আমার প্রতিবেশী পরিবারটি খৃষ্টান। যে ফ্লাটে থাকি সেখানে আমি ব্যচেলরসহ মুসলিম পরিবারের সংখ্যা পাচ আর খৃষ্টান পরিবার এক। কিন্তু আমার সাথে সেই খৃষ্টান পরিবারের কথা-বার্তা, আলাপ আলোচনা ও কুশল বিনিময় হয় বেশী। অন্য পরিবারগুলোর সাথে বলতে গেলে তেমন পরিচয় নেই। নগর সভ্যতার ফ্লাট জীবনের পরিবেশ যা হয়। আমি আবার কখনো কোন অমুসলিম ব্যক্তির সঙ্গ পেলে এটাকে সুযোগ হিসাবে নিয়ে থাকি। তার ধর্ম ও সংস্কৃতি সম্পর্কে জানার চেষ্টা করি আলাপ জুড়ে দিয়ে। একদিন ইফতারের সময় একটি বিষয় নিয়ে আলাপ শুরু করে দিলাম আমার প্রতিবেশী খৃষ্টান পরিবারের কর্তাটির সাথে। বলা যায় একটি বিতর্ক।
সে সর্বদা আমাকে সালাম দিত। আমিও উত্তর দিতাম। এ বিষয়টিকে নিয়েই তার সাথে তর্ক জুড়ে দিলাম। যাক, সে তর্কের প্রতিবেদন একটু পরে দিচ্ছি।
তার আগে একটি ভূমিকা।
মানুষের সাথে মানুষের দেখা হলে শুভেচ্ছা জানানোর বিষয়টি বহুকাল থেকে চলে আসছে। এটা মানব সভ্যতার একটি গৌরব জনক বিষয়। ধর্ম, জাতি ভেদে শুভেচ্ছা বিনিময়ের ভাষাও হয়েছে হরেক রকম।
কিন্তু কবে থেকে এ প্রথা চালু হয়েছে, কে এর প্রবর্তন করেছে সে বিষয় আমার গবেষণা নেই। তবে আল কুরআন থেকে যতদূর জানা যায় তাহল, প্রায় পাচ হাজার বছর আগে নবী ইবরাহীমের কাছে আল্লাহর পক্ষ থেকে যখন কয়েক জন ফেরেশতা এসেছিল। তখন তারা তাকে বলেছিল, সালাম! ইবারহীম তার উত্তরে বলেছিলেন, সালাম!
এর পূর্বে শুভেচ্ছা বিনিময়ের ভাষার ব্যবহার ও প্রথা চালু থাকলে থাকতেও পারে। তবে তা আমার অজানা। এ বিষয়ে আমার জানার দৌড় ওখান থেকে শুরু।
নবী ইবরাহীমকে মুসলিমরা তাদের জাতির জনক বলে মনে করে। আল কুরআনে আল্লাহ তা বলেও দিয়েছেন। আবার ইহুদী ও খৃষ্টান ধর্মের মানুষেরা ইবরাহীমকে তাদের ধর্মের আদি-পিতা বলে জানে। এমনকি ইহুদীরা বলে, ইবরাহীম ইহুদী ছিল আর খৃষ্টানেরা দাবী করে, ইবরাহীম ছিল খৃষ্টান। আল কুরআন এ প্রসঙ্গে বলেছে: ইবারহীম ইহুদী ছিল না, সে খৃষ্টানও ছিল না। সে ছিল একনিষ্ঠ মুসলিম। ইবরাহীমের ইহুদী বা খৃষ্টান হওয়ার প্রশ্ন আসে কি করে? এ দুটো ধর্ম তো তার চলে যাওয়ার অনেক পরে সৃষ্টি হয়েছে।
যাক, নবী ইবরাহীমের মাধ্যমে যখন সালাম বা শুভেচ্ছা বিনিময়ের প্রথার প্রবর্তন হল, তখন তা এ তিনটি ধর্মেরই বিষয় হতে পারে।
তবে ইসলাম শুভেচ্ছা বিনিময়ের ব্যাপারটায় এত গুরুত্ব দিয়েছে, অন্য কোন ধর্ম বা মতাদর্শ তার সিকিভাগও দেয়নি।
আল্লাহ তাআলা আল কুরআনে সালাম দিতে বলেছেন। সালামের উত্তর দেয়াকে অপরিহার্য কর্তব্য বলে ঘোষণা দিয়েছেন। নবী মুহাম্মাদ সা. যখন মদীনায় আসলেন তখন প্রথম যে কথাগুলো সকলকে বললেন, তাহল: সালামের প্রসার ঘটাও! মানুষকে খাদ্য দান করো! যখন রাতে মানুষ ঘুমে থাকে তখন সালাত আদায় করো... ।
সেখানে সালামের প্রচলন এত ছিল যে, ইহুদী ও খৃষ্টানেরা রাসূলকে সালাম দিত। রাসূল তাদের সালামের উত্তর দিতেন।
মূলের দিক দিয়ে ইসলাম ও সালাম শব্দ দুটো একই। সালাম অর্থ শান্তি। আর ইসলাম অর্থ শান্তি প্রতিষ্ঠা করা। সে অনুযায়ী মুসলিম শব্দের অর্থ হল শান্তি প্রতিষ্ঠাকারী।
কথাটা একটু নতুন লাগে, তাই না? অনেকে বলবেন, কোথাকার কোন ডিজিটালভূত এসে ইসলামের অর্থটাই পাল্টে দিতে চায়।
পাল্টে দেয়া নয়। আসলে একটা শব্দ ব্যবহারের ক্ষেত্র ভেদে অর্থ ভিন্ন হতে পারে। একজন পুরুষ ব্যক্তি যখন বলে আমার বউ, তখন আমরা বুঝে নেই এখানে বউ মানে স্ত্রী। কিন্তু একজন বয়স্কা নারী যখন বলে আমার বউ, তখন আমরা বুঝি এখানে বউ মানে পুত্র বধু।
ইসলাম শব্দটা যখন মানুষ ও স্রষ্টার সম্পর্কের ক্ষেত্রে ব্যবহার হয় তখন এর অর্থ হয়, পরম আনুগত্যে স্রষ্টার কাছে আত্নসমর্পন করা।
আর ইসলাম শব্দটা যখন মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্কের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয় তখন তার অর্থ হয় শান্তি প্রদান করা বা শান্তি প্রতিষ্ঠা করা। সে অনুযায়ী মুসলিম শব্দের অর্থ যথাক্রমে আল্লাহর কাছে আত্নসমর্পনকারী ও মানুষের জন্য শান্তি প্রতিষ্ঠাকারী। আর এ জন্যই কোন মানুষকে দেখলেই সে বলবে আচ্ছালামু আলাইকুম- আপনার প্রতি শান্তি।
এখন তর্কের ঘটনাটা বলি।
লোকটি বয়সে আমার দ্বিগুণ। একটি বিদেশী এনজিওতে চাকুরী করত। সে সুবাদে সে খৃষ্টানদের প্রার্থনা সভায় পৌরহিত্য করত। পাদ্রী না হলেও আধা পাদ্রী। আমাকে সালাম দিয়ে ঘরে ঢুকল। অনেক কথার শেষে আমি তাকে বললাম, আমি আপনাকে একটি প্রশ্ন করতে চাই, শুধু জানার জন্য। আপনাকে বিব্রত করার জন্য নয়।
আমাদের ইসলাম ধর্মে মানুষের সাথে দেখা হলে শুভেচ্ছা বিনিময় করতে হয়। এ জন্য সালামের প্রচলন আছে। হিন্দুরা নমস্কার বলে। যাদের কিছু নেই তারা গুড মর্নিং বলে। খৃষ্টান ধর্মে এ ব্যাপারে কি আছে?
দেখলাম, লোকটি চিন্তায় পড়ে গেলে। কিছুক্ষণ চুপ থাকল। তার নীরবতা ভেঙ্গে উত্তরটা সহজ করার জন্য আমিই বললাম, যদি বলেন, গুড মর্নিং, গুড আফটার নূন . . খৃষ্টানদের ধর্মীয় সালাম, তাহলে আমি আপনার কাছে প্রমাণ চাইব, যীশু এ রকম গুড মর্নিং বলতেন কিনা বা তিনি বলতে আদেশ করেছেন কি না? যদি প্রমাণ না থাকে তাহলে এটা খৃষ্টানদের সংস্কৃতি হবে কেন?
মানুষটির নীরবতা যেন কাটে না। কিছুক্ষণ চিন্তা করার পরে বলল, আমরা খৃষ্টানেরা শুভেচ্ছা বিনিময়ের সময় বলি, যীশু আপনার সহায় হোন!
আমি বললাম, তাহলে তো বিপদ আরো বেশী। সে বলল, কেন?
বললাম, আপনি যদি একজন ইহুদীকে বলেন, যীশু আপনার সহায় হোন। তাহলে সে কি ভাববে? কি বলবে? সে বলবে, আপনি এ কথাটি বলে আমার ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করেছেন। যে যীশুকে আমরা স্বীকার করতে চাই না, তাকে আমার সহায় হতে বললেন? আমাকে তো অপমান করলেন।
যদি আপনি একজন মুসলিমকে উদ্দেশ্য করে বলেন, যীশু আপনার সহায় হোন, তাহলে সে বলবে নাউজুবিল্লাহ মিন জালেক!
যীশুকে আমরা একজন নবী বলে সম্মান করি। তাকে শ্রদ্ধা করি। তিনি মৃত্যু বরণ করেননি বা তাকে কেহ হত্যা করতে পারেনি এটাও বিশ্বাস করি। কিন্তু তাকে আমার সহায় হতে বললে আমার বিশ্বাসে তা মারাত্নক ফাটল সৃষ্টি করবে। সহায় হতে পারেন শুধু আল্লাহ। অন্য কেহ নয়।
যদি আপনি একজন চায়নিজ কে বলেন, যীশু আপনার সহায় হোন। তাহলে সে বলবে যীশু কে? সে কি কাজ করে? এমনিভাবে আপনার শুভেচ্ছা বিনিময়ের এ ভাষাটি সবাই অপছন্দ করবে।
অপরদিকে একজন ইসরাইলীকে যদি আপনি বলেন, আস সালাম – আপনার জন্য শান্তি . . .। তাহলে সে বলবে, ভাল কথা বলেছেন। আমি তো এটাই ভিক্ষা চাই। বর্তমান সময়ে শান্তির খুব প্রয়োজন। আমরা এ শান্তির জন্য প্রতিদিন গড়ে দশ জন করে ফিলিস্তিনীকে হত্যা করে থাকি। তবুও শান্তি আসে না।
যদি আপনি একজন আমেরিকান কে বলেন, আস সালাম- আপনার জন্য শান্তি। তাহলে সে বলবে খুব ভাল কথা বলেছেন। সারা বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা আমাদেরই দায়িত্ব। দেখেন না, এ শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য আমরা প্রতিদিন গড়ে একশ জন মুসলিমকে হত্যা করি।
যদি আপনি একজন জাপানীকে বলেন, আপনার জন্য শান্তি। সে বলবে, সুন্দর কথা বলেছেন। শান্তির জন্যই তো আমরা নারী-পুরুষেরা চব্বিশ ঘন্টা কাজ করি আর শিল্পের পিছনে দৌড়াই।
মুসলিমরা শুভেচ্ছা বিনিময়ে এমন ভাষা প্রয়োগ করে যা বিশ্বের সকল মানুষ পছন্দ করবে। এ ভাষায় কোন ব্যক্তি, ধর্ম, সময়, রাষ্ট্র বা সম্প্রদায়ের কোন বিজ্ঞাপন নেই। আবার তা সকাল, দুপুর বা সন্ধ্যার সাথেও যুক্ত নয়। সারাক্ষণই সালাম আর সালাম – শান্তি।
আমার কথা শেষ করার পর লোকটি আর কোন কথা বলতে চাইল না। এরপর থেকে তার সাথে কথা কমই হয়।
এখনো তার সাথে দেখা হয়। দেখা হলেই আগ বাড়িয়ে আমাকে বলে, আচ্ছালামু আলাইকুম- আপনাদের প্রতি শান্তি বর্ষিত হোক! আমিও বলি, আপনার জন্য তা-ই হোক।