[শাহবাগ প্রজন্ম চত্বরের আন্দোলন দখল, আস্তিক-নাস্তিক বিভ্রান্তি, জামাত-শিবিরের তাণ্ডব আর আন্দোলনকারীদের মাঝে বিভক্তি ছড়ানোর অপচেষ্টা দেখে যারা হতাশ হয়ে যাচ্ছেন, তাদের জন্য ক্ষুদ্র সামর্থ্যের সামান্য প্রচেষ্টা।]
যুদ্ধ কোন ফুলশয্যা নয়। যুদ্ধ কোন মিলনাত্মক সিনেমা নয় যেখানে সিনেমার শেষে সবাই পরিবার-পরিজন-আণ্ডাবাচ্চা নিয়ে সুখে শান্তিতে বসবাস করতে থাকবে। যুদ্ধ কোন রোমান্টিক মধ্যযুগীয় পটভূমির উপন্যাস নয় যেখানে নায়ক একাই হাজার শত্রু খতম করে নায়িকাকে ঘোড়ায় চড়িয়ে রাজপ্রাসাদে নিয়ে যাবে। যুদ্ধ কোন রূপকথা নয় যেখানে রাক্ষস-খোক্কস সব রাজপুত্রের তরোয়ালে কাটা পড়বে। যুদ্ধ যুদ্ধের মতই, যুদ্ধের মত আর কিছু নয়, আর কোন কিছু যুদ্ধের মত নয়। এখানে রাজপুত্র জেতে, এখানে রাক্ষসও জেতে, এখানে রাজপুত্র-ও রাক্ষস হয়, নিষ্ঠুর হয়। যুদ্ধে কেউ নিয়ম মেনে খেলে না, কারণ যুদ্ধ কোন খেলা নয়। এখানে আপনি বাঁচবেন অথবা মরবেন আর আপনার সাথে বাঁচবে অথবা মরবে আরো লক্ষ লক্ষ মানুষ। যুদ্ধ সবসময়-ই এমন ছিল, অতীতে, বর্তমানে, ভবিষ্যতেও। যুদ্ধের কোন নরমপন্থা ছিল না, নেই, থাকবে না।
যুদ্ধের কি কোন প্রয়োজন ছিল, বা আছে? অমীমাংসিত প্রশ্ন। কেউ আদর্শের নামে যুদ্ধ করে, কেউ ধর্মের নামে, কেউ দেশের নামে, কেউ আবার করে সময়ের প্রয়োজনে। তবে যুদ্ধ হলো মানবজন্মের বাস্তবতা, প্রয়োজন থাকুক বা না থাকুক, মানুষকে যুদ্ধ করতে হয়েছে এবং হবে, এবং সেটা আপনার ইচ্ছাধীন নয়। রাজা ভাবেন যুদ্ধের নেতা তিনি, সেনাপতি ভাবেন তিনিই যুদ্ধের হোতা, সৈনিক ভাবে সে-ই হয়তো যুদ্ধের মূল, কিন্তু মানবজন্মের অমোঘ নিয়মে সম্ভবত কেউ-ই যুদ্ধের কারণ নয়, সবাই দাবার সৈনিক। তারপর-ও যু্দ্ধ আমাদের ওপর এসে পড়বে, সেটা আপনি এড়াতে পারবেন না, পালাতে পারবেন না। হয় আপনি যুদ্ধের সৈনিক, অথবা পুরোধা, অথবা আপনি যুদ্ধে সর্বস্ব হারানো কেউ, নিতান্তই ছা-পোষা একজন মানুষ যার সারাজীবনের স্বপ্ন শুধুই নিজের বাড়িতে বসে দু'টো খেয়ে বউ-বাচ্চা নিয়ে শান্তির জীবন কাটানো। যুদ্ধ আপনাকে জ্বালিয়ে দেবে, পুড়িয়ে দেবে, বদলে দেবে, ধ্বংস করবে, সিদ্ধান্তটা শুধু আপনার যে আপনি কিভাবে জ্বলবেন, একজন যোদ্ধা হিসেবে নাকি একজন পলায়নপর পৃষ্ঠপ্রদর্শক হিসেবে।
১৯৭১ সালের যু্দ্ধ-ও কেউ চায়নি। না, আমরা চাইনি কারণ আমরা শান্তিপ্রিয় জাতি, আর শোষকরা যে চায়নি সেটা বলা-ই বাহুল্য। তারপরেও যুদ্ধ এসেছে অমোঘ নিয়মে, তাতে জড়িয়ে গেছে যারা যুদ্ধ চেয়েছে অথবা যারা চায়নি সবাই। যু্দ্ধ মানে যে ছেলেখেলা নয় সেটা বাঙলার মানুষ বুঝতে শিখেছে, যুদ্ধ মানে যে ধ্বংস আর মৃত্যু আর ক্ষুধা আর দুর্ভিক্ষ তারা জেনেছে। যুদ্ধ মানুষের ভেতরের পশুগুলোকে বের করে এনেছে, যুদ্ধ মানুষের স্বার্থপরতাকে বের করে এনেছে, যুদ্ধ মানুষের হিংস্রতাকেও বের করে এনেছে। যুদ্ধে কেউ মুক্তিযো্দ্ধা হয়েছে, কেউ রাজাকার। ভাই দাঁড়িয়ে গেছে ভাইয়ের বিরুদ্ধে, পিতা পুত্রের বিরুদ্ধে, প্রতিবেশী জ্বালিয়ে দিয়েছে প্রতিবেশীর ঘর। কেন? আমরা জানি না, শুধু জানি যে এটা যুদ্ধ ছিল, এটা অস্তিত্বের প্রশ্ন ছিল, এখানে পশুর মতই বাঁচার জন্য সর্বস্ব দিয়ে লড়াই ছিল। এ যুদ্ধ বাংলার কোন মানুষ চায়নি, তারাও শান্তিপ্রিয় ছিল আপনার-আমার মতই, কিন্তু যুদ্ধ তাদের ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছিল। তারা এড়াতে চেয়েছিল, কিন্তু অস্তিত্ব রক্ষার জন্য এ পাশবিক যজ্ঞে তাদের যোগ দিতেই হয়েছিল। কৃষক সেদিন লাঙল ছেড়ে রাইফেল ধরেছিল, শান্তিপ্রিয় শহুরে মধ্যবিত্ত ড্রয়িংরুমের আরাম ছেড়ে ছেঁড়া জামা পরে মাঠেঘাটে বুলেটের মুখে বুক পেতে দিয়েছিল, একতারার বদলে বাংলার মানুষ সেদিন গ্রেনেড আর এলএমজি'র ধ্বনি শুনেছিল। না, তারা কেউ এ যুদ্ধ চায়নি, যুদ্ধে নামতে আপনার বা আমার চেয়ে তাদের অনীহা কোনদিকে কম ছিল না, নিজের ঘরের বউ-মেয়ে আর বৃদ্ধ পিতা-মাতাকে রেখে কোন যুবক খানসেনার মেশিনগান আর কামানের মুখে যেতে চায়নি, কিন্তু তাদের যেতে হয়েছিল। যুদ্ধ এমন এক দানব যা আপনাকে খুঁজে খুঁজে গ্রাস করবে, ঘরে বসে লুকিয়ে থেকে আপনি তাঁর হাত থেকে বেঁচে যেতে পারবেন না, আজ হোক কাল হোক আপনাকে যুদ্ধের আগুনে জ্বলতে হবে, পছন্দ একান্তই আপনার যে আপনি কিভাবে জ্বলতে চান।
বাংলার মানুষ '৭১-এ কেন যুদ্ধ করেছিল? কেউ বলবেন দেশপ্রেম, কেউ বলবেন শোষণমুক্তি, কেউ বলবেন রাজনৈতিক চেতনা, কেউ বলবেন আদর্শ, আমার সবচেয়ে পছন্দের ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন জহির রায়হান--সময়ের প্রয়োজনে। যুদ্ধ মানব ইতিহাসের বাস্তবতা, সে আসবে, এবং আপনাকে অংশ নিতে হবে, এবং কোন একদিন আপনাকে জবাব দিতে হবে সে যুদ্ধে আপনার ভূমিকা কি ছিল। যুদ্ধে নিরপেক্ষ থাকার কোন সুযোগ নেই, পক্ষ নিতেই হবে, এবং আপনি হয়তো জয়ী পক্ষে না-ও থাকতে পারেন। পক্ষ কিভাবে নেবেন সেটা এক জটিল প্রশ্ন, সবাই বলে বিজয়ীরাই ইতিহাস লেখে, তবে সময় এক মহান বিচারক-ও বটে, ইতিহাসের মত নয়, সময় সর্বদা বিজয়ীর পক্ষে কথা বলে না। বিবেকের কোন স্থান এখানে নেই, যুদ্ধ নিজেই এক মহা অন্যায়, ন্যায়যুদ্ধ বলতে কিছু আছে বলে জানা নেই, বরং পলায়নপরতাই যুদ্ধের সবচেয়ে বড় অন্যায়। যুদ্ধের ময়দান থেকে পালাতে নেই, যুদ্ধে আপনি ছারখার হবেন-ই, কিন্তু পিঠে গুলি খেয়ে মরলে আপনার মৃতদেহের দিকেও কেউ তাকাবে না। কাজেই এটা আপনার পছন্দ, আপনি কিভাবে মরতে চান।
'৭১-এর যুদ্ধ আমাদের পুরো একটা প্রজন্মকে বদলে দিয়েছিল। ৩০ লাখ মানুষের মৃত্যু সম্ভবত এই যুদ্ধের সবচেয়ে বড় ক্ষতি নয়, '৭১-এর সবচেয়ে বড় ক্ষতি আমাদের একটা প্রজন্মের পশুত্বকে বের করে আনা। '৭১ জন্ম দিয়েছিল রাজাকার-আলবদর-আলশামস-শান্তিবাহিনী নামের একদল কসাইয়ের,কসাইয়ের ছুরিকে মোকাবেলা করতে গিয়ে একটা দেশের শান্তিপ্রিয় মানুষগুলোও বদলে গিয়েছিল অন্য মানুষে। যুদ্ধে বাংলার মানুষ আত্মত্যাগ দেখেছে, দেখেছে মৃত্যু, রক্ত, ধ্বংস, রাহাজানি, প্রতিশোধ, নির্যাতন, যার লক্ষ ভাগের এক ভাগ-ও সম্ভবত '৭১ নিয়ে রোমান্টিক স্বপ্ন দেখা নতুন প্রজন্ম কল্পনাও করতে পারবে না। কোরবানির গরু কাটা দেখে যাদের গা গুলিয়ে ওঠে, অপারেশন থিয়েটারে রক্ত দেখে যারা অজ্ঞান হয়ে যান, তারা কি কেউ কল্পনা করতে পারেন আমাদের-ই কোন জাতভাই ওভাবেই জবাই করেছিল তার কোন প্রতিবেশীকে? হাতের চামড়া সামান্য ছিলে গেলেও যারা ব্যথায় মরে যান, তারা কি কেউ ভাবতে পারেন হাত-পায়ের নখ একটা একটা করে উপড়ে নিলে কেমন লাগে? অথবা পায়ের নিচে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিলে কেমন লাগতে পারে? অথবা ধরুন পিটিয়ে একটা একটা করে হাড় ভাঙলে কেমন লাগতে পারে? আপনার ওড়না বা হিজাব ধরে কেউ টান দিলে যখন আপনার সারা গা ঘৃণায় শিউরে ওঠে, তখন কি আপনি একবার-ও ভাবেন ৪২ বছর আগে আপনার মতই ২ লাখ মা-বোনকে তুলে নিয়ে জামাকাপড় ছাড়া ক্যাম্পে আটকে রেখেছিল একদল বর্বর? দিল্লীর তরুণীর গণধর্ষণে যখন আপনার মন কাঁদে, একবারও কি মনে পড়ে সেই ২ লাখ মেয়ের কথা যাদের কাছে গণধর্ষণ ছিল নিত্যদিনের অভিজ্ঞতা? তাদের কেউ যুদ্ধ চায়নি, তারা আপনার-আমার মতই সুখে-শান্তিতে দিন কাটাতে চেয়েছিল, নিজস্ব একটা রূপকথার ভূবন তারাও গড়তে চেয়েছিল। কিন্তু নিষ্ঠুরতার জবাব দয়া দিয়ে হয় না, বুলেটের জবাব ফুল দিয়ে হয় না, পশুর সামনে কবিতা পড়া যায় না, তাদেরকে সেই ভাষাতেই জবাব দিতে হয় যে ভাষা তারা বোঝে। বাংলার মানুষকেও তাই অস্ত্র তুলে নিতে হয়েছিল, প্রয়োজনে কঠোর হতে হয়েছিল, প্রয়োজনে কুটিল, প্রয়োজনে নিষ্ঠুর। এ যুদ্ধে কল্পনাতীত ক্ষয়ক্ষতি ছিল, এ যুদ্ধে মৃত্যু ছিল, এ যুদ্ধে ধ্বংস ছিল, এ যুদ্ধে মানবতার অবমাননা ছিল, এখানে মতবিরোধ ছিল, এখানে বিশ্বাসঘাতকতা ছিল, কিন্তু এটা যুদ্ধ ছিল, এখানে কোন দয়া চলে না, এখানে কোন পিছুটান চলে না, এখানে সতীর্থকে গুলি খেয়ে মরে যেতে দেখার পরেও প্রয়োজনে তার লাশ ফেলে পিছু হটে যেতে হয়, এখানে শত্রুসেনার কাতর মিনতি শুনলেও তাকে গুলি করে মেরে ফেলতে হয়, নয়তো পরেরবার আপনার বুকে বুলেটখানা ঢুকিয়ে দিতে সে এক মুহূর্তও চিন্তা করবে না। এখানে বিশ্বাসঘাতক ধরা পড়লে তাকে খতম করে দিতে হয়, হোক সে যতই আপনজন। যুদ্ধ কোন ড্রয়িংরুমে বসে চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে গল্প করা নয়, টিভিতে দেখা কোন প্রেমের নাটক নয়, এ এক নিতান্তই অমানবিক বাস্তবতা, কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে যুদ্ধের ময়দানে আপনি যাবেন কিনা সেটা আপনার হাতে নয়, তবে কিভাবে যাবেন, বুক দেখিয়ে অথবা পিঠ দেখিয়ে, সেটা একান্তই আপনার ইচ্ছাধীন।
আমরা, '৭১ পরবর্তী প্রজন্ম, যুদ্ধ দেখিনি, শুধু গল্প শুনেছি। গল্প শুনে আমরা যুদ্ধের একটা ছবি দাঁড় করিয়েছি, কারো কাছে সেটা রূপকথা, কারো কাছে নিষ্ঠুরতা, কারো কাছে যোদ্ধারা নায়ক, কারো কাছে তারা দূরের মানুষ, কারো কাছে তারা পেশীবহুল হারকিউলিস। কিন্তু তারা আমার-আপনার মতই কেউ একজন, তারা কেউ যুদ্ধ চায়নি, কিন্তু তাদের যুদ্ধে যেতে হয়েছিল, তাদেরকে নিষ্ঠুরতা আর খুন দেখতে হয়েছিল, দেখাতেও হয়েছিল। তারা মৃত্যু দেখেছে, তাদের ঘরসংসার ছারখার হয়েছে, যারা বেঁচে গেছে তাদেরকে যুদ্ধের দাম দিতে হচ্ছে যতদিন বেঁচে থাকবে। শারীরিক ক্ষতি, মানসিক ক্ষতি, দুঃস্বপ্নের স্মৃতি বয়ে বেড়ানোর ক্ষতি। সর্বগ্রাসী সেই ধ্বংসযজ্ঞের রূপ আজকের এই মুক্ত দেশের মানুষ বুঝবে না, বোঝা সম্ভব নয়। যারা যুদ্ধ দেখেছে তাই তারা শত্রু চেনে, বন্ধু চেনে, বিশ্বাসঘাতক-ও চেনে, আর তাই তারা বিশ্বাসঘাতকদের বিচার চায়। যু্দ্ধ মাত্রেই প্রতিশোধ দাবী করে, যোদ্ধা মাত্রেই নিষ্ঠুর, আপনার-আমার শান্তিপ্রিয় মধুর বচন দিয়ে আপনি যোদ্ধার মন বিচার করতে পারবেন না, কারণ আপনার সর্বস্ব যুদ্ধে হারায়নি, আপনার কোন অঙ্গহানি হয়নি, আপনার পিতাকে কেউ হত্যা করে লাশ গণকবরে পুঁতে দেয়নি, আপনার বোনকে কেউ তুলে নিয়ে শত্রুসেনার বিকৃত আনন্দের খোরাক বানায়নি, আপনি শরণার্থী হয়ে প্রাণ হাতে করে সীমান্ত পার হয়ে দিনের পর দিন না খেয়ে শরণার্থী শিবিরে কাটাননি, আপনি চোখের সামনে শকুনের লাশ ঠোকরানো দেখেননি, আপনার ভাইকে কেউ চোখ বেঁধে গুলি করে নদীতে ফেলে দেয়নি। কাজেই আপনি এখন যুদ্ধকে "গণ্ডগোল" বলে উড়িয়ে দিতে পারেন, আপনি মুজিব-তাজউদ্দীন-ওসমানী-তাহের-জিয়ার দোষগুণ নিয়ে আসর গরম করে ফেলতে পারেন, আপনি আস্তিক-নাস্তিক নিয়ে বাজার মাতাতে পারেন, আপনি বিশ্বাসঘাতক রাজাকারদের ফাঁসির দাবীকে রাজনৈতিক খেলা বলে উড়িয়ে দিতে পারেন, আপনি দেশ-জাতির চেয়ে নিজের ক্যারিয়ার-চাকুরি-ব্যাংক ব্যালেন্স-পিএইচডি-ব্যবসা-প্রেমিকা নিয়ে চিন্তিত থাকতে পারেন, কিন্তু আপনি আপনার পূর্বপুরুষের মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে পারেন না, আপনি বিশ্বাসঘাতকদের বালটাও ছিঁড়তে পারেন না,কারণ আপনি আমার মতই যুদ্ধ না দেখা একজন আধুনিক মহামূর্খ।
কিন্তু সুপ্রিয় বন্ধুরা, যুদ্ধ আপনার বা আমার ইচ্ছাধীন কোন বিষয় নয়, এটা অমোঘ নিষ্ঠুর বাস্তবতা। আপনি বালুতে মুখ গুঁজে যুদ্ধকে এড়িয়ে যেতে পারবেন না, ভাইরাসের মতই কোন এক বাহকের ঘাড়ে সওয়ার হয়ে সে আপনাকে খুঁজে নেবে। কখনো সেই বাহক ছিল চেঙ্গিস খান, কখনো হিটলার, কখনো ইয়াহিয়া খান বা গোলাম আযম, এখন সেটা জামাত-শিবির। এই ভাইরাসের বাহক হতে পারে আপনার-ই ঘনিষ্ঠ কেউ, হয়তো ভাই-বোন, হয়তো পিতা, হয়তো ঘনিষ্ঠ কোন বন্ধু যার সাথে রয়েছে জীবনের অনেকগুলো মহাময়য়ল্যবান স্মৃতি। জামাত-শিবির '৭১-এও এই ভাইরাসের বাহক ছিল, এখনো তাই আছে, ধর্মের ঢাল নিয়ে বন্ধুর বেশ নিয়ে আপনার অজান্তেই তারা আপনাকে বিষাক্ত ভাইরাসের বাহক হিসেবে গ্রাস করে নেবে। কখনো সহানুভূতি, কখনো বন্ধুত্ব, কখনো ধর্মবিশ্বাস, কখনো আত্মীয়তার দোহাই দিয়ে আপনি এই ভাইরাসের বাহকদের প্রশ্রয় দেবেন, এবং নিশ্চিতভাবেই একদিন নিজেই একজন বাহকে পরিণত হবেন, অথবা নিশ্চিহ্ণ হয়ে যাবেন, ভাইরাস তার পোষকের পুষ্টি খেয়ে পোষককে ক্ষয় করেই বেঁচে থাকে, এটাই তার বেঁচে থাকার উপায়। এরা কৃতজ্ঞতা জানে না, এরা দয়া জানে না, এরা শুধু জানে যে কোন উপায়ে নিজের অস্তিত্ব রক্ষার উপায়। এদের সাথে আপনি যুক্তিতর্কে পার পাবেন না, ক্ষমাভিক্ষা পাবেন না, এরা বন্ধু চেনে না, স্বজন চেনে না, পথের যে কোন বাধা এরা নিষ্ঠুরভাবেই সরিয়ে দেয়, ভাইরাসের সেটাই ধর্ম।
বন্ধুরা, খেলা অনেক হয়েছে, এটা আর খেলা নয়, যুদ্ধ। দয়া করে আপনার নরম আসন ছেড়ে নেমে আসুন, দয়া করে যুক্তিতর্ক আর হেঁয়ালির জালটাকে গুটিয়ে রেখে সোজা রাস্তায় ভাবুন, দয়া করে বুঝতে শিখুন যুদ্ধের নিয়ম। আপনি শান্তিপ্রিয় হতেই পারেন, আপনি সুশীল বুদ্ধিজীবি হয়ে বিশাল বিশাল বক্তৃতা দিয়ে মন্ঞ্চ মাতাতেই পারেন, আপনি মানবাধিকার নিয়ে জ্ঞানগর্ভ আলোচনা করে টকশো-তে বাহবা নিতেই পারেন, আপনার প্রতিপক্ষরা তা নয়। তারা যোদ্ধা, যুদ্ধের নিয়ম একটাই, এখানে কোন নিয়ম নেই, জামাত-শিবিরের প্রতিটি নেতা-কর্মী-সমর্থক সেটা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে, তাদের সাথে সেভাবেই যুদ্ধ করতে হবে। এখানে সহজ বা আরামদায়ক কোন নিয়ম নেই, এখানে মহত্বের বা রোমান্টিকতার কোন জায়গা নেই, এখানে বিশ্বাসঘাতকতা দেখতে হবে, নোংরামি দেখতে হবে, এখানে দলবদল দেখতে হবে, এখানে ক্ষমতার কাড়াকাড়ি দেখতে হবে, এখানে মুহূর্তেই চেনা মানুষের চেহারা বদলে যাওয়া দেখতে হবে, এখানে প্রিয় মানুষের মৃত্যু দেখতে হবে, এখানে আদর্শ-নৈতিকতা-ন্যায়ের পরাজয় দেখতে হবে, এখানে ধ্বংস আর ক্ষয়ক্ষতি দেখতে হবে, কারণ এটা যুদ্ধ, এটা খেলা নয়, এখানে লাল কার্ড-হলুদ কার্ড নিয়ে কেউ দাঁড়িয়ে নেই, এখানে কোন ন্যায়-অন্যায় নেই। শাহবাগের প্রজন্ম চত্বরে যে আন্দোলন শুরু হয়েছে এটা এক দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধের একটা পর্যায় মাত্র, কেউ যদি এই আশায় সেখানে গিয়ে থাকেন যে এক লাখ মানুষ একটা রাস্তা অবরোধ করে স্লোগান দিলেই জামাত-শিবির লেজ গুটিয়ে পালাবে তাহলে তারা বোকার স্বর্গরাজ্যে বাস করছেন। জামাত-শিবির আপনার-আমার মত রোমান্টিক কাগুজে যুদ্ধবাজ নয়, এরা প্রশিক্ষিত নিবেদিতপ্রাণ ঠাণ্ডামাথার উন্মাদ। এরা আপনাদের বিভ্রান্ত করবে, আপনাদের বিভক্ত করবে, আপনাদের মাঝে ভীতি ছড়াবে, প্রয়োজনে আপনাকে এবং আপনার প্রিয়জনকে খুন করবে, কারণ তারা জানে এটা যুদ্ধ, যেটা আপনি জানেন না। আমরা যখন ৯ মাস স্থায়ী যুদ্ধে জিতে লাভের গুড় ভাগাভাগি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেছি, জামাত তখন দীর্ঘমেয়াদী যুদ্ধ জেতার জন্য প্রস্তুতি নিয়েছে, আমাদের আত্মতৃপ্তি আর অবিমৃষ্যকারীতার সুযোগ নিয়ে। তারা তিল তিল করে প্রশিক্ষিত বুদ্ধিমান শিক্ষিত কর্মীবাহিনী গড়ে তুলেছে, বিপুল বৈধ-অবৈধ সম্পদের পাহাড় জমিয়েছে, সরকারের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে পড়েছে। ১ বছর বা ১০ বছর পরে নয়, প্রয়োজনে ৫০ বা ১০০ বছর পর তারা এই যুদ্ধে বিজয়ী হতে চায়, এবং চায় চিরদিনের জন্য বিজয়ী হতে, যাতে আপনার অস্তিত্বের সর্বশেষ নিশানাও তারা মুছে ফেলতে পারে, আমাদের পূর্বপুরুষরা বা আমরা যে ভুল করেছি এবং করছি, তারা সে ভুল করবে না, নিশ্চিন্ত থাকুন।
কাজেই বন্ধুরা, যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা তো অনেক হলো, আসুন এবার যুদ্ধে নামি। এ যুদ্ধ একদিনে শেষ হবে না, দয়া করে হতাশ হয়ে যাবেন না। এ যুদ্ধের প্রারম্ভে শাহবাগের রাস্তা ক'টা দিন বন্ধ থাকলে অফিসগামী মানুষের ভোগান্তি হতে পারে, দেশের প্রবৃদ্ধি এবার ৬% হবে না সেটা ভেবে আপনি শঙ্কিত হতে পারেন, এই "গোলমাল"-এর মাঝে বাচ্চাদের পড়াশোনা আর পরীক্ষা পিছিয়ে যাচ্ছে ভেবে উষ্মা প্রকাশ করতে পারেন, বারডেম আর পিজি হাসপাতালের রোগীদের নিয়ে সহানুভূতি দেখাতে পারেন, আন্তর্জাতিক মহলে বাংলাদেশের ভাবমূর্তির ১২টা বেজে গেল ভেবে মায়াকান্না কাঁদতে পারেন, জামাত-শিবিরকে নিষিদ্ধ করলে দেশে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে যাবে বলে হাহাকার করতে পারেন, কিন্তু দয়া করে মনে রাখবেন, এটা যুদ্ধ, যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতিও আপনাকে মেনে নিতে হবে, ৪২ বছর নিশ্চুপ থেকে যুদ্ধাপরাধী আর গণহত্যাকারীদের প্রশ্রয় দিয়ে আপনি এবং আমরা যে অপরাধ করেছি, তার ফলশ্রুতিতেই আজ আপনাকে এটুকু ক্ষতি মেনে নিতে হবে। বিশ্বের স্বাধীনতাকামী কত জাতি ৫০-৬০ বছর ধরে যুদ্ধ করে যাচ্ছে, আপনি এট সস্তায় স্বাধীনতা ধরে রাখতে চান? এ যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ, শহীদ জননী জাহানারা ইমাম এর শেষ দেখে যেতে পারেননি, হয়তো আপনি বা আমিও পারবো না, কিন্তু '৭১-এর ৩০ লাখ মানুষও কি বিজয় দেখে যেতে পেরেছিল? আপনার বা আমার মত ২-৪ শ' বা ২-৪ হাজার মানুষ হয়তো মরতেও পারে, কিন্তু এটাই যুদ্ধের নিয়ম, আর যুদ্ধটা আপনার হাতে নেই, আপনি চান বা না চান, আজ হোক বা কাল, এ যুদ্ধে আপনাকে অংশ নিতেই হবে। আপনাকে অনেক অপ্রিয় সিদ্ধান্ত নিতে হবে, হয়তো ঘনিষ্ঠ কোন বন্ধুর সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করতে হবে, হয়তো হারাতে হবে জামাত পরিচালিত কোন ব্যাংকের লোভনীয় লভ্যাংশ, হয়তো হারাতে হবে সুশিক্ষিত রক্ষণশীল প্রেমিকার ভালবাসা, হয়তো পেতে হবে নাস্তিক উপাধি যদিও সারাজীবনই নিজেকে আপনি আস্তিক জেনে এসেছেন, এমনকি হয়তো হতে হবে শত্রুর-ও মিত্র, কিন্তু আপনাকে পক্ষ নিতেই হবে, যু্দ্ধে কেউ নিরপেক্ষ নয়, থাকতে পারে না, হয় আপনি আমাদের বন্ধু, অথবা শত্রু, যার আরেক নাম "সুবিধাবাদী, কাপুরুষ, নির্লজ্জ, বিশ্বাসঘাতক।"
তারপর, কোন একদিন যুদ্ধ থেমে যাবে, সূর্য উঠবে, মুক্ত বাতাসে নিঃশ্বাস নেবে বাংলার মানুষ, সেদিন দেখে যাবার সৌভাগ্য হয়তো আপনার বা আমার হবে না, অথবা সেদিন আমাদের যুদ্ধক্ষেত্রে খুঁজতে হবে আমাদের নীতি-বিবেক-মানবতার লাশ, কিন্তু এটাই যুদ্ধের নিয়ম, এখানে সবাইকেই কিছু না কিছু হারাতে হয়, কারো জীবন, কারো স্বজন, কারো বিবেক। তারপরেও আমাদের এই যুদ্ধ শেষ করতে হবে, অথবা শেষ করার জন্য যুদ্ধ করতে হবে, আমরা বেঁচে থাকি অথবা না থাকি, আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে যেন এই কুৎসিত যুদ্ধ করতে না হয়, সেজন্য আমাদের এই যুদ্ধ করতে হবে, আমাদের বর্তমানকে উৎসর্গ করে পরের প্রজন্মের জন্য ভবিষ্যৎ গড়তে হবে, যেমনটা আমাদের পূর্বপুরুষরা করেছিলেন, নিজের রক্ত আর জীবনের বিনিময়ে।
দিনে দিনে দেনা অনেক বেশি জমা হয়ে গেছে, এবার আসুন আমরা বিশ্বাসঘাতক-গণহত্যাকারী-মানবতার শত্রু জামাত-শিবিরের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ি, এই বিষবৃক্ষের শেকড় পর্যন্ত পুড়িয়ে দিয়ে আমাদের পূর্বপুরুষদের রক্তের ঋণ আর পরবর্তী প্রজন্মের কাছে দায় পরিশোধ করি।
[উৎসর্গঃ বন্ধুবর তানভীর রাহাত, যার মুখ থেকে হতাশার কথা শুনতে আমি অভ্যস্ত নই।]