(ফয়সল আবদুল্লাহ)
প্রথম অধ্যায়
বাংলার প্রথম সায়েন্স ফিকশন নিয়ে সামান্য মতবিরোধ আছে। কারো মতে প্রথম সায়েন্স ফিকশন গল্প লিখেছেন হেমল দত্ত। গল্পের নাম 'রহস্য' (১৮৮২)। প্রকাশিত হয়েছিল তখনকার বিজ্ঞান দর্পন পত্রিকায়। তবে অনেকে সেটাকে সায়েন্স ফিকশনই বলতে নারাজ। কেননা, গল্পে নতুন কোনও আবিষ্কার কিংবা তাক লাগানোর মতো কিছু ছিল না। সেই প্রেক্ষিতে জগদীশ চন্দ্র বসুর ১৮৯৬ সালে রচিত 'নিরুদ্দেশের কাহিনী'ই বাংলার প্রথম সার্থক বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী।
সায়েন্স ফিকশনের স্রষ্টা খ্যাত আইজাক আসিমভের মতে, 'সায়েন্স ফিকশন বৈজ্ঞানিক যুক্তির বাইরের কিছু নয়। যুক্তি ও প্রমাণিত সত্যের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই সায়েন্স ফিকশন লিখতে হবে। তবে সৃষ্টিশীল তথা নতুনত্ব না থাকলে তাকে যথার্থ সায়েন্স ফিকশন বলা যাবে না।' অগত্যা 'প্রথম'-এর কৃতিত্ব সংক্রান্ত বিতর্ক ও পোস্টমর্টেম এক্ষেত্রে অবান্তর।
হেমল দত্তের 'রহস্য'র প্রেক্ষাপট ছিল মুলত সেই সময়কার কিছু নব্য আবিষ্কার ও ধারণাকে ঘিরে। যেমন, দরজার ইলেকট্রিক বেল, স্বয়ংক্রিয় ক্লিনার, চোর ধরার এলার্ম ইত্যাদি। কিন্তু তাতে আনকোরা কিছু ছিল না। লেখক জেনেশুনেই যন্ত্রগুলোর ব্যবহার লিখেছিলেন। কলকাতায় চোর ধরার এলার্ম ১৮৮০ সালেই এসেছিল। অন্যদিকে জগদীশের 'নিরুদ্দেশের কাহিনী'র বিষয়বস্তু কিছুটা অন্য ধাঁচের। এক বোতল তেল দিয়ে সাইক্লোনের হাত থেকে বাঁচার চ্যালেঞ্জ নিয়েই এ গল্প। তবে এ গল্পের বৈজ্ঞানিক যুক্তি ও সম্ভাব্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। কিন্তু ফিকশনের তখমা থাকায় সেগুলো ধোপে টেকেনি।
বাংলায় প্রথম নারী সায়েন্স ফিকশন লেখিকা হলেন বেগম রোকেয়া। মাদ্রাজ ভিত্তিক ইংরেজি ম্যাগাজিন 'ইন্ডিয়ান লেডিজ ম্যাগাজিন'-এ ১৯০৫ সাল থেকে রোকেয়ার ধারাবাহিক 'সুলতানাস ড্রিম (সুলতানার স্বপ্ন)' প্রকাশিত হয়েছিল। অবশ্য তা ইংরেজিতেই লেখা ছিল। পরে ১৯০৮ সালে এটি বই আকারে প্রকাশিত হয়েছিল।
সমকালীন আরও অনেকেই বেশ আগ্রহ নিয়ে সায়েন্স ফিকশনে মনযোগ দিয়েছিলেন। প্রেমেন্দ্র মিত্র লিখেছিলেন 'কুহকের দেশে'। শান্তিনিকেতনের শিক্ষক জগদানন্দ রায় লিখেছিলেন 'শুক্র ভ্রমণ'। তার কিছু পরে হেমেন্দ্র কুমার রায় লিখেছিলেন 'মেঘদূতের মর্ত্যে আগমণ'।
ব্যতিক্রম সুকুমার রায়। তিনি কোনও খটখটে যন্ত্রপাতি কিংবা তত্ত্বকথার মধ্যে মাত্রাতিরিক্ত নাক গলাননি। প্রযুক্তির চেয়ে মজাই তাকে বেশি টেনেছে। আর্থার কোনান ডয়েল ও এইচজি ওয়েলস তাকে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছিল। সুকুমারের 'হেঁসোরাম হুঁসিয়ারের ডায়রি' ছিল বাংলার প্রথম হাস্যরসাত্তক সায়েন্স ফিকশন। বেশ বীকট চিত্কার দেয়, তাই প্রাণীটার নাম দেয়া হল চিল্লানোসরোস (দেখতে অনেকটা টাইনাসরোসের মতো)। আর ভোদড়ের মতো দেখতে গোমরামুখো প্রাণীটার নাম গোমরাথেরিয়াম (একোরিয়াম থেকে এসেছে)। সুকুমারের চরিত্রগুলো এমনই। সায়েন্স ফিকশনে যে মজার কিছু মেশানো যেতে পারে সে পথ তিনিই দেখিয়েছেন। যা অনুসরণ করেছেন তার যোগ্য উত্তরসুরি সত্যজিত রায়। সত্যজিত তার অসামান্য চরিত্র প্রফেসর শঙ্কুকে সৃষ্টি করেছেন ১৯৬১ সালে। 'ব্যোমযাত্রীর ডায়রি' শিরোনামে সন্দেশ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছিল বিজ্ঞানী শঙ্কুর গল্প। তাতে ঢের নতুন যন্ত্রপাতি নিয়ে এসেছিলেন সত্যজিত্। প্রফেসর শঙ্কুর নিত্য ব্যবহৃত যন্ত্রগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, অ্যানিহিলিন (পিস্তল), মিরাকুরাল (সর্বরোগের মহৌষধ), ওমনিস্কোপ (টেলিস্কোপ+মাইক্রোস্কোপ), শ্যাঙ্কোপ্লেন (পরিবেশবান্ধব ও কম জ্বালানিতে চলে এমন বিমান)। সেই সময় সত্যজিতকে টপকে যেতে পারেনি কেউ। বাংলা সায়েন্স ফিকশন জগতে টানা নেতৃত্ব দিয়েছিল প্রফেসর শঙ্কু। সত্যজিত এরপর লিখেছিলেন মি. অ্যাং। সেই গল্পের পাণ্ডুলিপি পাঠিয়ে দিয়েছিলেন স্টিভেন¯স্পিলবার্গের কাছে।¯স্পিলবার্গ সেই মি. অ্যাং চরিত্রের আদলে তৈরি করলেন কালজয়ী সায়েন্স ফিকশন চলচ্চিত্র 'ইটি'।
দ্বিতীয় অধ্যায়
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের প্রথম সায়েন্স ফিকশন লিখেছেন কাজী আব্দুল হালিম। গল্পের নাম 'মহাশূন্যের কান্না'। তবে পূর্ণাঙ্গ সায়েন্স ফিকশন হিসেবে ওর ভেতর বেশকিছু সীমাবদ্ধতা ছিল। সেই হিসেবে ১৯৭৩ সালে প্রকাশিত হুমায়ুন আহমেদের 'তোমাদের জন্য ভালবাসা'ই বাংলাদেশের প্রথম পূর্ণাঙ্গ সায়েন্স ফিকশন। বেশ কিছুদিন হুমায়ুন আহমেদই এ দেশের সায়েন্স ফিকশনের হাল ধরেছিলেন। লিখেছিলেন, তারা তিন জন, ইরিনা, অনন্ত নক্ষত্র বিথী, ফিহা সমীকরণ। তবে বাংলা সায়েন্স ফিকশন যার হাত ধরে হাইপার স্পিডে ছুটে গেছে, তিনি হচ্ছেন ড. মুহাম্মদ জাফর ইকবাল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় তিনি তার প্রথম সায়েন্স ফিকশন গল্প 'কপোট্রনিক সুখ দুঃখ' লিখেছেন। রোবটিক মস্তিষ্ক 'কপোট্রন'-এর প্রবক্তা তিনি। যে কপোট্রন ফিকশনের দেয়াল টপকে স্থান পেয়েছে দেশের অনেক বিখ্যাত কবির কবিতাতেও। দেশজুড়ে তার সায়েন্স ফিকশনের রয়েছে অগণিত ভক্ত। টুকুনজিল, বিজ্ঞানী সফদর আলীর মহা মহা আবিষ্কার, সায়রা সায়েন্টিস্ট, জলমানব, ওমিক্রনিক রূপান্তর, ক্রোমিয়াম অরণ্য, নয় নয় শূন্য তিন, যারা বায়োবোট ও প্রি তার জনপ্রিয় কয়েকটি সায়েন্স ফিকশন।
এই সময়ের আরো ক'জন প্রখ্যাত বাংলাদেশী সায়েন্স ফিকশন লেখক হচ্ছেন আলী ইমাম, কাজী আনোয়ার হোসেন, অনিরুদ্ধ আলম, জুবায়দা গুলশান আরা হেনা, আমিরুল ইসলাম প্রমূখ। এছাড়া, পশ্চিমাবাংলায় অন্যান্য লেখার পাশাপাশি যারা সায়েন্স ফিকশনেও জনপ্রিয়তা কুড়িয়েছেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্যরা হলেনÑসুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, লীলা মজুমদার, কিন্নর রায়, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, সমরেশ মজুমদার ও অদ্রীশ বর্ধন। শিশু কিশোর ও তরুণদের বিজ্ঞানে আগ্রহী করতে সায়েন্স ফিকশন টনিকের কাজ করে। ফিকশন মানে তো অদেখা ভুবন। তাই সায়েন্স ফিকশন যতদিন সগৌরবে টিকে থাকবে ততদিন এ প্রজন্মের নব্য বিজ্ঞানী ও ভাবুকরা কখনোই বলবে না যে, 'সব কিছু আবিষ্কার হয়ে গেছে'।