়র। মাদরাসা জীবনে আপনি আমার দু ক্লাস উপরে ছিলেন। আপনাকে উপদেশ দিচ্ছি না। কিছু কথা বলতে চাই আপনার চিন্তা-ভাবনায় যোগ করার জন্য।
আপনি অনেক কষ্ট করে পড়াশুনা করেছেন। আমাদের অনেকের মত সোনার চামচ মুখে দিয়ে মাদরাসায় ভর্তি হওয়া আর বের হওয়া আপনার ভাগ্যে ছিল না। আপনাকে দেখতাম, কীর্তনখোলার খেয়া পাড়িয়ে চার মাইল পথ হেটে মাদরাসায় আসতেন। রোদ, বৃষ্টি আর ঘাম এক হয়ে আপনার গায়ের জামা তিলেয় কালো হয়ে থাকত। জোহরের সময় খাবার বিরতিকালে আপনি বয়াতীর দোকানে যেয়ে এক টাকায় দুটো পুরি খেতেন। এটা ছিল সপ্তাহে ছয় দিনেই আপনার দুপুরের খাবার।
এখন জিহাদে যাবেন ভালো কথা। কিন্তু জিহাদে যাবার আগে একটু ভাবুন, নিজেকে প্রশ্ন করুন, আপনি কি জিহাদে যাচ্ছেন আল্লাহ-কে সন্তুষ্ট করার জন্য, না জীবন-যুদ্ধে পরাজিত নিজের জীবনটার বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নিতে? না নিজের হতাশা আর নৈরাশ্যের আগুনে হাওয়া দিতে? যদি দ্বিতীয়টি হয়, তাহলে আপনার জিহাদ বৃথা। আপনি শুনেননি? রাসূল সা. বলেছেন: কেহ জিহাদ করে নিজের বীরত্ব প্রকাশের জন্য, কেহ জিহাদ করে নিজের গৌরব আর মর্যাদায় তাড়িত হয়ে, কেহ জিহাদ করে সম্পদ অর্জনের জন্য। এদের সকলের জিহাদই ব্যর্থ .... ।
কাজেই জিহাদের চিন্তা বাদ দেন। নিরাশ হওয়া ও হতাশাগ্রস্ত হওয়া একটি পাপ। আফগানিস্তান তো এখন মুক্ত। কোথায় জিহাদ করবেন? কাদের বিরুদ্ধে জিহাদ করবেন?
জালাল ভাই মুখ খুললেন, বললেন, আপনি কি বলতে চান এখন জিহাদ করার প্রয়োজনীয়তা শেষ হয়ে গেছে? রাসূল সা. কি বলে যাননি, জিহাদ অব্যাহত থাকবে পৃথিবীর শেষ দিন পর্যন্ত? নিন্দুকের নিন্দা আর তিরস্কারে কোন কাজ হবে না।
কথা আর বাড়লো না তার সাথে। চলে গেলাম তার কাছ থেকে। মনে মনে নিয়ত করলাম, এখন থেকে তার খোঁজ-খবর রাখবো। যদি কোথাও সুযোগ হয়, একটি চাকুরীর ব্যবস্থা করে দেব।
কিন্তু হয়ে ওঠেনি। ঐ যে আমার বড় কৃতিত্ব মানুষকে ভুলে যাওয়া। কত মানুষের সাথে পরিচিত হয়েছি। আর বিদায়ের সময় কত কাউকে জড়িয়ে ধরে কাঁদলাম, মনে থাকবে। ভুলবো না কোন দিন আপনার অকৃত্রিম ভালোবাসা। তখন ইচ্ছে ছাড়াই গড়িয়ে পড়েছে চোখের জল আর বলেছি, যোগাযোগ করব সব সময়। কিন্তু ভুলে যাওয়া হয়েছে খুব সহজে। যোগাযোগের সব ঠিকানা গেছে হারিয়ে। এখন দেখা হলে বলি, কি যেন আপনার নামটা?
এই তো সেদিন যত্ন করে রাখা কার্ডগুলো ব্যগ থেকে বের করলাম। বিশটি কার্ডের মধ্যে ষোল জনকেই চিনি না। অথচ এ কার্ডগুলো নেয়ার সময় আমি কত আন্তরিক ছিলাম। ভাবছিলাম যোগাযোগ করতে আর একটু অলসতা হবে না। অথচ এখন ভুলে গেছি।
এভাবে ভুলতে ভুল করিনি জালাল ভাই-কেও।
এক বছর পর সেই কীর্তনখোলা নদের তীরে একদিন পরন্ত বিকেলে হাটছি। দেখি, একজন কুঁজো দেয়া বুড়ো লোক মাছ ধরছে জাল দিয়ে। অনেকের মত কৌতুহল নিয়ে আমারও দেখতে মন চাইল, কি মাছ পেয়েছে। দেখি এ তো জালাল ভাইয়ের পিতা। মুখটা সাদা হয়ে গেছে আর নাক দিয়ে বাচ্চাদের মত সর্দি নামছে।
কেমন আছেন, চাচা? আপনি না জালাল ভাইয়ের আব্বা?
বলল, হ্যা, বাবা, তুমি কি জালালকে চেনতা?
বললাম, চিনবো না কেন? আমরা মাদরাসায় এক সাথে পড়াশুনা করছি না?
জালাল ভাই এখন কোথায় আছে, কেমন আছে, বিবাহ-শাদী করেছে?
আমার এ পশ্নগুলো শোনার পর তার ঠোট কাঁপতে লাগল। মনে হয় এক্ষুনি কেঁদে দেবে। না, কান্না চাপাতে চেষ্টা করছে।
বলল, জালাল একটা বিয়া হরল ডাহায়। বউয়ের জন্য চাকরি ছাইররা দ্যাশে আইল। বউ তারে জিগাইল না। তার লগে হারামী করল। মিত্যা মামলা দিয়া জেল খাডাইল। জেল দিয়া বাইড়াইয়া দেহি খালি জিমায়। আর কইতো আমি পাকিস্তান যামু, জিহাদ করমু। অনেক বুজাইলাম, কাম অইল না। ব্লাকে ইন্ডিয়া গ্যালো। কইলো, দিল্লী দিয়া তবলীগ জমাতের সাথে পাকিস্তান যাইবে। দিল্লীতে যাইয়া একটা চিডি ল্যাকলো। কইল, পাকিস্তান যাওয়ার চেষ্টা করতে আছি। আগের মত যাওয়া অত সহজ না।
এরপর অনেক দিন কোন খোঁজ খবর পাই নেই।
একদিন বাড়ীতে এক লোক আইল যশোর দিয়া। আমি দূরে আছালাম। আমারে না পাইয়া একটা চিডি লেইক্যা থুইয়া গ্যালো, আর একটা ব্যগ। তার মধ্যে একটা পানজাবী আর একটা শাড়ী। এগুলো আমার আর তার মার জন্য নাকি কিনছিলো দিল্লী বইস্যা।
চিডিতে ল্যাহা, চাচা, আমি আপনার সাথে দেখা করার জন্য অনেক দূর থেকে এসেছিলাম। আপনাকে পাইলাম না। আপনার ছেলে জালাল কাশ্মীরে ভারতীয় সৈন্যদের হাতে নিহত হয়েছে। তার লাশটাও তারা নিয়ে গেছে। দোয়া করবেন।
জালালের লাশটাকে হয়ত কাফন পড়ানো হয়নি। জানাযা দেয়া হয়নি রক্তাক্ত পাজামা-পানজাবীতেই তাকে কোন গণকবরে বা একটা গর্তে মাটি চাপা দেয়া হয়েছে। নেই তার কবরে কোন নাম ফলক। লেখা নেই সেখানে, স্ত্রীরা দ্বারা নির্যাতিত পরাজিত এক লড়াকু যোদ্ধার সমাধি এটি। নেই তার কবরে কোন পাথর খন্ড, যা বলে দিত, এ হল তার পথের শেষ।
হানীফা বেগম! তুমি কি একটু যাবে তার লাশের সন্ধানে কাশ্মীরের বারামুল্লায় বা কুপোয়ারায়? যেয়ে বলে আসবে তার কবরের কাছে দাড়িয়ে, তোমাকে তাড়িয়ে আমি খুব সুখে আছি জালাল। তুমি ঘুমাও রক্তাক্ত কবরে আর অপেক্ষা করো শেষ বিচারের। তোমাদের কপালে তো এমনই লেখা।