ডাক্তার বাবু উবাচ
দেবশ্রী চক্রবর্ত্তী
২০১২ সালের জুন মাসে আমার প্রেগনেন্সি টেস্ট পজিটিভ আসে । সেই সময় আমার কাজের মেয়েটির বিয়ে হয়ে যাওয়ায় আমাকে বাড়ীর
সব কাজ নিজেকেই করতে হত । ওয়াসিং মেশিন না থাকায় বড় বড় ভারি চাদর থেকে সব কিছু নিজেই কাচতাম এবং প্রথম প্রগনেন্সিতে যখন কোন সমস্যা
হয় নি তখন এই প্রেনেন্সিটাকেও স্বাভাবিক ভাবে নিই । ২৪ এ জুন সকালবেলা আমি হাল্কা ব্লিডিং অনুভব করি এবং সময় নষ্ট না করে আমরা বর্ধমান মেডিকেল
কলেজের গাইনোকোলজি ডিপার্টমেন্টের একজন নামী মহিলা ডাক্তারের কাছে যাই । ভদ্রমহিলা আমাকে কোন রকম ওষুধ দিয়ে ব্লিডিং বন্ধের চেষ্টা না করে আমাদের বলেন ভ্রূণটাকে
বের করে দিতে হবে এবং এটা ভেতরে থাকলে গুরুতর সমস্যা দেখা দেবে ।আমি ভীষণভাবে ভেঙ্গে পরি এবং কিছুতেই পরিস্থিতিকে মেনে নিতে পারি না । আমার স্বামী মহিলা ডাক্তারের কথা
বিশ্বাস করে আমাকে কোন রকম রাজি করান । পরের দিন বর্ধমানে একটি বেসরকারি নার্সিং হোমে আমাকে ডেকে পাঠান হয় এবং আমি সেখানে গিয়ে দেখি আমার মতন বেশ কয়েকজনকে একই উদ্দেশ্যে
উনি ডেকে পাঠিয়েছেন এবং সবার পর আমার ডাক পরে । আমি যখন O.T তে ঢুকি সেই মূহুর্তে আমি দেখি এক সদ্য জাত শিশু শুয়ে কাঁদছে । তাকে সরিয়ে দিয়ে আমাকে অপরেশান টেবিলে শুতে বলা হয়
এবং আমাকে জিজ্ঞাসা করা হয় যে আমার শ্বাসটানের সমস্যা আছে নাকি । আমার সমস্যা থাকায় ওরা আমাকে অক্সিজেন দেয়, কিন্তু আমি বুঝতে পারি যে কোন অক্সিজেন আমার নাকে ঢুকছে না । কিছুক্ষণ পর
আমাকে একটা ইনজেকশন দেওয়া হয় এবং এরপর আমার আর কিছুই মনে নেই । এই ঘটনার পর টানা তিন মাস আমার ব্লিডিং হয় । মহিলা ডাক্তার বারবার ডেকে পাঠায় আর ওষুধ দেয় । কিন্তু কিছুতেই ব্লিডিং
বন্ধ আর হয় না । এই সময় যারা আমাকে দেখেছে তারা জানে যে আমি মানসিকভাবে ভীষণ ভেঙ্গে পরে ছিলাম আর আমার শরীরটা পুরো সাদা হয়ে গেছিল । এই সময় আমি কলকাতায় ডঃ সৌমেন মিত্রের কাছে দেখাই
এবং ডাক্তারবাবু আমাকে একটা ওষুধ দেন যেটা খাবার পর আমার ব্লিডিং দিয়ে একটা মাংস পিণ্ড বের হয় । দীর্ঘ চার মাস এক ভয়ঙ্কর শারীরিক ও মানসিক যন্ত্রণা ভোগার পর আমার ব্লিডিং বন্ধ হয় । ডঃ সৌমেন মিত্রের কাছ
থেকে জানতে পারি যে ব্লিডিংটা যখন শুরু হয় ওষুধ দিয়ে সেটা আটকান যেত এবং বাচ্চাটাকেও রাখা যেত । কিন্তু অল্প কিছু টাকার লোভে আমার অ্যাবোসান করান হয় ।
পরে ভদ্রমহিলার বিরুদ্ধে যখন খোঁজখবর শুরু হয় জানা যায় যে উনি সরকারি হাসপাতালের ডাক্তার হয়েও প্রাইভেট নার্সিং হোম গুলোতে এবং প্রাইভেট চেম্বারে রুগী দেখেন । শুধু তাই না উনি পয়সার জন্য বহু কুকর্মও করেন ।
বেশ কিছু দিন সাসপেন্ড ছিলেন । এখন তার কি খবর আমরা কেউ জানি না ।
এই প্রসঙ্গে আমার আরেকটা ঘটনার কথা মনে পড়ছে , ২০০৫ সালে আমার মেয়ে হয় এবং বাচ্চা হবার একবছর পর ধরা পরে যে আমার কোমরের হাড় পোঁচে যাচ্ছে । সেই সময় মালদায় আমরা এক ডাক্তারকে দেখাই এবং সেই ডাক্তার
আমাকে বলেন যে ওনার মনে হচ্ছে হাড়ে ক্যানসার হয়েছে । ক্যানসার এমন একটা অসুখ যে মানুষ তার নাম শুনলে এমনিতেই অর্ধেক শেষ হয়ে যায় । আমার ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয় নি । আমি মানসিক যন্ত্রণায় শেষ হয়ে যাচ্ছিলাম ।
বিছানা থেকে উঠতে পারতাম না,টয়লেটে যাবার সময় যদিও বা উঠতাম দেওয়াল ধরে ধরে আমাকে বাথরুমে যেতে হত । সেই সময় আমার বাবা আমাকে কলকাতায় নিয়ে এসে পিয়ারলেস হসপিটাল এ ডঃ রনেন রায় কে দেখান । ডাক্তার রায়
আমাকে MRI করতে বলেন এবং MRI REPORT এ আমার BONE TB ধরা পরে । দীর্ঘ ১৯ মাস ট্রিটমেন্টের পর আমি এই রোগ থেকে মুক্তি পাই । ডাঃ রায় আমাকে এক নতুন জীবন দেয় , আমার এক বছরের ফ্রুটিকেও মাকে হারাতে
হয় না ।
পাঠকরা হয়ত ভাবছেন আমি কেন এসব কথা লিখছি । শুধু শুধু লিখছি না, এর পেছনে কারণ আছে । গতকাল আনন্দবাজার পত্রিকায় একটা রিপোর্ট পড়লাম, গুয়াহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপিকা অনামিকা রায় গল ব্লাডারের চিকিৎসা
করাতে ভর্তি হন দিল্লির একটি হাসপাতালে । যেখানে অপরেশানের পর অনামিকা দেবীর অবস্থা খারাপ হতে থাকে এবং হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ অনামিকা দেবীর স্বামীকে কিছু না জানিয়ে তাকে অন্য একটি হাসপাতালে ভর্তি করে । সেখানে অনামিকা দেবীর মৃত্যু
হয় । ডেথ সার্টিফিকেটে মৃত্যুর কারণ হিসেবে কিছু লেখা না থাকায় অনামিকা দেবীর স্বামী হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে তার কারণ জিজ্ঞাসা করলে তারা বলেন হার্ট এ্যাটাকে মৃত্যু হয়েছে । কিন্তু অনামিকা দেবীর হার্টের কোন সমস্যা ছিল না বলেই জানা গেছে, তবে
মৃত্যুর কারণ টা আসলে কি ? চিকিৎসায় গাফিলতি ?
আমি ব্যক্তিগতভাবে কয়েকজন ডাক্তারকে চিনি যারা সরকারি হাসপাতালের ডাক্তার হয়েও হাসপাতালে রুগী না দেখে তাঁদের প্রাইভেট চেম্বার গুলোতে রুগী দেখেন এবং মোটা অঙ্কের টাকা আদায় করেন । প্রশাসনের তরফ থেকে যখন তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়
তখন রুগীরাই এসে বলেন , "ডাক্তারবাবুরা তো হাসপাতালে ভালোকরে দেখেন না,বায়রে চেম্বারে যদি টাকা নিয়ে দেখেন তো দেখুন না,এরা চলে গেলে গ্রাম গঞ্জে আমরা আর ডাক্তার পাব কৈ " ।
সরকারি হাসপাতাল গুলোতে নকল ওষুধের ব্যবসা রমরমিয়ে চলে । আপনাদের মনে আছে ডাঃ চন্দন সেনকে ? রানাঘাট হাসপাতালে নকল ওষুধের কারবার চলত এবং তাতে বেশ কিছু ডাক্তার জড়িয়ে ছিলেন । এই খবর ডাক্তার চন্দন সেন জেনে
ফেলেছিলেন এবং তার প্রতিবাদ করায় চন্দন সেন কে খুন হতে হয় । চন্দন সেনের মতন বহু প্রতিবাদী মানুষ রয়েছেন এবং কিন্তু তাঁরা শুধুমাত্র প্রাণের ভয়ে প্রতিবাদ করতে ভয় পান ।
আমার এক ভাই আছে, ওর নাম অমিত পাল । বর্ধমানের কাটোয়ায় অমিতদের বাড়ী অমিতের বাবা গত বছর গলার ব্যথা নিয়ে এক ডাক্তারের কাছে যান । ডাক্তার বাবু নানা রকম পরীক্ষা করে জানান যে অমিতের বাবার ক্যানসার হয়েছে এবং একেবারে ফোর্থ স্টেজ চলছে ।
অমিত আর বিন্দুমাত্র দেড়ি না করে বাবাকে নিয়ে সুদূর কর্ণাটকে ব্যাঙ্গালোরে একটা হাসপাতালে নিয়ে যায় । সেখানে ডাঃ অমিত রেড্ডি কাকুর সব টেস্ট করে অমিতকে জানায় যে সবে ক্যানসারটা করেছে । কোন সমস্যা নেই চিকিৎসা করলে ঠিক হয়ে যাবে । কাকুর অপরেশান সফল
ভাবে হয় । কাকু এখন পুরোপুরি সুস্থ ।এরকম ঘটনা ভাতাড়ের কৌশিক দত্তের মায়ের সাথেও হয়েছিল । কৌশিকের মা গল ব্লাডারে ক্যানসার নিয়ে ভর্তি হয় কলকাতার নামী এক ক্যানসার হাসপাতালে । সেখানে শুধুমাত্র ভুল কেমোথেরাপি করে কৌশিকের মা কে ফেরে ফেলেন এক স্বনামধন্য
ডাক্তার বাবু । মৃতমায়ের বেডের পাশে যখন ছেলে বসে আছেন তখন ডাক্তার বাবু তাঁর চেম্বারে কৌশিককে ডেকে এক লম্বা বিল ধরিয়ে দেন এবং বলেন এক ঘণ্টার মধ্যে পুরো টাকাটা শোধ করে দেবেন।
আমি ডাক্তার বাবুদের একটাই কথা বলতে চই মানুষ যখন অসুস্থ হয় তখন সে সুস্থ হতে চাই । আপনারাই তখন তাদের কাছে ভগবান । তাঁরা ভাবে এই মানুষটার ছোঁয়ায় আমরা সুস্থ হয়ে যাব । তাই বলছি কয়েকটা পয়সার জন্য মানুষের প্রাণ নিয়ে দয়া করে খেলবেন না । ভগবানের কাজ
মূমূর্ষকে প্রাণ দান করা । কেড়ে নেওয়া না ।
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ সকাল ১০:৫১