ক্রিকেট মাঠের অধিনায়ক, কিন্তু ক্রিকেট ছাপিয়ে স্পর্শ করেছেন তিনি জীবনের সীমানা। অনেকেরই অনুপ্রেরণার উৎস মাশরাফি বিন মুর্তজা ৫ অক্টোবর পূর্ণ করলেন ৩৫ বছর। চার বছর আগে একই দিনে পৃথিবীর আলোয় এসেছে তার দ্বিতীয় সন্তান। ৩৫তম জন্মদিনে ৩৫ প্রশ্নে ফুটে উঠল মাশরাফির জীবন, মনোজগৎ ও চারপাশ।
১. জীবনের ইনিংসে ৩৫ সংখ্যাটির মানে?
মাশরাফি বিন মুর্তজা: অর্ধেক জীবন কাটিয়ে দিলাম, কিছুই করা হলো না!
আমাদের দেশের বাস্তবতায় বলি কিংবা যে কোনো বাস্তবতায়, ৩৫ বছর মানে সাধারণ হিসেবে জীবনের অর্ধেক পেরিয়ে যাওয়া। ৩৫ বছর হয়ে যাওয়া মানে জীবনের হিসেব-নিকেশ করা যায়। কি করতে পারলাম, কি পারিনি, কিভাবে এত পথ পাড়ি দিলাম, সব ভাবা যায়। আমার পথচলায় চড়াই-উৎরাই ছিল, ভালো-মন্দ ছিল, সবার জীবনে যেমন থাকে। তবে সব মিলিয়ে পথচলা যেমন ছিল, আমি তাতে খুশিই।
২. ৩৫ বছরের জীবনকে যদি দুটি ভাগে আলাদা করতে বলা হয়?
মাশরাফি: আমার ক্ষেত্রে খুব অনায়াসেই করা যায়। কারণ ১৭-১৮ বছর বয়সে জাতীয় দলে এলাম, ৩৫ বছরে এসে জীবনে দুটি সমান ভাগ করা যায়!
যদি প্রথম ১৭-১৮ বছর ধরি, তাহলে সেটি কেবলই আমার নিজের সময়। বোধ হওয়ার পর থেকে দুরন্তপনা, লাফালাফি, দাপাদাপি করে বেড়িয়েছি। গাছে ওঠা, নদীতে ঝাঁপ, সাঁতার, যাবতীয় দুষ্টুমি, অদ্ভুত আনন্দময় সময় কাটিয়েছি। কোনো কিছুর পরোয়া ছিল না, পিছুটান ছিল না। যা ইচ্ছা হয়েছে, করেছি। ওই জীবনটা ছিল কেবলই আমার।
পরের ১৭-১৮ বছর যদি বলি, তাহলে এই জীবন ক্রিকেট ও পরিবারের। যেদিন থেকে সিরিয়াসলি ক্রিকেট খেলছি, দেশের হয়ে খেলেছি, সবটা দিয়ে খেলার চেষ্টা করেছি। আর পরিবারের প্রতি দায়িত্ব আমি অনেক পরে বুঝেছি। বোঝার পর থেকে চেষ্টা করেছি পালন করতে। পরিবারই তো সবকিছু। দুটি জীবনই আমার কাছে মূল্যবান। দুটি মিলিয়েই আমি।
৩. জীবন মানে?
মাশরাফি: ছোট করে বললে, জীবন মানে ভালো থাকা, ভালো রাখা। নিজে ভালো থাকার চেষ্টা করি, অন্যকে ভালো রাখার চেষ্টা করি। পারলে অন্তত একজন মানুষের উপকার করি, সেটি না পারলে অন্তত কারও ক্ষতি যেন না করি। মূল্যবোধ নিয়ে বেঁচে থাকা।
মনে হতে পারে যে খুব সহজ কাজ এটি। কিন্তু আসলে এটির ব্যপ্তি বিশাল। এক জীবনে এই কাজটি ঠিকঠাক করতে পারা মানেই অনেক কিছু করা।
৪. ক্রিকেট মানে?
মাশরাফি: ক্রিকেট মানে প্রেম, ভালোবাসা। যদি ক্রিকেট একটি খেলা হিসেবে দেখেন, আমার জীবনে, পরিবারের পর ক্রিকেটই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আর যদি দেশকে যোগ করে দেন, দেশের ক্রিকেট বোঝালে, সেটি আমার কাছে পরিবারের চেয়েও আগে।
৫. বাংলাদেশ দল মানে
মাশরাফি: হৃদয়ের খুব কাছের কিছু। আরেকটা পরিবার। সেই আকরাম ভাই, বুলবুল ভাইদের সঙ্গে শুরু। এরপর বিদ্যুৎ ভাই, রোকন ভাই, অপি ভাইদের সঙ্গে খেলেছি, সবশেষ অভিষেক অপুর, সবাই একটা বড় পরিবারের অংশ। গত ১৭-১৮ বছর তো পরিবারের চেয়ে বেশি সময় তাদের সঙ্গেই কাটিয়েছি। সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনায় সময় কেটেছে।
দল মানে দেশের প্রতিনিধি। দেশকে প্রতিনিধিত্ব করার চেয়ে বড় সম্মান আর কী হতে পারে! আমার দল তাই আমার অস্তিত্বের একটি অংশ।
৬. নেতৃত্ব মানে?
মাশরাফি: নেতৃত্ব বলতে, আমি যদি নিজেকে নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চাই, আমি মনে করি তা আসলে স্বার্থপর ভাবনা। আমি অধিনায়ক বা নেতা, তার মানেই আমি সুপ্রিম নই। আমাকে স্রেফ একটি দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। কিন্তু আমার পাশের সবাই সমান গুরুত্বপূর্ণ। তাদের চাওয়ার সঙ্গে যদি আমার চাওয়াকে মানিয়ে নিতে পারি, যদি সবাই একাত্ম হতে পারি, যদি একই লক্ষ্যে ছুটতে পারি, তখন হয়ত বলতে পারি যে আমি কাজটা ঠিকঠাক করছি।
৭. দেশ মানে?
মাশরাফি: এক কথায় বললে, ভালোবাসা। দেশ মানে নিখাদ ভালোবাসা। আমার দেশ আমার কাছে সবচেয়ে সুন্দর। বিশ্বাস করুন, দেশের সবকিছু আমার ভালো লাগে। আমার যারা কাছের মানুষ, তারা সবাই জানে, দেশের বাইরে আমার ভালো লাগে না। বাইরে যত সুন্দর কিছুই দেখি না কেন, যত অত্যাধুনিক বা আশ্চর্য কিছুর কাছে নিয়ে যান, হয়ত ভালো লাগবে, কিন্তু ততটা উপভোগ করি না। কিন্তু দেশের একটা গ্রামে আমাকে রেখে আসেন, একটুও বিরক্ত হব না। ছাদে বসে থাকি, রাস্তার পাশে ফেলে রাখেন, নদীর কূলে বসি, পুকুরে নামিয়ে দেন, ঘরের কোণে চুপচাপ বসে থাকি, সব আমি উপভোগ করি।
অবশ্যই দেশের সবকিছু ভালো নয়। তবে সেটা দেশের দোষ নয়। আমি-আপনি, আমার মতো কৌশিক, মাশরাফিরাই দেশকে খারাপ করে রেখেছি। ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়া এত সুন্দর কেন? কারণ তাদের মানুষ দেশটাকে সুন্দর করেছে এবং রেখেছে। নাগরিক হিসেবে নিজেদের দায়িত্বটুকু আমরা সবাই পালন করলে এই দেশ কোনো দেশের চেয়ে পিছিয়ে থাকবে না। এই অভিযোগের বাইরে আমিও নই। আমিও হয়তো পারিনা, যতটা করা উচিত।
দেশের খারাপটুকুর জন্য তাই আমার দেশের প্রতি রাগ, ক্ষোভ বা অভিমান হয় না। আমরা ভালো হলেই দেশ ভালো। জানি অনেকেই বিশ্বাস করবে না, কিন্তু সত্যিই আমার কাছে আমার দেশের চেয়ে সুন্দর দেশ আর নেই। এই দেশের আলোতে শান্তি, হাওয়ায় তৃপ্তি।
৮. জীবনের সেরা সময়?
মাশরাফি: আমার মেয়ের জন্ম, ২০১১ সাল। প্রথমবার বাবা হওয়ার অনুভূতি, বলে বোঝানোর নয়। অনুভূতিটা আমার এখনও নাড়া দেয়, ফুটিয়ে তোলা সম্ভব নয়। আমার এখনও মনে আছে, সুমির (মাশরাফির স্ত্রী) প্লাজমা লাগবে, আমি জোগাড় করতে গিয়েছি। এসে দেখি বাবার কোলে আমার মেয়ে। ঠিক সেই মুহূর্তটায় ভেতরে যে কতকিছু খেলে গেল!
হুমায়রা জন্মের পর এতটা সাদা হয়েছিল, আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। কারণ ওর জন্মের আগে থেকেই ওর মা তখন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছিল। আমি তাই প্রথমেই আব্বাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘ও এত সাদা কেন? সব ঠিক আছে তো?”
তবে খুব লজ্জাও লাগছিল। কারণ আব্বা-আম্মা ওখানেই। তাদের কাছে আমিই তখনও বাচ্চা। সেই আমারও বাচ্চা হয়ে গেল! বেশ লজ্জা লাগছিল।
৯. সবচেয়ে কষ্টের সময়?
মাশরাফি: সেটিও ২০১১ সাল। দেশের মাটিতে বিশ্বকাপ খেলতে না পারা। অনেকবার বলেছি এটা নিয়ে। তাছাড়া আনন্দের স্মৃতি যেটি বললাম, মেয়ের জন্ম, সেসময় বড় একটি ট্র্যাজেডিও হতে পারত। আমার স্ত্রী ক্লিনিক্যালি ডেড ছিল প্রায়। সেই কারণেও ওই সময়টা ভোলার নয়।
তবে ২০১১ সাল আমাকে অনেক কিছু শিখিয়েছে। বিশ্বকাপ থেকে বাদ পড়ে শিখেছি। এরপর স্ত্রীর অসুস্থতা। আমার মন ভীষণ খারাপ থাকত বিশ্বকাপ খেলতে না পেরে। বাসায় চুপচাপ বসে থাকতাম। মেজাজ খিটখিটে হয়ে গিয়েছিল বলে কেউ আমার সঙ্গে কথা বলতেও সাহস পেত না সেভাবে। সুমি তখন আবার ভীষণ অসুস্থ। রোদ সহ্য করতে পারত না। প্রায় দেড় মাস এরকম ছিল, বাসায় সবসময় পর্দা টানা থাকত। দিনের বেলাও রাতের মতো করে রাখা হতো।
একদিন আম্মা বলল, এত গুমোট পরিবেশে থাকলে এমনিতেই শরীর-মন খারাপ থাকবে। পর্দা সরিয়ে দিলেন। খানিক পরই সুমির শরীর, চোখ, মুখ সব হলুদ হয়ে গেল। ভয়ঙ্কর অবস্থা। আমি তখন বাইরে। আম্মা ফোন করে বললেন, শিগগির সুমিকে হাসপাতালে নিতে হবে। নিয়ে গেলাম সিটি হাসপাতালে। আমার এক দাদি ডাক্তার, ফাতেমা আশরাফ। উনিই দেখতেন সুমিকে।
দাদি দেখে বললেন দ্রুত ভর্তি করাতে। সারা রাত শেষে ভোরের দিকে আমাকে ডেকে বললেন, “কৌশিক, সরাসরিই বলি, দ্রুত অপারেশন করাতে হবে। তোমার বাচ্চাটা হয়তো বাঁচবে, তবে সুমির ক্ষেত্রে খারাপ কিছুর শঙ্কা ৯৯ ভাগ।” আমি আকাশ থেকে পড়লাম। দাদি বললেন, “প্রেগন্যান্সি জন্ডিস, খুব খারাপ দিকে চলে গেছে। এইসব ক্ষেত্রে রোগীর বাঁচার ঘটনা বিরল।”
সুমির কষ্ট হচ্ছিল অনেক দিন থেকেই। কিন্তু আমার মন এত খারাপ ছিল বিশ্বকাপ খেলতে না পেরে, ওর কষ্টের কথা জানিয়ে আমাকে আরও চাপ দিতে চায়নি। যখন হাসপাতালে নিলাম, তখন অবস্থা অনেক খারাপ। দাদি বলছিলেন, এখন খুব ভালো হাসপাতাল বা দেশের বাইরে নিয়ে গিয়েও খুব লাভ হবে না। বাকিটা আমার ওপর ছেড়ে দিলেন। চারপাশের সবাই পরামর্শ দিচ্ছিলেন অন্য কোথাও নিতে। কিন্তু আমার হুট করে মনে হলো, এখানেই রাখব। দাদি সুমিকে আগে দেখেছেন, ওর শরীরটা খুব ভালো করে জানেন। পারলে তিনিই পারবেন। আর অদ্ভুত একটা ব্যাপার কাজ করছিল আমার ভেতরে, কেবলই মনে হচ্ছিল, এত দ্রুত সুমি চলে যেতে পারে না। ওর এখনও অনেক কিছু পাওয়ার আছে আমার কাছ থেকে, জীবনের কাছ থেকে।
৬ মাস ২৯ দিন বয়সে হুমায়রা পৃথিবীতে এলো। যুদ্ধ করে টিকে গেল। সুমির যমে-মানুষে টানাটানি ছিল ১১ দিন। একসময় ঝুঁকিমুক্ত হলো।
তারপর থেকে আমার বদ্ধমূল বিশ্বাস, আল্লাহ যা করেন, ভালোর জন্যই করেন। আমি যদি বিশ্বকাপ থেকে বাদ না পড়তাম, তাহলে হয়তো সুমি বাঁচত না। খেলা থাকলে ওরা নিশ্চিতভাবেই আমাকে জানাত না, সুমিকে হাসপাতালে নিতে বা অপারেশন করতে দেরি হতো। আর কয়েক ঘণ্টা দেরি হলেই সর্বনাশ হয়ে যেত। ২০১১ সাল তাই আমাকে অনেক কিছু শিখিয়েছে। সব বাস্তবতা মেনে নিতে শিখেছি।
১০. সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি?
মাশরাফি: মানুষের ভালোবাসা।
১১. সবচেয়ে বড় আক্ষেপ?
মাশরাফি: আমার নানা-নানি আমাকে দেশের হয়ে খেলতে দেখে যেতে পারেননি। নানা-নানি আমার জীবনে কতটা, এটা হাজার হাজার শব্দে লিখেও শেষ করা যাবে না। নানা আতাউর রহমান ছিলেন আইনজীবী, নড়াইল বার কাউন্সিলের সভাপতি। নানি প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক। জন্মের পর থেকে নানা-নানির কাছে থেকেছি, বড় হয়েছি। কতটা যত্নে, মমতায় যে আমাকে মানুষ করেছেন! বিশেষ করে নানি, ‘আমার কৌশিক’ ছাড়া তার মুখে কোনো কথা ছিল না। তার জগত ছিল আমাকে ঘিরে। এমনকি আমার ক্রিকেট খেলা, সেটাও থেমে যেত নানি না থাকলে। ওই সময় তো ক্রিকেটকে সিরিয়াসলি নেওয়ার বাস্তবতাই ছিল না। আব্বা-আম্মা রাগ করতেন, পড়ায় মন দিতে বলতেন। শেষ পর্যন্ত একদিন আমার নানিই বললেন, “ও যখন খেলতে চায়, খেলতে দাও ওকে। একটা ক্রিকেট সেট এনে দাও।” তার পর থেকেই আমার ক্রিকেট নিয়ে সিরিয়াসলি এগোনোর শুরু।
আমি ক্লাস ফাইভে থাকতে নানা মারা যান। এরপর যখন কেবল লোকে আমার নাম জানতে শুরু করেছে, তখনই নানি মারা যান। তার কদিন পরই আমি জাতীয় দলে জায়গা পাই। আর কয়েকটা দিন বেঁচে থাকলে নানি দেখে যেতে পারতেন।
১২. পেছন ফিরে তাকালে?
মাশরাফি: ভালো-মন্দ মিলিয়েই ছিল জীবন। এক জীবনে অনেক পাওয়া হয়ে গেছে। অপ্রাপ্তিগুলো তার তুলনায় কিছুই না। যে জীবন আমি কাটিয়েছি এবং কাটাচ্ছি, এর চেয়ে বেশি কিছু হয়তো চাইতে পারতাম না।
১৩. সমুখ পানে দেখলে?
মাশরাফি: আমি বরাবরই ভাগ্যে বিশ্বাসী। অবশ্যই নিজেকে চেষ্টা করতে হয়, কোনো কিছু পাওয়ার জন্য নিজেকে তৈরি করতে হয়, অর্জন করে নিতে হয়। তবে শেষ পর্যন্ত ভাগ্যের ওপরই নির্ভর করে। আমি চেষ্টার চূড়ান্ত করে যাব, বাকিটা কপালে যা থাকবে, কেউ বদলাতে পারবে না।
১৪. বন্ধুত্ব মানে?
মাশরাফি: কোনো সংজ্ঞা নেই। বন্ধুত্বের সংজ্ঞা বা স্বরূপ খুঁজতে যাই না। সীমা দেখতে যাই না। যারা আমার ভালো লাগার, তারাই আমার বন্ধু। বন্ধুত্বের ক্ষেত্রে ভেদাভেদ খুঁজি না, ছোট-বড় দেখি না। বন্ধুত্ব বহমান, বন্ধুত্ব নিখাদ। বন্ধুরাই আমার প্রাণশক্তির উৎস।
১৫. আপনার মাঝে আপন যে জন...
মাশরাফি: আমার জীবনে এত বেশি আপনজন, একজন-দুজনকে বেছে নেওয়া অসম্ভব। সেভাবে ভাবিই না আমি, চেষ্টাও করি না। আপনজনরাই আমার বেঁচে থাকার শক্তি। তারপরও বলতে হলে, আমি বলব, আল্লাহ আমার সবচেয়ে আপন। দিনশেষে সবচেয়ে বড় আশ্রয়।
১৬. আড়ালের যিনি জীবনে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ...
মাশরাফি: দুজনের কথা বলব। প্রথমত আমার মামা, নাহিদুর রহমান। নানা বাড়ীতে বড় হয়েছি, নানা-নানি মারা যাওয়ার পর মামা-মামি মানুষ করেছেন। আমার জন্য মামার জীবনে যত ত্যাগ, বলতে গেলে শেষ হওয়ার নয়।
আর আমার স্ত্রী। যখন বিয়ে হয়েছে, আমি তখনও উড়নচণ্ডী। জীবন-সংসার সম্পর্কে বোধ কম। সুমিকে একদমই সময় দেইনি। বন্ধু-আড্ডা, ঘুরে বেড়ানো, অনেক কিছুতে ব্যস্ত থাকতাম। সুমি বুঝত আমার কোনটা ভালো লাগে, কোনোদিন অভিযোগ করেনি। নিজের মতো মানিয়ে নিয়েছে।
সংসারের ঝামেলা বা দাবি, কোনোদিন আমাকে বুঝতে দেয়নি। যখন আমি নিজে অনুভব করতে শুরু করলাম, তখন বুঝলাম, কতটা ঝামেলা সয়ে সুমি সংসার সামলেছে, আমাকে বুঝতেও দেয়নি। আমাকে আমার মতো থাকতে দেওয়ার জন্য সুমি দিনের পর দিন নিজেকে নানা পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিয়েছে।
আড়ালের ওরাই আমার সামনে এগিয়ে চলা মসৃণ করেছে। আস্থার দেয়াল হয়ে আমাকে ভরসা জুগিয়ে গেছে।
১৭. প্রিয় মুহূর্ত?
মাশরাফি: ছেলে-মেয়ে দুটোর মুখ যখন দেখি। যখন ওদের সঙ্গে সময় কাটাই।
১৮. অস্থির মুহূর্ত?
মাশরাফি: আশেপাশের কেউ অসুস্থ হলে। সেটা পরিবার-পরিজন হতে পারে, দলের কারও অসুস্থতা বা ইনজুরি হতে পারে, অস্থির লাগে। সুস্থতার চেয়ে বড় নিয়ামত নেই।
১৯. কোনো গান, কবিতা বা উপন্যাস, কিংবা কোনো লাইন, আপনার জীবনকে ফুটিয়ে তোলে?
মাশরাফি: কারার ওই লৌহ কপাট। নজরুলের এই গান আমার বড় চালিকাশক্তি। গানটা শুনলে বা ভাবলেই অদ্ভুত এক ধরনের শক্তি চলে আসে মনে। রক্তে নাচন লাগে যেন। প্রতিকূলতার শিকল ভেঙে, সব বাধা পেরিয়ে এগিয়ে চলার প্রেরণা জোগায়। আমার জীবনের ক্ষেত্রে খুব সত্যি।
২০. দুঃসময়ে সাহস জোগায়?
মাশরাফি: আমার মায়ের মুখ। মাকে মনে পড়লেই ভেতরে শক্তি চলে আসে। মায়ের প্রতি বিশ্বাস আমার তীব্র। একটা মানসিক ব্যাপারও আছে। আমার যদি মনে হয়, কখনও কোনো কারণে আমার ওপর মায়ের মন ভার, তাহলে আমি জানি, সামনের সবকিছুই খারাপ হবে। আর যদি মায়ের মন ভালো থাকে, তাহলে বিশ্বাস করি, আমার সবকিছুই মসৃণ ভাবে চলবে।
২১. কান্না পায় কখন? সবশেষ কবে কেঁদেছেন?
মাশরাফি: অনেক সময়ই। কখনও ভেতর কাঁদে, কখনও ভেতরের কান্না বাইরে চলে আসে। অনেক সময় অনেক নরম্যাল কিছুতে কান্না চলে আসে। অনেক সময় দেখা যায় কান্নার মতো অনেক কিছুতেও শক্ত থাকি।
এবার এশিয়া কাপ ফাইনালে হারার পর মাঠে বা বাইরে আমরা যথেষ্টই শক্ত ছিলাম। কিন্তু ফেরার সময়, এয়ারপোর্টে বসে যখন দেশ থেকে প্রতিক্রিয়া পাচ্ছিলাম, সোশ্যাল মিডিয়ায় লোকের হাহাকার, স্বপ্নভঙ্গের বেদনাগুলো জানতে পারছিলাম, তখন নিজেকে ধরে রাখা কঠিন ছিল। দেশকে শিরোপা উপহার দেওয়ার অনেক বড় সুযোগ আমরা হাতছাড়া করেছি।
২২. একই দিনে ছেলের জন্ম...!
মাশরাফি: অন্যরকম একটা ব্যাপার আমার কাছে। সাহেলের জন্ম নেওয়ার তারিখ ছিল ১২ অক্টোবর। সেই ডাক্তার দাদির হাতেই জন্ম। তার আগে আমরা ইনচনে গেলাম এশিয়ান গেমসে খেলতে (২০১৪)। ৫ তারিখ আমার ফেরা। প্লেনে ওঠার আগেও বাসায় ফোন দিলাম, সব স্বাভাবিক। ১২ তারিখ না হলেও ৮-৯ তারিখে বাচ্চা হয়ে যাবে, এরকমই জানালেন দাদি। কিন্তু আমি ঢাকায় এয়ারপোর্টে নেমে ফোন দিলাম, শুনি সুমিকে হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। হাসপাতালে গিয়ে জানলাম হয়ে গেছে, একদম ওকে হাতে নিতে পারলাম গিয়েই।
সত্যি বলতে, আমি চাইনি আমাদের জন্মদিন একসঙ্গে হোক। কোনো ব্যাখ্যা নেই, স্রেফ চাইনি। কেমন যেন উল্টাপাল্টা লাগত ভাবলে। তবে হয়ে গেছে, তাতেও আপত্তি নেই। বেটা আমার চাইলেও কোনোদিন আমাকে ভুলতে পারবে না, জন্মদিন এলে তো অন্তত মনে করতেই হবে!
২৩. ক্রিকেট বল আপনার কাছে কি?
মাশরাফি: যা কিছু আমি হাতে নেই বা নিতে পারি, তার মধ্যে সবচেয়ে স্বস্তির স্পর্শ। শান্তির অনুভূতি। বল মুঠোয় নিলে মনে হয়, আমার খুব আপন কিছু।
২৪. মাঠের ঘাসের সঙ্গে কথা হয়?
মাশরাফি: ঘাসের সঙ্গে সম্পর্ক ছোট্টবেলা থেকে। ঘাসে গড়াগড়ি করে, ঘাস মাড়িয়ে, ঘাস চিবিয়ে, লুটোপুটি করে আমার শৈশব-কৈশোর কেটেছে। ক্রিকেটার হওয়ার পর ঘাস আরও আপন হয়ে গেছে। এখানেই আমাদের ছুটে চলা, আমাদের ঘামের ফোটার স্পর্শ। ঘাসকে আমার মনে হয় ভীষণ জীবন্ত, মনে হয় আমাদের সবকিছুর স্বাক্ষী।
২৫. রোদ না বৃষ্টি?
মাশরাফি: বৃষ্টি, চোখ বন্ধ করে। কোনো তুলনাতেই কিছু আসে না। বৃষ্টিতে ভিজতে ভালোবাসি ছোট থেকেই, বৃষ্টিতে খেলতে ভালোবাসি। বৃষ্টি মানেই ছিল আমাদের অদ্ভুত আনন্দ সৃষ্টি। বৃষ্টি দেখতে, ফোটার শব্দ শুনতেও ভালো লাগে। তবে ঠাণ্ডা আমি একদমই নিতে পারি না। ঠাণ্ডার চেয়ে রোদ ভালো।
২৬. সবচেয়ে শান্তির জায়গা?
মাশরাফি: নড়াইল। ফুলস্টপ
২৭. প্রিয় দর্শন?
মাশরাফি: কোথাও একবার পড়েছিলাম, নেলসন ম্যান্ডেলার একটি কথা, “হিংসা দিয়ে তুমি কিছুই জয় করতে পারবে না, ভালোবাসা দিয়ে অন্তত কিছু মানুষের মন জয় করতে পারবে।” সত্যিই ম্যান্ডেলার কথা কিনা, যাচাই করা হয়নি। তবে কথাটি মনে গেঁথে গেছে। আমি চেষ্টা করি অনুসরণ করার।
২৮. নিজের যে স্বভাব পাল্টাতে চান..
মাশরাফি: একরোখা স্বভাব। সবকিছুতে নয়, অনেক ক্ষেত্রে এটা ইতিবাচক ভূমিকাও রাখে। তবে নিজেকে নিয়ে আমার কিছু অদ্ভুত একরোখা ব্যাপার আছে, যেগুলো বাদ দিতে পারলে নিজেরই ভালো।
২৯. যা ছাড়া চলেই না..
মাশরাফি: চা।
৩০. চোখ বন্ধ করলে যা বা যাকে দেখি?
মাশরাফি: আমার মেয়ের মুখ।
৩১. সবচেয়ে বেশি ভয় পাই?
মাশরাফি: আমার বাবাকে। এমনিতে বাবা আমার খুব কাছের বন্ধু, তুমুল আড্ডা দেই। কিন্তু ছোটবেলা থেকে খুব ভয়ও পাই। বাবার হাতে মার খেয়েছি অনেক। এই তো, কিছুদিন আগেও দাবড়ানো খেয়েছি। তবে সেসব কারণে নয়। কেন যেন ভয় পাই। একটা ভয় হয়তো শ্রদ্ধা থেকেই আসে, এছাড়াও কেমন যেন ভয় পাই। আমি এখনও বাবার চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে পারি না। মায়ের সঙ্গে তবু পারি যেমন-তেমন, বাবার সঙ্গে তর্ক বা কথা বাড়ানোর দুঃসাহস হয় না।
৩২. সবচেয়ে বেশি অনুপ্রাণিত হই...
মাশরাফি: হুমায়ার জন্মের সময় যখন সুমির বেঁচে থাকার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে, অপারেশনের আগে ওকে জানানো হলো। সুমি খুব সহজভাবে নিলো। আমাকে স্রেফ বলল, “কখনও কোনো অন্যায় করলে ক্ষমা করে দিও।” ওর সাহস, ওর সহ্যশক্তি দেখে আমি স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। আমি নিজেকে খুব সাহসী ভাবতাম, ওর তুলনায় তো কিছুই না। এরপর যত বিপদে পড়েছি, ওর ওই সময়ের কথা আমার মনে পড়েছে, অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে।
৩৩. নতুন করে জীবন শুরু করতে বললে?
মাশরাফি: ডাক্তার হতে চাইতাম। আমার মতে, সবচেয়ে মহৎ ও সবচেয়ে জরুরি পেশা। মানুষের জীবন বাঁচানোর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আর কী হতে পারে! অবশ্যই জান-প্রাণের মালিক আল্লাহ, কিন্তু ডাক্তাররা হলেন উসিলা। ক্রিকেট বা ক্রিকেটারকে আমি এখানে তুলনায়ই আনতে চাই না।
৩৪. স্বপ্ন?
মাশরাফি: ক্রিকেট নিয়ে বললে, কোনো স্বপ্ন নেই। প্রতিটি দিন নিজেকে উজাড় করে দিতে চাই, দলের জয় দেখতে চাই। জীবনের কথা বললে, স্বপ্ন নয়, বরং তীব্র চাওয়া বলতে পারেন, চাই ছেলে মেয়ে দুটো ভালো মানুষ হোক।
৩৫. যখন ক্রিকেট খেলবেন না?
মাশরাফি: কিছুদিন অন্তত আর সবকিছু বাদ দিয়ে মায়ের সেবা করতে চাই। আমার কেবলই মনে হয়, প্রথম জীবনে দুরন্তপনা আর পরে ক্রিকেটে ডুব দিয়ে মায়ের সেবা যথেষ্ট করা হয়নি আমার। নিত্য দিনের ছোট ছোট অনেক কিছু করা, শারীরিক ও মানসিক ভাবে পাশে থাকা, কাছ থেকে মায়ের হাসি দেখা। ক্রিকেট থেকে মুক্তি পেলে একদম মায়ের কৌশিক হয়ে থাকতে চাই।
সংগৃহিত।
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই অক্টোবর, ২০১৮ ভোর ৬:২২