আলবানী সাহেবের আসল নাম নাসিরুদ্দীন। সিরিয়ার অ ন্তর্গত আলবেনিয়ার অধিবাসী হওয়ায় তাঁকে আলবানী বলা হয়। এ নামেই তিনি সারা বিশ্বে পরিচিত। ১৩৩৩ হিজরী মোতাবেক ১৯১৪ ঈসাঈতে তিনি আলবেনিয়ার আশকুদারাহ শহরে জন্মগ্রহণ করেন। কিছু সমস্যার কারণে তাঁর পিতা আলবেনিয়া ছেড়ে সপরিবারে দামেস্ক চলে যান সাথে আলবানীকেও নিয়ে যান। আলবানী সাহেব দামেস্ক থাকাকালীন পিতার কাছে কোরআনে কারীম হিফজ করেন। দামেস্কের মাদরাসায় ইস’আফ আল খায়রিয়া’তে প্রাথমিক পড়াশোনা করেন। কিন্তু পিতৃ পেশা ঘড়ি মেরামতের কাজে সময় দেওয়ার কারণে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বা শাস্ত্রাভিজ্ঞ কোনো আলেমের তত্ত্বাবধানে মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের কিতাবাদি ও তাফসীর, হাদীস, উসূলে হাদীসের কোনো কিতাবের পাঠ গ্রহণ করার সুযোগ তাঁর হয়নি। এ বিষয়টি তাঁরই সুপরিচিত আরবের বিখ্যাত আলেমেদীন শাইখ মুহাম্মদ আওয়ামা তাঁর রচিত ‘আসারুল-হাদীস’ গ্রন্থে এভাবে ব্যক্ত করেছেন।
ﻣﻊ ﺍﻥ ﻫﺬﺍ ﺍﻟﺮﺟﻞ ﻟﻴﺲ ﻟﻪ ﻣﻦ ﺍﻟﺸﻴﻮﺥ ﺍﻻ ﺷﻴﺦ ﻭﺍﺣﺪ ﻣﻦ ﻋﻠﻤﺎﺀ ﺣﻠﺐ ﺑﺎﻹﺟﺎﺯﺓ ﻻ ﺑﺎﻟﺘﻠﻘﻰ ﻭﺍﻷﺧﺪ ﻭ ﺍﻟﻤﺼﺎﺣﺒﺔ ﻭﺍﻟﻤﻼﺯﻣﺔ، ( ﺍﺛﺮ ﺍﻟﺤﺪﻳﺚ ﺍﻟﺸﺮﻳﻒ 15- )
পাশাপাশি এই ব্যক্তির কোনো উস্তাদ ও নেই (যাঁর কাছে তিনি হাদীস পড়েছেন) শুধুমাত্র সিরিয়ার হালাব’ শহরের জনৈক আলেম তাঁকে হাদীস চর্চার মৌখিক অনুমতি দিয়েছেন। তবে তাঁর কাছেও তিনি নিয়মতান্ত্রিকভাবে হাদীস অধ্যয়ন করেননি।” (আসারুল হাদীস, পৃ. ১৫)
তাঁর এই বিষয়টি সর্বজনস্বীকৃত যে, তিনি উলূমুল হাদীসের জ্ঞান কোনো বিজ্ঞ পন্ডিতের নিকট থেকে গ্রহণ করেননি। এ ব্যাপারে নিজের অধ্যয়নই তাঁর মূল ভিত্তি। অথচ শাস্ত্রীয় ব্যাপারে সর্বজনস্বীকৃত একটি মূলনীতি, অভিজ্ঞতাও যার সাক্ষ্য প্রদান করে তা হলো যেকোনো শাস্ত্রে পরিপক্বতা অর্জনের জন্য সে শাস্ত্রের পন্ডিত ব্যক্তিদের সাহচর্য অবলম্বন করা অনিবার্য।
ব্যক্তিগত অধ্যয়নে জ্ঞানভান্ডার সমৃদ্ধ হতে পারে, কিন্তু শাস্ত্রীয় পরিপক্বতা শাস্ত্রীয় পন্ডিতের সাহচর্য ছাড়া অর্জিত হওয়া বাস্তবতার নিরিখে অসম্ভব। কিন্তু আলবানী সাহেব এই স্বীকৃত বিষয়টির কোনো তোয়াক্কা না করে নিজস্ব অধ্যয়নেই তিনি উলূমুল হাদীসের ইমাম বনে গেছেন, এমনকি তিনি রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সকল হাদীস ও হাদীসের সকল ইমামের বিচারকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন।
চিন্তা করুন, কোনো এইট পাস ব্যক্তি যদি বাজার থেকে আইনের কিছু বইপত্র ক্রয় করে নিজে নিজে অধ্যয়ন করে আন্তর্জাতিক বিচারকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় তাহলে আইনশৃঙ্খলার ক্ষেত্রে কী ধরনের নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে!
এমনিভাবে কোনো এইট পাস ছেলে যদি ডাক্তারি বইপত্র ক্রয় করে নিজে নিজে অধ্যয়ন করে বিশ্বমানের ডাক্তারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় তাহলে গোরস্তান আবাদ করা ছাড়া আর কী হওয়ার সম্ভাবনা আছে? ঠিক এই অবস্থাটাই হয়েছে জনাব আলবানী সাহেবের।
ইলমে ওয়াহীর মতো স্পর্শকাতর ও সংবেদনশীল বিষয়ে নিজস্ব অধ্যয়নের ভিত্তিতে সকলের ইমাম বনে যাওয়া ও সকল হাদীস ও হাদীসের ইমামগণের বিচারক বনে যাওয়ার ফলে ইলমী ময়দানে যে অরাজকতা ও নৈরাজ্য সৃষ্টি হয়েছে এবং দুনিয়ায় যে ফেতনা-ফ্যাসাদ জন্ম নিয়েছে তা খুবই দুঃখজনক ও মুসলিম উম্মাহর জন্য অশনিসংকেত।
এজন্য সকল মুসলিমের জন্য আলবানী সাহেবের ভ্রান্তি ও বিভ্রান্তিকর দিকগুলো সম্পর্কে সতর্ক থাকা অত্যন্ত জরুরি, যাতে মুখরোচক কোনো স্লোগান শুনে আমরা ভ্রান্ত পথের পথিক না হয়ে যাই। নিম্নে আলবানী সাহেবের ভুল-ভ্রান্তির কিছু দিক তুলে ধরা হলো :
১.
হাদীসের সহীহ-যয়ীফ, জরাহ-তাদীল ও এ শাস্ত্রের নিয়ম-কানুন প্রয়োগের ক্ষেত্রে স্ববিরোধী বক্তব্য :
হাদীসের সহীহ-যয়ীফ, জরাহ-তাদীল ও এ শাস্ত্রের নিয়ম-কানুন প্রয়োগের ক্ষেত্রে তার স্ববিরোধী বক্তব্য সংখ্যায় প্রচুর। দেখা যায়, এক স্থানে তিনি একটি হাদীসকে সহীহ বলেছেন তো অন্য স্থানে সেটিকেই হাসান বা যয়ীফ বলেছেন। আবার এক স্থানে কোনো বর্ণনাকারীকে নির্ভরযোগ্য বলেছেন তো অন্য স্থানে তাকে যয়ীফ (দুর্বল) বলেছেন।
তার এ ধরনের স্ববিরোধী বক্তব্য একত্রিত করে শায়েখ হাসান সাক্কাফ
ﺗﻨﺎﻗﻀﺎﺕ ﺍﻻﻟﺒﺎﻧﻰ ﺍﻟﻮﺍﺿﺤﺎﺕ (আলবানীর স্পষ্ট স্ববিরোধিতাসমূহ) নামে ২ খন্ডের একটি গ্রন্থ রচনা করেছেন।
আবার দেখা গেছে, কোনো বর্ণনাকারীর ব্যাপারে তাঁর ধারণা পূর্বে এক রকম ছিল; কিন্তু পরে তাতে পরিবর্তন এসেছে। এ জাতীয় বিষয়াদিকে শায়খ আবুল হাসান মুহাম্মদ তাঁর
ﺗﺮﺍﺟﻊ ﺍﻟﻌﻼﻣﺔ ﺍﻷﻟﺒﺎﻧﻰ ﻓﻴﻤﺎ ﻧﺺ ﻋﻠﻴﻪ ﺗﺼﺤﻴﺤﺎ ﻭﺗﻀﻌﻴﻔﺎ কিতাবে উল্লেখ করেছেন। তাঁর এ জাতীয় স্ববিরোধিতা সর্বমোট ২২২টি হাদীসের ক্ষেত্রে পরিলক্ষিত হয়েছে।
২.
ইজতেহাদী বিষয়াদিতে অসহিষ্ণুতা :
শাস্ত্রজ্ঞ ইমামগণ এ বাপ্যারে ঐকমত্য পোষণ করেছেন পূর্ণভাবে স্বীকৃত যে, হাদীস ভান্ডারে বিদ্যমান হাদীসসমূহ সহীহ বা যয়ীফ হওয়ার বিবেচনায় তিন ভাগে বিভক্ত :
এক.
যেসব হাদীস সহীহ হওয়ার ব্যাপারে সকল ইমাম একমত হয়েছেন।
দুই.
যেসব বর্ণনা যয়ীফ বা মাতরুক (পরিত্যাজ্য) হওয়ার ব্যাপারে সকলে একমত হয়েছেন ।
তিন.
যেসব বর্ণনা সহীহ বা যয়ীফ হওয়ার ব্যাপারে ইমামগণের মতপার্থক্য দেখা দিয়েছে।
বাস্তবতার নিরিখেও হাদীসের এই প্রকার তিনটি সুস্পষ্ট। এর মধ্যে প্রথম দুই প্রকার হাদীসের বিষয়টি সহজ ও পরিষ্কার। কিন্তু আলবানী সাহেব তাঁর ‘সিলসিলাতুল আহাদীস’কে এই দুই প্রকারের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখেননি। তিনি তাঁর কিতাবে যথারীতি শেষোক্ত প্রকারের হাদীস প্রচুর পরিমাণে উল্লেখ করেছেন। অথচ এই তৃতীয় শ্রেণীর হাদীসের ব্যাপারে শাস্ত্র ও বিবেকের সিদ্ধান্ত হলো শাস্ত্রজ্ঞ ব্যক্তি তাহকীক ও গবেষণার ভিত্তিতে যে মতটিকে সঠিক বা বিশুদ্ধ মনে করবেন, তিনি সেই মতটি অবলম্বন করবেন। আর যারা শাস্ত্র বিষেশজ্ঞ নন, তাঁরা কোনো শাস্ত্রজ্ঞের তাকলীদ বা অনুসরণ করবেন। তবে অনুসরণের ক্ষেত্রে লক্ষ রাখতে হবে, মতটি যেন কোনো পন্ডিতের পদস্খলন না হয়।
ইমাম বাইহাকী (রহ.) (মৃত্যু ৪৫৮হি.) তাঁর ‘দালায়েলুন নুবুওয়্যাহ’-এর ভূমিকায় এ বিষয়টি নিম্নোক্ত ভাষায় উল্লেখ করেছেন :
ﻭﺃﻣﺎ ﺍﻟﻨﻮﻉ ﺍﻟﺜﺎﻟﺚ ﻣﻦ ﺍﻷﺣﺎﺩﻳﺚ ﻓﻬﻮ ﺣﺪﻳﺚ ﻗﺪ ﺍﺧﺘﻠﻒ ﺍﻫﻞ ﺍﻟﻌﻠﻢ ﺑﺎﻟﺤﺪﻳﺚ ﻓﻰ ﺛﺒﻮﺗﻪ ﻓﻬﺬﺍ ﺍﻟﺬﻯ ﻳﺠﺐ ﻋﻠﻰ ﺃﻫﻞ ﺍﻟﻌﻠﻢ ﺑﺎﻟﺤﺪﻳﺚ ﺑﻌﺪﻫﻢ ﺃﻥ ﻳﻨﻈﺮﻭﺍ ﻓﻰ ﺍﺧﺘﻼﻓﻬﻢ ﻭﻳﺠﺘﻬﺪﻭﺍ ﻓﻰ ﻣﻌﺮﻓﺔ ﻣﻌﺎﻧﻴﻬﻢ ﻓﻰ ﺍﻟﻘﺒﻮﻝ ﻭﺍﻟﺮﺩ ﺛﻢ ﻳﺨﺘﺎﺭﻭﺍ ﻣﻦ ﺃﻗﺎﻭﻳﻠﻬﻢ ﺍﺻﺤﻬﺎ ﻭﺑﺎﻟﻠﻪ ﺍﻟﺘﻮﻓﻴﻖ
উম্মাহর আলেমগণের কর্মনীতিও সর্বযুগে এই ছিল যে, এ প্রকারের হাদীসসমূহে বিশেষজ্ঞদের মতপার্থক্য যেহেতু সাধারণ ব্যাপার, তাই প্রত্যেকেই অপরের মতের ব্যাপারে সহিষ্ণুতা প্রদর্শন করেছেন। যাঁর বিচার-বিবেচনায় হাদীসটিকে সহীহ মনে হয় তিনি হাদীসটিকে মাস’আলার ভিত্তিরূপে গ্রহণ করেন আর যাঁর বিবেচনায় হাদীসটিকে সহীহ মনে হয় না, তিনি একে মাস’আলার ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করেন না। এ ক্ষেত্রে গ্রহণ-অগ্রহণ উভয়টিই ইজতিহাদের ভিত্তিতে হয়ে থাকে। আর এ জন্যই প্রত্যেককে অপরের মতের ব্যাপারে শ্রদ্ধাশীল ও সহিষ্ণু হতে হয়।
আমাদের পূর্ববর্তী ইমামগণ এমনই ছিলেন। আলোচ্য ক্ষেত্রে নিজের মতটিকে চূড়ান্ত মনে করা বা যথাযথ দলিলভিত্তিক সমালোচনার ব্যাপারে অসহিষ্ণু হওয়া এবং সমালোচককে কটাক্ষ ও গালাগাল করা কিংবা নিজের সিদ্ধান্তকে অন্য সকলের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার মানসিকতা পোষণ করা যে অত্যন্ত গর্হিত কাজ, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু দুঃখজনক ব্যাপার হলো, আলবানী সাহেব ও তাঁর বিশিষ্ট ভক্ত-অনুরক্ত সকলেই এ গর্হিত কাজটিতে লিপ্ত হয়ে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলেছেন। সিলসিলাতুয যয়ীফা সিলসিলাতুস সহীহা এবং তাঁর অন্যান্য রচনার ভূমিকা পড়লে একজন নিরপেক্ষ পাঠকের মনে এ ধারণাই সৃষ্টি হয় যে, তাঁর সিদ্ধান্তের সাথে একমত না হওয়াই অমার্জনীয় অপরাধ এবং এই অপরাধে অপরাধী ব্যক্তি তাঁর পক্ষ থেকে যেকোনো ধরনের (শ্রব্য-অশ্রাব্য) সম্বোধনের উপযুক্ত হতে পারে।
৩.
যয়ীফ হাদীসের ব্যাপারে আলবানী সাহেবের যয়ীফ অবস্থান :
আলবানী সাহেব যয়ীফ হাদীসকে একদম অনর্থক মনে করেন। তাঁর মতে, যয়ীফ হাদীসের যতগুলো প্রকার আছে তার কোনোটিই কোনো ক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য নয়। তিনি তাঁর কিতাবে যয়ীফ ও মওযু (দুর্বল ও জাল) উভয়টিকে একই শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত করেছেন এবং উচ্চ কণ্ঠে এ ঘোষণা দিয়েছেন যে, যয়ীফ সর্বক্ষেত্রেই পরিত্যাজ্য। অর্থাৎ এটা না ফাজায়েলের ক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য, না মুস্তাহাব বিষয়াদির ক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য, আর না অন্য কোনো ক্ষেত্রে। সহীহুল জামিইস সগীর ওয়া যিয়াদাতিহী, পৃ. ১৫০
অথচ এই মতটি সালাফ ও সালাফের সর্ববাদী নীতিমালার সুস্পষ্ট বিরোধী। জমহুরে সালাফ ও খালাফের ইজমা বা ঐকমত্যের খেলাফ হওয়া তো অতি স্পষ্ট এবং সর্বজনবিদিত;
বাস্তব কথা হলো, তা সকল সালাফ ও খালাফের ইজমারই পরিপন্থী। যয়ীফ হাদীস কোনোক্রমেই কাজের নয়; বরং তা বিলকুল অকেজো আলবানী সাহেবের এই মতটি অবলম্বন করেছেন সালাফ ও খালাফের কারো থেকেই প্রমাণিত নয়। তাঁরা সকলেই যয়ীফ হাদীসকে ফজীলতের ব্যাপারে গ্রহণ করেছেন। এমনকি কোনো বিষয়ে সহীহ হাদীস না থাকলে যয়ীফ হাদীস দ্বারা বিধিবিধান প্রমাণ করেছেন এবং যয়ীফ হাদীসকে কিয়াসের ওপরে মর্যাদা দিয়েছেন। Ñআল কাউলুল বদি ফিস সালাতি আলাল হাবিবিশ শাফিঈ, হাফেয সাখাবী, পৃ. ৪৭৩
৪.
শুযুয তথা উম্মতের ঐকমত্য থেকে বিচ্যুতি :
আলবানী সাহেবের আলোচনা পর্যালোচনা শুধু হাদীসের তাসহীহ ও তাযয়ীফের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি বরং তিনি তাঁর রচনাসমূহের বিভিন্ন স্থানে ফিকহ, আকাঈদ ও অন্যান্য শাস্ত্রের বিভিন্ন বিষয়ে স্বাধীন এমনকি এক ধরনের বিচারকসুলভ পর্যালোচনা করেছেন। আর এ ক্ষেত্রে তিনি কোনো বিচ্ছিন্ন মত গ্রহণ করতে বা কোনো মনীষীর ভ্রান্তি বা বিচ্ছিন্ন সিদ্ধান্তকে জীবিতও করতে কোনো দ্বিধা করেননি। অথচ ইজমায়ে উম্মত ও খোলাফায়ে রাশেদীনের যুগ থেকে চলে আসা উম্মাহর অবিচ্ছিন্ন কর্মধারা থেকে বিচ্ছিন্ন কোনো মত পোষণ করা অত্যন্ত জঘন্য অপরাধ। এ ব্যাপারে শরীয়তের প্রমাণাদি, সাহাবায়ে কেরাম, তাবেঈন এবং পরবর্তী আসলাফে উম্মাহর সিদ্ধান্ত ও বক্তব্য জ্ঞানী ব্যক্তিদের অজানা নয়। এ প্রসঙ্গে ইবনে আব্দুল বার (রহ.) প্রণীত ﺟﺎﻣﻊ ﺑﻴﺎﻥ ﺍﻟﻌﻠﻢ ২/১৩০ এবং
ইবনে রজব দামেশ্কী (রহ.)-এর ﺷﺮﺡ ﻋﻠﻞ ﺍﻟﺘﺮﻣﺬﻯ বিশেষভাবে অধ্যয়নযোগ্য।
যেসব ভ্রান্তি ও বিচ্ছিন্ন মতের উদ্ভাবন বা পৃষ্ঠপোষকতা আলবানী সাহেব করেছেন তার কিছু দৃষ্টান্ত লক্ষ করুন!
১.
তাঁর মতে, মহিলাদের জন্য স্বর্ণের আংটি ও অন্যান্য স্বর্ণবালা ব্যবহার করা হারাম
অথচ মহিলাদের জন্য স্বর্ণের সব ধরনের অলংকার বৈধ, চাই তা বলয়াকৃতির হোক বা অন্য আকৃতির হোক।
২.
তাঁর মতে তারাবীর নামায ৮ রাক’আত সুন্নাত আর ২০ রাক’আত বিদ’আত।
অথচ উম্মতের অবিচ্ছিন্ন কর্মধারার মাধ্যমে তারাবীর নামায ২০ রাক’আত প্রমাণিত, যা ১৪০০ বছর যাবত হারামাইন শরীফাইনসহ বিশ্বের বড় বড় সব শহরে প্রচলিত আছে।
৩.
তাঁর মতে, এক মজলিসে তিন তালাক দিলে এক তালাক গণ্য হবে
অথচ এই মতটি সহীহ হাদীস ও ইজমা পরিপন্থী।
৪.
তাঁর মতে, সুব্হাহ (তাসবিহ) দ্বারা যিকির-আযকার গণনা করা বিদ’আত।
অথচ এটি সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত।
ফিকহ, ইলমে হাদীস ও অন্যান্য বিষয়ে আলবানী সাহেবের বিচ্ছিন্ন মতামতের সংখ্যা প্রচুর। কিন্তু কিছু স্থূলদৃষ্টি ব্যক্তিবর্গ ও তাঁর কিছু অন্ধ ভক্ত তাঁর এই বিচ্ছিন্ন মতামতগুলোকে মুসলিম সমাজের মাঝে প্রচার করে ফেতনা-ফ্যাসাদ সৃষ্টি করছে। আল্লাহ তা’আলা সবাইকে সহীহ বুঝ দান করুন।
শাইখ মাহমুদ রচিত তাম্বীহুল মুসলিম গ্রন্থের ২০৫ নং পৃষ্ঠায় আলবানী সাহেবের ভুল-ভ্রান্তির ফিরিস্তি এভাবে বর্ণিত আছে :
ﺍﻗﻮﻝ ﻫﺬﺍ ﺑﻤﻨﺎﺳﺒﺔ ﻋﺎﺩﺓ ﺍﻷﻟﺒﺎﻧﻰ ﻣﻊ ﻣﺨﺎﻟﻔﻴﺔ
মর্মার্থ: আলবানী সাহেব তাঁর মতাদর্শের বিরোধী ব্যক্তির সঙ্গে যে আচরণ করেন সে প্রসঙ্গে কিছু বলা জরুরি মনে করছি। আলবানী সাহেব যখন কাউকে তাঁর প্রতিপক্ষ ভাবেন তখন তাঁর কথা সামনে এলে তিনি দাঁড়াবেন, বসবেন, কাঁপতে থাকবেন, ধমক দেবেন। তাঁর বই পড়তে গেলে আপনারা এ সত্যতার প্রমাণ পাবেন এবং তাঁর আক্রমণের স্বরূপ দেখবেন। তিনি প্রতিপক্ষ বিজ্ঞ আলেমদের ধ্বংসের দু’আ করেন। তাঁদের মিথ্যুক, মুশরিক, প্রতারক বলেও গালি দেন। কোনো কোনো প্রতিপক্ষকে কাফেরও বলে ফেলেন। আবার কাউকে তিনি চক্রান্তকারী, মুনাফিক, খবিশ, গোমরাহ ইত্যাদি বলতে কুণ্ঠাবোধ করেন না। তাঁর ন্যক্কারজনক কর্মকা-ের শীর্ষে রয়েছে, ইমাম আহমাদ (রহ.)-কে বিদ’আতী বলে গালি দেওয়া। আলবানী সাহেব তার এই বিতর্কিত কর্মপদ্ধতি ও গর্হিত আচার আচরণের কারণে সিরিয়ার মুসলিম জনতার আন্দোলনের মুখে সিরিয়া থেকে বহিষ্কৃত হন। এরপর তিনি সৌদি আরবে চলে যান এবং সেখানেও এই একই কারণে আলেম-ওলামা ও জনগণের রোষানলে পড়েন। তাদের আন্দোলনের মুখে সৌদি আরব থেকেও তিনি বিতাড়িত হন। ১৯৯১ ইং সালে সরকারি নির্দেশে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তাঁকে সৌদি আরবের মাটি ছাড়তে হয়। এরপর তিনি জর্ডানে আশ্রয় নেন এবং জর্ডানেই শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
জর্ডানের সচেতন আলেমগণও তাঁর ভ্রান্ত কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠেছিলেন। (আল ইত্তিজাহাতুল হাদীসিয়্যাহ, মুহাম্মদ ইবনে সাঈদ মুহাম্মদ)
আলবানী সাহেবের ভ্রান্তিসমূহের খ-নে নির্ভরযোগ্য আলেমগণের কিছু কিতাব :
এই সংক্ষিপ্ত প্রবন্ধে আলবানী সাহেবের সব ভুলভ্রান্তি তুলে ধরা সম্ভব নয়। কারণ, তাঁর পরিমাণ এত বেশি যে এগুলোর সংকলনে বিজ্ঞ আলেমগণ হাজার হাজার পৃষ্ঠার স্বতন্ত্র গ্রন্থ রচনা করেছেন। এ ব্যাপারে বিস্তারিত জানতে নিম্নোক্ত কিতাবগুলো পড়া যেতে পারে।
১
ﺍﻻﺑﺎﻧﻰ ﺷﺬﻭﺫﻩ ﻭﺃﺧﻄﺎﺋﻪ
মুহাদ্দিস হাবীবুর রহমান আযমী।
২
ﺗﺼﺤﻴﺢ ﺻﻼﺓ ﺍﻟﺘﺮﺍﻭﻳﺢ ﻋﺸﺮﻳﻦ ﺭﻛﻌﺔ ﻭﺍﻟﺮﺩ ﻋﻠﻰ ﺍﻷﻟﺒﺎﻧﻰ ﻓﻰ ﺗﻀﻌﻴﻔﻪ
শায়খ ইসমাঈল আনসারী (রহ.) সাবেক গবেষক, দারুল ইফতা, সৌদি আরব।
৩
ﺇﺑﺎﺣﺔ ﺍﻟﺘﺤﻠﻰ ﺑﺎﻟﺬﻫﺐ ﺍﻟﻤﻌﻠﻖ ﻟﻠﻨﺴﺎﺀ ﻭﺍﻟﺮﺩ ﻓﻰ ﺗﺤﺮﻳﻤﻪ ﻋﻠﻰ ﺍﻷﻟﺒﺎﻧﻰ
শায়খ ইসমাঈল আনসারী (রহ.)
৪
ﺍﻟﺼﺎﺭﻡ ﺍﻟﻤﺸﻬﻮﺭ ﻋﻠﻰ ﺃﻫﻞ ﺍﻟﺘﺒﺮﺝ ﻭﺍﻟﺴﻔﻮﺭ ﻭﻓﻴﻪ ﺍﻟﺮﺩ ﻋﻠﻰ ﻛﺘﺎﺏ ﺍﻟﺤﺠﺎﺏ ﻟﻸﻟﺒﺎﻧﻰ
শায়খ হামুদ তুযাইজারী, সৌদি আরব।
৫
ﺍﻟﻨﻘﺪ ﺍﻟﺒﻨﺎﺀ ﻟﺤﺪﻳﺚ ﺃﺳﻤﺎﺀ ﻓﻰ ﻛﺸﻒ ﺍﻟﻮﺟﻪ ﻭﺍﻟﻜﻔﻴﻦ ﻟﻠﻨﺴﺎﺀ
আবু মুয়াজ তারিক বিন আউযুল্লাহ, বিশেষ ছাত্র, শায়খ আলবানী।
৬
ﻭﻳﻠﻚ ﺁﻣﻦ
আহমাদ আব্দুল গফুর
৭
ﻭﺻﻮﻝ ﺍﻟﺘﻬﺎﻧﻰ ﺑﺈﺛﺒﺎﺕ ﺳﻨﻴﺔ ﺍﻟﺴﺒﻌﺔ ﻭﺍﻟﺮﺩ ﻋﻠﻰ ﺍﻷﺑﺎﻧﻰ
মাহমুদ সাঈদ মামদূহ, মিসর।
৮
ﺗﻨﺒﻴﻪ ﺍﻟﻤﺴﻠﻢ ﺇﻟﻰ ﺗﻌﺪﻯ ﺍﻷﺑﺎﻧﻰ ﻋﻠﻰ ﺻﺤﻴﺢ ﻣﺴﻠﻢ
মাহমুদ সাঈদ মামদূহ, মিসর।
৯
ﺍﻟﺘﻌﺮﻳﻒ ﺑﺄﻭﻫﺎﻡ ﻣﻦ ﻗﺴﻢ ﺍﻟﺴﻨﻦ ﺇﻟﻰ ﺻﺤﻴﺢ ﻭﺿﻌﻴﻒ
মাহমুদ সাঈদ মামদূহ, মিসর।
১০
ﺍﻟﻘﻮﻝ ﺍﻟﻤﻘﻨﻊ ﻓﻰ ﺍﻟﺮﺩ ﻋﻠﻰ ﺍﻷﺑﺎﻧﻰ ﺍﻟﻤﺒﺘﺪﻉ
শায়খ আব্দুল্লাহ ইবনে সিদ্দীক আল গুমারী (রহ.)