০১।
সমুদ্রের পাড় দিয়ে লোকটা আনমনে হেঁটে যাচ্ছিলো । পিছন থেকে আরেক লোক তাকে 'ভাই' , 'মিয়া ভাই' 'মশাই' 'দাদা' কত কিছু বলে ডাকছিলো অথচ ঐ লোকটির বিকার নেই । নিজের মত করে হেঁটেই যাচ্ছে , যেন আশপাশের কিছুই শুনছেনা ।
এরপর লোকটা চিল্লায়া ডাকলো, "ঐ কাইল্লা !"
এবারে হাঁটা বন্ধ করে লোকটি পিছনে ফিরে ।
"এখান দিয়া হাঁইটো না !"
- কেন ? আমি কালো বলে ? আপনি জানেন মার্টিন লুথার কিং কালোদের জন্য লড়াই করে মরেছে ? মহাত্মা গান্ধীও মারা যাবার আগ পর্যন্ত বর্ণবাদের বিপরীতে লড়েছেন ? জানেন নেলসন ম্যান্ডেলা কালোদের অধিকার আদায়ে ২৭ বছর জেল খেটেছেন ? বর্ণবাদ একটা মধ্যযুগীয় প্রথা অথচ আজ এই সময়ে আপনি আমাকে কালো বলে হাঁটতে না করছেন ? আপনি কি তারাশঙ্করের 'কবি' পড়েননি ? জানেন কি সেই উক্তিটি-"কালো যদি মন্দ তবে চুল পাকিলে কান্দ কেন ?"
- ধুর ছাই । আপনে তাইলে ঐ চোরাবালির দিকেই হাঁটতে থাকেন !
আমরা প্রায়ই শুনি কক্সবাজার, সেন্টমার্টিন দ্বীপ বা কুয়াকাটায় গিয়ে চোরাবালিতে তলিয়ে গিয়ে অনেকে মারা যায় ।
চোরাবালি হলো পানি ও তরল কাদা মিশ্রিত এমনই একটি গর্ত, এর ফাঁদে একবার পা দিলে আর নিস্তার নেই, আস্তে আস্তে ডুবে যেতে হয় বালির ভেতর । যত নড়া যায় ততই ডুবে যেতে থাকে শরীর । সাধারণত নদী বা সমুদ্রতীরে কাদা মিশ্রিত বালির ভেতরে লুকানো অবস্থায় থাকে চোরাবালি । কোনও মানুষ যদি সেই গর্তের ধারে-কাছে যায়, তাহলে শরীরের চাপে ওই বালি ক্রমে সরে যেতে থাকে। ফলে মানুষ শত চেষ্টা করেও আর ওপরে উঠে আসতে পারে না ।
চোরাবালিতে পড়ার পর সেখান থেকে উঠে আসার জন্য চেষ্টা করলে শরীরের চাপে আরও দ্রুত ডুবে যেতে হয়। সময়মতো কেও এগিয়ে না এলে ওই মানুষ নিশ্চিত মৃত্যুকোলে ঢলে পড়ে । তবে অধিকাংশ চোরাবালি সাধারণত মারাত্মক নয়। তবে এটি প্রকৃতির একটি অদ্ভুত বিস্ময় ।
যেসব জায়গায় পানি বেশি, সেসব জায়গায় চোরাবালি থাকার সম্ভাবনাও বেশি। যেমন জলা, নদী, খাল, সমুদ্রতীর এবং জলাভূমি । যেসব জায়গায় ভূগর্ভস্থ পানির প্রবাহ থাকে সেখানে চোরাবালি থাকতে পারে বা থাকার সম্ভাবনা রয়েছে ।
চোরাবালিতে আটকে গেলে একদমই অধৈর্য হওয়া যাবে না । অধৈর্য হয়ে হাত-পা ছোড়াছুড়ি করলে আরও বেশি আটকে পড়ার সম্ভাবনা থাকে । সবার মনে রাখা উচিত, চোরাবালি কিন্তু পানির চেয়ে অনেক বেশি ঘন। তাই চোরাবালিতে ভেসে থাকা পানির চেয়ে অনেক বেশি সহজ ।
যদি সঙ্গে কোনও ভারি বস্তু থাকে তাহলে তা ছেড়ে ফেলতে হবে । কারণ ভারি বস্তু আরও বেশি দ্রুত নিচে টেনে নিতে পারে । দুই হাত প্রসারিত করে বালুপানির উপর ভাসিয়ে রাখতে হবে , এতে আপনার ওজন বেশি পরিমান ক্ষেত্রের উপর প্রযুক্ত হবে যাতে আপনার পক্ষে ভেসে থাকাটা সহজতর হবে ।
বেশিরভাগ চোরাবালির গভীরতা কম হয়। খানিকটা ডোবার পর হয়তো পা তলায় আটকে যেতে পারে । যদি তা না হয়, মানে যদি চোরাবালি খুব গভীর হয় তাহলে পুরোপুরি ডুবে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকতে পারে । সেক্ষেত্রে যেমন পানিতে আমরা যেভাবে সাঁতার কাটি, ঠিক সেভাবে নিজের শরীরকে যতটা সম্ভব অনুভূমিক করে ফেলতে হবে । তারপর খুব ধীরে ধীরে সাঁতরে চোরাবালির বাইরে আসার চেষ্টা করতে হবে। সাথে যদি অন্য কোনও ব্যক্তি থাকে তাহলে তাকে বলতে হবে নিরাপদ দূরত্ব থেকে রশি ফেলতে এবং এই রশি ধরে ধীরে ধরে চোরাবালি থেকে উঠে আসা যাবে ।
০২।
- ভাই , এখন সমুদ্রে নাইমেন না । ভাটা চলতাছে ।
- আরে কিছু হবেনা । আমার সাইজ দেখছেন ?
- কত বড় বড় নৌকা টাইনা নিয়া যায় আর এইতো আপনে !
- আচ্ছা , দেখেন তাইলে , এই নামলাম । সায়েন্স বুঝেন মিয়া ?
- দোস্ত ,খেলতে খেলতে বেশী দুর যাইসনা । কোমর পানি পর্যন্ত থাকিস ।
- আরে তোরা একটু বেশী ভীতু । আমি গ্রামের পোলা , সাঁতার পারি !
- এইটা গ্রামের পুকুর না , বঙ্গোপসাগর ।
- আরো সোজা এখানে । জানস না , সমুদ্রের পানির ঘনত্ব বেশী ? তুই দেখি সায়েন্সও বুঝস না ব্যাটা !
কক্সবাজারের বিচটা হলো খাড়া বিচ । এটি সমুদ্রে বুক থেকে ফেলিন ঢেউ নিয়ে আসে, সেই সাথে পর্যটককে ভেতরে যেতে হাত ছানি দেয় । ভেতরে গেলে যেটি হয় ঢেউটি খাড়া ভাবে সমুদ্রের খাদে পড়ে যায় । সেই সাথে সলিল সমাধি ঘটে থাকে পর্যটকের ।
বাংলাদেশের সাথে পৃথিবীর অন্য সৈকতের মানুষ মারা যাওয়ার একটা পার্থক্য হল, ভাটার সময় কোন দেশের সৈকতে আপনাকে নামতেই দেবে না । কিন্তু বাংলাদেশে অনেক মানুষ, ভাটার সময় পানিতে নেমে ভেসে যায়, এই অজ্ঞানতার কারণে অনেক জীবন বিনষ্ট হচ্ছে । অবশ্য কক্সবাজার বিচে ভাটার সময় না নামার জন্য সুগন্ধা ও লাবনী পয়েন্টে লাল পতাকার নির্দেশনা দেখাবে । যেটি দেশের আর কোথাও নেই ।
ভাটার সময় সমুদ্রে নামবেননা । যদি নামেনও তবে সর্বোচ্চ ২ ফিট। এবং জোয়ারের সময় নামলেও সর্বোচ্চ ৪ ফিট পানিতে নামতে পারেন ।
মনে রাখবেন সমুদ্র সাঁতারের জায়গা পর্যটকের জন্য নয় । এটি পেশাদার সাঁতারুর জন্য হতে পারে । তাই সাঁতার থেকে বিরত থাকুন ।
সাঁতার না জানা থাকলে লাইফ জ্যাকেট পরে নিন । বাচ্চাদের অবশ্যই লাইফ জ্যাকেট ছাড়া সমুদ্রে নামতে দেয়া উচিৎ নয় । সমুদ্রে নামার আগে অবশ্যই আপনার ও পরিবারের নিরাপত্তার কথা ভাবুন ।
আর পারলে সরকারের কাছে আর্যি জানান সৈকতে নেটিংএর ব্যাবস্থা করতে ।
০৩।
- ভাই , এইখানে নাইমেননা । চোরা স্রোত আছে ।
- আরে দেখতাছেননা , এই দিকটা কিরকম শান্ত । তেমন উঁচু ঢেউ নাই । বেশি গভীরও মনে হচ্ছেনা ।
- এই জন্যই বলছি , এখানে নাইমেননা । পানির তলে উল্টা ঢেউ আপনারে টাইনা নিয়া যাবে ।
- থাকলে থাকতে পারে বাট স্রোতের বেগ একেবারেই কম মনে হচ্ছে । সাঁতার কেটেই আসা যাবে তীরে ।
- ভাই , এই স্রোতে তীরের দিকে সাঁতরাইলে আরো বিপদ ।
- ধুর ! আপনে মিয়া সায়েন্সও বুঝেননা ! ভরবেগ বুঝেন ?
চোরা স্রোত বা রিপ কারেন্ট হলো এক ধরণের ঢেউ যা সমুদ্রের তটে ধাক্কা খেয়ে, উল্টো দিকে প্রবাহিত হয় । অনেক ক্ষেত্রে এই ধাক্কা খেয়ে ফিরে যাওয়া ঢেউ বাতাস বা প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যের কারণে চিকন একটা পথ ধরে, একটা ধাক্কা দিয়ে সমুদ্রে ফিরে যেতে পারে এবং এর ফলে সেই সরু পথে যদি কেউ থাকে তবে তাকে ধাক্কা দিয়ে গভীর সমুদ্রে নিয়ে ফেলতে পারে । এই সরু পথের যে ঢেউটাকেই বলে রিপ কারেন্ট বা উল্টো স্রোত। এটা যে কোন স্থানে হতে পারে । যে কোন সমুদ্রে হতে পারে, কিন্তু কিছু কিছু জায়গায় প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যের কারণে নিয়মিত রিপ কারেন্ট বা উল্টো স্রোত হতে পারে ।
একটি পরিসংখ্যানে জানা যায়, সমুদ্র সৈকতে ৮০% মৃত্যু এই রিপ কারেন্ট বা উল্টো স্রোতের জন্যে হয়। এমনকি অস্ট্রেলিয়াতেও প্রতি বছর গড়ে ২২ জন মারা যায় রিপ কারেন্টের কারণে । বাংলাদেশেও এর ব্যাতিক্রম নয় । গতবছর আহসানুল্লাহ বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন ছাত্রের মৃত্যুর কারনও এই রিপ কারেন্ট বা চোরা স্রোত ।
রিপ কারেন্ট মূলত একই জায়গায় স্থির থাকে । তবে কক্সবাজারের মত বালুময় সৈকতে, যেকোনো স্থানের বালু সরে গিয়ে লম্বা খাঁজ তৈরি হতে পারে। আর এই খাঁজের পানির স্রোত উল্টো দিকে থাকে, আর পানিও নীলচে-শান্ত দেখায় । যা আপাত দৃষ্টিতে সাঁতারের জন্য খুবই লোভনীয় মনে হয় । তাই সাগরে গিয়ে পরিষ্কার স্রোতহীন কোন জায়গা দেখলে খুব সাবধান থাকতে হবে। তারচেয়ে সাদা পানির স্রোত অনেক নিরাপদ ।
একটা ভালো পরামর্শ হল, আতঙ্কিত না হয়ে, পাশে কোথায় সাদা পানির ঢেউ দেখা যাচ্ছে, সেদিকে সাঁতরিয়ে যান। সামনের দিকে না । শুধু শুধু শক্তি অপচয় হবে, কারণ রিপ কারেন্টের গতি, যে কোন অলিম্পিক সাতারু থেকেও বেশি। সাদা পানির দিকে গিয়ে গা ভাসিয়ে রাখলে আপনি এমনিতেই নিজে নিজে পাড়ে চলে আসবেন। রিপ কারেন্টের জায়গা খুব চিকন হয় । তাই বিপরীতে সাঁতার কাটা খুবই বোকামি ।
________________
কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত- আমাদের অহঙ্কার , আমাদের অলঙ্কার ।
পৃথিবীর দীর্ঘতম এই সমুদ্র সৈকতে প্রতিবছরই আসেন দেশি-বিদেশি লাখো পর্যটক ।
পাশাপাশি পর্যটকদের অসচেতনতা ও কর্তৃপক্ষের অব্যাবস্থাপনায় প্রতি বছরই ঝরে যায় কিছু তাজা প্রান । গতকালও কক্সবাজারের ইনানিতে দুইজন সাগরে ভেসে গেলো ।
মুলত , যারা কম জানে কিন্তু দেখায় বেশি অথবা যারা নিজেদের পুঁটি মাছের জ্ঞান নিয়ে সমুদ্র জয় করতে চায় কিংবা যারা পাইরেটস অব দ্য ক্যারিবিয়ান দেখেই মনে করে 'মুই একটা হনু' তারাই ভেসে যায় সাগরে !
এরা স্থানীয় লোকদের কথা শুনেনা , তাদের মুর্খ জ্ঞান করে , পর্যটন পুলিশদের মনে করে 'মাতব্বর' ।
জীবন সমুদ্রে এসব গাধা দুঃসাহসীদের বেঁচে থাকবার অধিকার নেই ।
সমুদ্র তাই তার বিশালতায় এদের বরণ করে নেয় প্রচন্ড উন্মত্ততায় !
সবশেষ বলছি- আয় বুঝে ব্যয় করুন , সাধ্য অনুযায়ী সাধ করুন , সামর্থ্য অনুযায়ী সাহস করুন !
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে জুলাই, ২০১৫ রাত ৩:২০