আগের রাতে সাদামাটা চেহারার নুডলস খেয়ে বেশ ভালই একটা ঘুম হল হোটেলে । অবস্য যাত্রার ক্লান্তিও ছিল। ঘুম থেকে উঠেই চলে গেলাম হোটেলের রেস্টূরেন্টে বুফে নাস্তা খেতে। তিন থেকে পাচ তারকা খচিত হোটেলগুলোতে সাধারনত ব্রেফফাস্ট যুক্ত থাকে।। যে দেশেই আপনি যান না কেন এই হোটেলগুলোর বুফে নাস্তার আয়োজনটা বেশ রাজকীয় হয়ে থাকে। প্রচুর খাবারের আয়োজন থাকে। ওয়েস্টার্ন ও লোকাল কুজিনের সমন্বয়ে চমৎকার সব খাবারের আয়োজন দেখলাম এখানে।
প্রচুর আইটেম থাকলেও পেটতো একটাই তাই ইচ্ছা করলেও সব আইটেম চেখে দেখা সম্ভব হয় না। উপরেড় ছবিটা ডেজার্ট আইটেম এর। ডেজার্ট হিসেবে ফ্রেশ তরমুজের জুস, কাটা ফল , ফ্রট কেক নিয়ে সাদা রঙ এর একটা ডেজার্ট আইটেম দেখে মনে হল চেখে দেখি কেমন। ওমা খেয়ে দেখি আমাদের শাহী টূকরা! মুখে দিলেই মিলিয়ে যায় পাউরুটির টুকরা। তবে সাধারনত মালে বা ইন্দনেশিয়ান মিষ্টান্ন খাবা্রের স্টাইল আমাদের চাইতে একেবারেই আলাদা। আমাদের মত রসগোল্লা, কালজাম টাইপ মিষ্টির আইটেম তাদের সংস্কৃতিতে নাই। তবে পিঠার চল আছে। পিঠাকে এরা বলে কোয়ে। এরাও নাড়িকেল , গুড় , চালের গুড়া ব্যবহার করলেও এদের কোয়ে বানানোর স্টাইল আলাদা।
জাকার্তা শহরটা ঘুরে দেখার প্রত্যাশায় হোটেল রিসিপশনে জিজ্ঞাষা করলাম জাকার্তায় দর্শনীয় স্থান কি কি আছে। রিসিপশনের একটা মেয়ে বলল যে তাদের সেন্ট্রাল জাকার্তায় স্বাধীনতার স্তম্ভ (National Monument) একটা দর্শনীয় স্থান। ট্যক্সিতে করে সেখানে পৌছে দেখি সাজিয়ে গুজিয়ে রাখা অনেক ঘোড়ার গাড়ী দাঁড়িয়ে আছে। টমটম চালকেদের পোষাকও বেশ রাজকীয়। এক টমটম চালককে জিজ্ঞাষা করে জানলাম যে এক ঘন্টায় টমটম ট্রীপে সেন্ট্রাল জাকার্তার দর্শনীয় স্থানগুলো ঘুরে দেখায় তারা। বেশ চটকদার লাগল প্রস্তাবটা। তাছাড়া টমটমে চড়ার অভিজ্ঞতা আগে কখনও হয়নি। চালক আরো জানাল যে টাকা কিছু বাড়িয়ে দিলে চাইলে টমটম থেকে নেমে সেই স্থানগুলো দেখে আসাও যেতে পারে। ঘুরে ঘুরে দেখলাম ইন্দোনেশিয়ার স্বাধীনতার স্তম্ভ, প্রেসিডেন্ট এর মারদেকা প্যলেস, মিউজিয়াম , Asean হেডকোয়ার্টার সহ আরো বেশ কিছু দর্শনীয় স্থান।
ইন্দোনেশিয়ার স্বাধীনতার স্তম্ভ (National Monument) প্রেসিডেন্ট সুকর্নের আমলে তেরী শুরু হয় ১৯৬১ সালে। স্তম্ভের উপড়িভাগের মশালটা সোনার পাত দিয়ে মোড়ানো। সূর্যের আলোয় ঝিকিমিকি করে জ্বলে মশালটা। ইন্দনেশিয়ার স্থানীয় ভাষায় এই স্তম্ভকে বলা হয় মোনাস। জায়গাটা জাকার্তাবাসীদের ছুটির দিনে ঘুরে বেড়ানোর স্থান বলে মনে হল। মোনাসে ঢোকার মুখের গেটে দেখলাম পরিবার পরিজন নিয়ে ঘুরতে আসা অনেক মানুষ। টিকিট কেটে এ মনুমেন্টের ভেতরেও যাওয়া যায়।
মারদেকা প্যলেস বা প্রেসিডেন্ট এর বাসভবন। এটা টমটম থেকেই দেখেছি । টমটম চালক ব্রোকেন ইংলিশে জানালো '' cannot cannot ''। বুঝলাম যে এখানে নামা যাবে না।
টমটম চালক এরপর এসে দাড়ালো ASEAN এর হেডকোয়ার্টারের সামনে। ইঙ্গিতে বলল নামা যাবে না কেবল ছবি তোলা যাবে। ASEAN এর হেডকোয়ার্টারের জাকার্তায় অবস্থিত। ASEAN হচ্ছে দক্ষিন পুর্ব এশিয়ার দশটি রাষ্ট্র নিয়ে গঠিত একটি রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংস্থা। এর সদস্য হচ্ছে ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন, সিঙ্গাপুর , থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম , কম্বোডিয়া, লাওস, ব্রুনেই ও মিয়ানমার। আসিয়ানের মুল লক্ষ্য অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, সামাজিক অগ্রগতি ,আঞ্চলিক শান্তি ও স্থিতিশীলতা সুরক্ষা, নিয়ে সদস্য দেশগুলোর মধ্যে শান্তিপূর্ণভাবে আলোচনা করা। বর্তমানে আসিয়ানভুক্ত সবগুলো দেশের মাঝে ফ্রি ট্রেড রিলেশনশীপ থাকায় এই জোটে যোগ দেয়া সব কটি দেশ অর্থনৈতিকভাবে দারুন উপকৃত হচ্ছে। বিল্ডিংটা দেখার সময় আমাদের সাউথ এশিয়ায় গঠিত সার্ক এর কথা মনে পড়ে গেল। আসিয়ান গঠনের সুফল ভোগ করছে আসিয়ানভুক্ত সব দেশ । অথচ সার্ক সফল হয়নি!! সার্ক ব্যার্থতার দায় মুলত এই উপমহাদেশেরর ক্ষমতালোভী, দুর্নীতিপরায়ন রাস্ট্রপ্রধানদের।
টমটমে ভ্রমন শেষে আবার এসে পৌছালাম সেন্ট্রাল জাকার্তায় । দুপুর হয়ে গিয়েছিল , তাই পেটের ভেতর ছুচোর নাচন শুরু হয়ে গিয়েছিল। একটা ট্যাক্সিতে উঠে বললাম কাছাকাছি কোন শলিং মলে নিয়ে যেতে। একটা সিগনালে গাড়ী থামার পর দেখি রাস্তার পাশে এক লোক লোক সারা গায়ে সিলভার পাউডার মেখে ছোট একটা সিলভারের টুপি নিয়ে মুর্তি হয়ে বসে আছে। গাড়ী থামতেই দৌড়ে এসে টূপি বাড়িয়ে দিয়ে দাড়ালো। কিছু টাকা দিতেই আবার ফিরে গিয়ে মুর্তি রুপ ধারন করল। ভিক্ষার এই ধরনটা বেশ অভিনব লাগল।এরকম আগে আর কোথাও দেখি নাই। আমাদের দেশে রাস্তাঘাটে সর্বত্র যেভাবে ভিক্ষুকদের দেখা যায় , জাকার্তায় সেটা দেখি নাই।
দুপুরে খাবারের জন্য ঢুকলাম এক শপিংমলের রেস্তোরায়। ঘুরাঘুরির কারনে ভালই ক্ষুদার্ত ছিলাম।ইন্দোনেশিয়ান খাবার অসম্ভব ঝাল ও মজাদার। রান্নার ধরন আমাদের চেয়ে একেবারেই আলাদা। মালয়েশিয়ান খাবারের সাথে মিল আছে। ইন্দোনেশিয়ানদের ঝাল খাবার বিষয়ে একটা কথা প্রচলিত আছে যে ‘’ They drink chili ‘’ । রেস্টূরেন্টে গিয়ে অর্ডার দিলাম ইন্দোনেশিয়ান জনপ্রিয় আইটেম ayam penyet । যে দেশে আমার বসবাস সেখানেও ইন্দোনেশিয়ান এই আইটেম খুবই জনপ্রিয়। আয়াম অর্থ মুরগি। কলাপাতায় মোরা কোকোনাট বেকড রাইস , ফ্রাইড চিকেন, টফু ফ্রাই , সালাদ এবং ছোট্ট পিরিচে সামবাল। আমারা যেমন খাবারের স্বাদ বাড়াতে আচার খাই ইন্দোনেশিয়ানরা খায় সামবাল। তাদের সব খাবারে এই সামবালের উপস্থিতি থাকবেই। মালয়েশিয়ানরাও সামবাল খায়। এটা আসলে এক ধরনের মরিচ ভর্তা। এই সামবাল জিনিষটা আসলেই খুব মজাদার। এক পরিচিত ইন্দোনেশিয়ানকে একবার এর রেসিপি জিজ্ঞাসা করেছিলাম। খুব সহজ রেসিপি। আমি ট্রাই করেছিলাম বাসায়। সবুজ ও লাল রঙ এর কাচামরিচ , টম্যটো , আদা, রসুন ও পেয়াজ টুকরো আগে তেলে একটু ভেজে নিয়ে ব্লেন্ড করতে হয়। তবে খুব বেশি মিহি করে ব্লেন্ড করা যাবে না। একটু আধভাঙ্গা থাকতে হবে। এরপর এই মিশ্রনটা আবারো তেলে দিয়ে কিছুক্ষন ভাজলেই তৈরী হয়ে যায় সামবাল। এরপর ভাত, পোলাও , নুডলস, পরোটা , ভাজা খাবারের সাথে আচারের মত করে খেলে টেস্ট বেড়ে যায় খাবারের।
রাতের খাবারেও ছিল স্পাইসি সব আইটেম। চিকেন কারি, বেগুন সামবাল ( আস্ত বেগুন ভেজে তার ওপড় সাম্বাল ছড়ানো ) , বাগাডিল ( আপুর চপ), সবুজ মরিচের ভর্তা , মিষ্টি আলুর চিপস।
তথ্যসুত্র ঃ উইকিপিডিয়া
ছবি ঃ মারদেকা প্যা্লেসের ছবিটা অনলাইন থেকে নেয়া। বাকি সব ছবি আমার ক্যা্মেরায় তোলা
জাকার্তা ভ্রমন - পর্ব ১
চলবে -
( আগামী শেষ পর্বে থাকবে জাকার্তার ওল্ড টাউনে ঘুরে বেড়ানোর অভিজ্ঞতা)
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে অক্টোবর, ২০২৩ রাত ৯:৪০