বাংলাদেশে ব্যবসা প্রশাসন শিক্ষা বা বিবিএ-এমবিএ'র জোয়ারটা শুরু হয়েছে মূলত বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর হাত ধরে, যদিও এই বিষয়ে পড়ানো শুরু হয়েছিল স্বাধীনতার-ও আগে। ১৯৬৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসা প্রশাসন ইনস্টিটিউট বা আইবিএ-তে এমবিএ প্রোগ্রামের মাধ্যমে শুরু হয় এই ধারার পড়াশোনা, এবং এর মাধ্যমেই বাংলাদেশে ব্যবসা ব্যাপারটাকে প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনার আওতায় আনার ধারণা চালু হয়। এর ২৭ বছর পর আইবিএ-তেই ১৯৯৩ সালে বিবিএ প্রোগ্রামের মাধ্যমে আন্ডারগ্র্যাড পর্যায়েও ব্যবসা প্রশাসন পড়ানো শুরু হয়। তবে এখন যেমন ডাক্তারি বা প্রকৌশলের মতই ব্যবসা প্রশাসন পড়াশোনার জন্য দারুণ চাহিদাসম্পন্ন একটি বিষয়, এর কৃতিত্ব বা দোষ যা-ই বলা যাক, বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর। পরিস্থিতি এখন অনেকটা এমন-ই যে এটা প্রায় এসএসি পাশ করার মতই অত্যাবশ্যকীয় একটা ব্যাপার হয়ে গেছে চাকরির বাজারে, ঠিক কেন এই ডিগ্রিটা নিতে হবে সে সম্পর্কে ধারণা থাক আর না-ই থাক।
চাহিদার কারণেই বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মত সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অনেকগুলোতে খোলা হয়েছে ব্যবসা প্রশাসন ইনস্টিটিউট, আসন সংখ্যা বেড়েছে সবখানেই, এবং ডাক্তার-প্রকৌশলীসহ নানা পেশার মানুষজন-ও যা হোক কোনভাবে একটা এমবিএ বাগানোর জন্য সেগুলোতে ভর্তি হয়ে যাচ্ছে, আমি নিজেও যার মাঝে একজন। এই ডিগ্রিটা, বা পড়াশোনাটার কোন দাম নেই সেরকম নয়, আর কিছু না হোক ভালভাবে কথা বলতে বা যোগাযোগ, সেটাকে কম্যুনিকেশান বলি আর নেটওয়ার্কিং-ই বলি, সোজা বাংলায় তদ্বিরবাজির অনেক কলাকৌশল যে শেখানো হয় তাতে সন্দেহ নেই, একই সাথে খানিকটা উৎসাহের সাথে পড়াশোনা করলে নিতান্ত অগোছালো ব্যক্তিকেও বেশ একটা সাজানো-গোছানো উপায়ে নানা পেশার নানারকম মানুষের সাথে কাজ করতে-ও অভ্যস্ত করে তোলে, বর্তমানের তীব্র প্রতিযোগিতার বাজারে যে দক্ষতাগুলোকে কোনভাবেই উড়িয়ে দেয়া চলে না। একই সাথে, নানারকম বিষয়ের মিশেল বলে, মানে ফিন্যান্স, মার্কেটিং, হিউম্যান রিসোর্স বা মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা, ম্যানেজমেন্ট ইনফর্মেশন সিস্টেম এরকম কোন একটা পছন্দের বিষয়ে বিশেষায়িত পড়াশোনাতেও যাচ্ছে অনেকে, ভবিষ্যত উজ্জ্বল-ও হচ্ছে। বাংলাদেশে যেসব বহুজাতিক কোম্পানি বা ব্যাংকগুলো কাজ করছে, সেগুলোর জন্য তো অত্যাবশ্যকীয়, ভাল দেশী প্রতিষ্ঠানগুলোও এরকম বিবিএ বা এমবিএ-ওয়ালা তৈরি চটপটে কর্মী ছাড়া আজকাল নিয়োগ করতে চায় না।
তবে, বিবিএ বা এমবিএ প্রোগ্রামের আসল উদ্দেশ্য কি, এটা নিয়ে কথা তুললে নানারকম মতামত পাওয়া যাবে। বেশিরভাগ প্রফেশনাল ডিগ্রি এমনভাবে ডিজাইন করা হয় যেটা আপনাকে কোন একটা "সুনির্দিষ্ট" বিষয়ে স্পেশালিস্ট বা বিশেষজ্ঞ হিসেবে গড়ে তোলে। ব্যবসা প্রশাসনের ব্যাপারটা সেরকম নয়। এখানে যেসব বিষয় মূলত পড়ানো হয়, যেমন ফিন্যান্স, অ্যাকাউন্টিং, মার্কেটিং, হিউম্যান রিসোর্স ইত্যাদি, এগুলোর প্রায় সবগুলোর উপর বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ৪ বছর মেয়াদী আন্ডারগ্র্যাড কোর্স আছে, এমনকি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন কলেজগুলোতেও আছে, মাস্টার্স প্রোগ্রাম তো আছেই। বিবিএ, বা এমবিএ'র উদ্দেশ্য হলো, এই সবগুলো, এবং আরো কিছু বিষয়ের উপর "বেসিক" বা "প্রাথমিক" ধারণা দিয়ে একজন "জ্যাক অভ অল ট্রেডস" তৈরি করা, যাতে একটা কোম্পানির ফিন্যান্সিয়াল স্টেটমেন্ট দেখলে আপনি আকাশ থেকে না পড়েন, বা কর্মচারীদের বেতন-ভাতা-বোনাস-ছুটির ব্যবস্থা করতে গিয়ে বা কোন আইনগত ব্যাপার নিয়ে কাজ করতে গিয়ে হিমসিম না খান, এবং কোম্পানির প্রধান নির্বাহী থেকে শ্রমিক পর্যন্ত সবার সাথেই কাজ করতে পারেন। এরপর-ও কোন একটা সুনির্দিষ্ট বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হতে চাইলে আপনার নিজের চাকরির অভিজ্ঞতা আছে, সিএফএ, সিক্স সিগমা বা এসিসিএ'র মত প্রফেশনাল সার্টিফিকেশন আছে, এমবিএ শুধু একটা "অ্যাডেড ভ্যালু", অর্থাৎ কিনা, এটা আপনার মূল দক্ষতাকে ঘষামাজা করবে, আপনার দক্ষতায় বেশ কিছু "পয়েন্ট" যোগ করবে, বাকিটা করে নিতে হবে আপনাকেই। আইবিএ'র বেশিরভাগ শিক্ষকের মতে, এই প্রোগ্রামটা খোলা হয়েছিল যাতে দেশের তরুণরা পশ্চিমা ধাঁচে উদ্যোক্তা হয়ে গড়ে ওঠে, তবে শেষমেশ ব্যাপারটা যা দাঁড়িয়েছে তা হলো ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য প্রশিক্ষিত কর্মী তৈরি। সেটার দরকার আছে তা অস্বীকার করা যায় না, এককালে যেমন বাংলাদেশের বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর প্রায় সব উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা এবং দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর বেশ বড় একটা অংশ চলতো বিদেশী দিয়ে, সে জায়গাটা এখন নিচ্ছে বাংলাদেশী ছেলেমেয়েরা, এবং তাঁরা অত্যন্ত দক্ষতার সাথে তাঁদের দায়িত্ব পালন করছেন। তবে উদ্যোক্তা গড়ে ওঠেনি আশানুরূপভাবে, সবাই বিবিএ বা এমবিএ পড়তে ঢোকে শুধুমাত্র চাকরি নিশ্চিত করা বা পদোন্নতির আশাতেই (স্বীকার করি, নিজের ব্যাপারটাও তাই, ব্যবসা নিয়ে কোনকালেই আমার কোন আগ্রহ বা প্রতিভা ছিল না, এখনো নেই), এবং ধারণা করে যে, কোনভাবে একটা এমবিএ করে ফেলতে পারলেই মনে হয় টাকার সাগরে সাঁতার দেয়া যাবে। এই ধরণের ভ্রান্ত ধারণা যে পশ্চিমা বিশ্বে-ও মোটামুটি একটা মাথাব্যথার কারণ, সেটা বোঝা যায় ফোর্বস ম্যাগাজিনের একটা প্রবন্ধে, যার শিরোনামটা মোটামুটি এমন--"বিজনেস স্কুলের সবচেয়ে বড় ১০টি মিথ্যা"। কি সেই মিথ্যা, বা বলা যায় মীথগুলো? আমাদের জন্য-ও কি সেগুলো প্রাসঙ্গিক? প্রবন্ধটির মোটামুটি একটা অনুবাদে সেটা-ই বোঝার, এবং বোঝানোর চেষ্টা করলাম।
মীথ ১-- এমবিএ করলেই আপনি ধনী হয়ে যাবেন: ব্যবসা প্রশাসনে পড়াশোনার উদ্দেশ্যই হলো টাকা কামানো, এবং সেটা ব্যবসা করুন বা চাকরি, টাকা কামানো সম্ভব, তবে যত তাড়াতাড়ি ভাবছেন, অতটা দ্রুত সাধারণত টাকা আসে না, বরং আপনার অনুমিত সময়ের ২-৩ গুণ বেশি সময় লাগাটাই স্বাভাবিক। কাজেই প্রত্যাশার মাত্রা কমিয়ে আনুন, ধীরে চলুন, টাকা আসবে, তবে সেটা হলিউডের ম্যুভি স্টারদের মত করে নয়
মীথ ২-- এমবিএ করে আপনি এই ডিগ্রিধারী নয় এমন লোকজনের চেয়ে বেশি স্মার্ট: এটাই সম্ভবত সবচেয়ে বড় ভুল ধারণা, বিশেষ করে আমাদের দেশে। এই ডিগ্রী আপনার চলাফেরা, কথাবার্তায় একটু শান দেবে, কিন্তু তারমানে এই নয় যে যাদের এই ডিগ্রী নেই তারা আপনার সমকক্ষ নয়, বা আপনার মত কথায় কথায় ইংরেজি বলে না বা হিসেব করে না বলেই তারা আপনার চেয়ে কম স্মার্ট। অন্যকে সম্মান করুন, আখেরে পা হড়কাবে না।
মীথ ৩-- সব প্রশ্নের-ই একটা "নিশ্চিত সঠিক" জবাব আছে: বিজনেস গ্রাজুয়েটদের আরেকটা সমস্যা হলো (যেটা প্রকৌশলীদের ক্ষেত্রেও খাটে), তারা খুব বেশি হিসেব নির্ভর, কোন একটা "গাণিতিক মডেল"-এ ফেলে দিয়ে সব সমস্যার ১০০ ভাগ নিশ্চিত জবাব বের করে ফেলতে চায় এবং ফলাফল দিয়ে সবকিছু বিচার করে। বাস্তবতা হলো, বর্তমানের দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্বে ব্যবসায় অনিশ্চয়তা এত বেশি যে আপনি বড়জোর যা তথ্য পাবেন তার ভিত্তিতে "আপাত শ্রেষ্ঠ" সিদ্ধান্ত-ই নিতে পারবেন, কিন্তু এর অনেকগুলো বিকল্প-ও যে থাকতে পারে, এবং সেগুলো যে আপনার নেয়া সিদ্ধান্তের চেয়ে ভাল-ও হতে পারে, এটা সবসময়-ই মাথায় রাখতে হবে।
মীথ ৪-- চমৎকার একটা প্রতিষ্ঠানে এমবিএ করা আপনাকে সাফল্যের নিশ্চয়তা দেয়: পুরোপুরি ভুল না হলেও, একদম সঠিক নয়। বিশেষ করে বিখ্যাত প্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষার্থীদের মাঝে এই ধারণাটা কাজ করে, আমেরিকার জন্য হার্ভার্ড, বাংলাদেশের জন্য সম্ভবত আইবিএ। বাইরে থেকে যারা দেখে তাদের প্রশংসা বাক্য, শিক্ষকদের প্রাতিষ্ঠানিক গর্ব, অ্যালামনাইদের সাফল্য এমন একটা ধারণা দেয়। এটা ঠিক যে প্রতিষ্ঠানের নামডাক আপনাকে হয়তো চাকরির ইন্টারভিউতে ডাক পাওয়াবে, এবং ক্ষেত্রবিশেষে চাকরি পেতেও সাহায্য করবে, কিন্তু সেই চাকরিতে সাফল্য পাবেন কিনা সেটা সম্পূর্ণ-ই আপনার ওপর নির্ভর করে, কাজ না পারলে শেষে আপনার প্রতিষ্ঠানের নামডাক-ই আপনার জন্য বুমেরাং হয়ে যাবে। এর নাম ব্যবসা, সবকিছুই মাপা হয় লাভ-ক্ষতির পাল্লায়, এই কঠিন জগতে কাগজের সার্টিফিকেট বা আবেগের তেমন একটা মূল্য নেই।
মীথ ৫-- যেহেতু আপনি এমবিএ করেছেন, প্রতিষ্ঠানের পুরানো লোকদের চেয়ে আপনি অনেক ভাল জানেন: এই অভিযোগটা সনাতন ধারায় চলা লোকজন প্রায়-ই করে থাকে, নতুন ছোকরা-টা বড় বেশি ফড়ফড় করে, আমরা এত বছর এখানে কাজ করি আমরা-ই এখনো ঠিক মত পারি না, সে এসেই আমাদের সবার ভুল ধরা শুরু করে দিয়েছে। হতেই পারে, আপনি তাদের চেয়েও ভাল পারেন, তবে যে কোন প্রতিষ্ঠানের একটা নিজস্ব নিয়মকানুন-সংস্কৃতি আছে। কয়েক মাস মুখে তালা মেরে থাকুন, প্রতিষ্ঠান আর মানুষগুলোকে চিনুন, আপনার কেরদানি দেখানোর অনেক সময় পাবেন।
মীথ ৬-- ডিসকাউন্টেড ক্যাশ ফ্লো দিয়েই আয়-উন্নতি মেপে ফেলা: এই ব্যাপারটা একটু কারিগরি দিকে চলে গেল, বিস্তারিত ব্যাখ্যায় গেলে আরেকটা পোস্ট লিখতে হবে, খুব সংক্ষেপে বলতে গেলে, একটা নতুন ব্যবসা খুলতে গেলে ঐ ব্যবসা থেকে ভবিষ্যতে কত লাভ আসতে পারে, সেটার বর্তমান টাকাতে কত হবে এবং তা বর্তমান বিনিয়োগের তুলনায় বেশি নাকি কম হবে সেটার-ই একরকম হিসেব হলো ডিসকাউন্টেড ক্যাশ ফ্লো। মূল প্রবন্ধের লেখকের মতে, এটা সামান্যই কাজে লাগে, কারণটাও বোধগম্য, বর্তমান যুগে ব্যবসাতে চলকের (ভ্যারিয়েবলস) পরিমাণ এত বেশি আর অনিশ্চয়তা-ও এত বেশি যে এই একটা মূলত: একাডেমিক চলক দিয়ে ব্যবসার লাভ-ক্ষতি বোঝার চেষ্টা করা একধরণের বোকামি, ঐ জিনিস স্কুলে রেখে আসা-ই ভাল।
মীথ ৭-- "সফট" কোর্স, যেমন লিডারশিপ এবং ম্যানেজমেন্ট কোর্সের তেমন কোন গুরুত্ব নেই: "সফট" কোর্স কথাটা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে একটু বিপদে পড়া গেল, কারণ "সফট" মানে এখানে নরম নয়। ভাবানুবাদ করতে গেলে বলা যায়, যে কোর্সগুলোকে সরাসরি আপনার বিষয়ের সাথে আপনি সম্পর্কিত করতে পারছেন না, এবং যে কোর্সগুলোর বিষয়বস্তু ঠিক গাণিতিক, পরিমাণগত বা "কোয়ান্টিটিটিভ" নয়, বরং খানিকটা "অ্যাবস্ট্রাক্ট" বা কোয়ালিটিটিভ, মানে একদম সংখ্যা দিয়ে মেপে ফেলতে পারবেন না (উদাহরণস্বরূপ: রহিম করিমের চেয়ে ১০ কেজি ভাল নেতা, এভাবে আপনি বলতে পারেন না), সেগুলোকে "সফট" কোর্স বলা যায়। স্বাভাবিকভাবেই, এই কোর্সগুলোর দিকে যে কোন বৈষয়িক ছাত্রের রীতিমত বিতৃষ্ণা থাকে, ব্যবসা-বাণিজ্য, অংক, টাকা-পয়সার মাঝে কে-ই বা নেতৃত্ব, মানুষের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, অনুপ্রেরণা, মোটিভেশন, ইনস্পিরেশন এসব উদ্ভট শব্দের কচকচি শুনতে চায়! নিজে এমবিএ করার সময়-ও ম্যানেজমেন্টের কোর্স ২টা কোনমতে ঘুমিয়ে পার করে দিয়েছি। অথচ মজার ব্যাপার হলো, যে কোন কোম্পানির উঁচুপদের কর্মকর্তাদের প্রায় সব প্রশিক্ষণ-ই হয় "লিডারশিপ" নয়তো "ম্যানেজমেন্ট"-এর উপর, কারণ ব্যবসা মানেই মানুষ; স্রেফ কতগুলো অংকের সমষ্টি নয়। মানুষের সাথে মানুষকে নিয়েই ব্যবসা করতে হয়, কাজেই "লিডারশিপ" বা নেতৃত্বের গুণগুলো এখানে অপরিহার্য। উদাহরণ? স্টিভ জবস আছেন না?
মীথ ৮-- এমবিএ আপনাকে সৃষ্টিশীল উদ্যোক্তা বানাবে: মোটামুটি ভুল, লেখার শুরুতেও প্রসঙ্গটা একবার এসেছে। বরং অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যাচ্ছে, কিছু গাণিতিক মডেল এবং ধরাবাঁধা নিয়মের ফাঁদে ফেলে বিজনেস স্কুলগুলো বরং সৃষ্টিশীলতা কমিয়েই দিচ্ছে। এমবিএ-তে আপনাকে অনেক কৌশল শেখানো হবে, কিন্তু কিভাবে একটা ব্যবসা শুরু করবেন সেটা শেখানো হবে না, সেটা আপনাকে নিজেকেই শুরু করতে হবে, এমবিএ-তে শেখা কৌশলগুলো হয়তো আপনার রুটিনবাঁধা কাজগুলো সহজ করবে, আর সেখানকার পরিচিতিটা হয়তো আপনাকে কিছু "ক্লায়েন্ট" যোগার করে দেবে।
মীথ ৯-- আপনার সহপাঠীদের পরামর্শ আপনাকে সাফল্যের রাস্তা দেখাবে: আপনি যদি একদম সনাতনী পথে চলতে চান, ঠিক আছে, কারণ বেশিরভাগ বিবিএ বা এমবিএ'র ছাত্র-ছাত্রী গড্ডালিকা প্রবাহে চলে। বাংলাদেশের বেলায়, আমার পর্যবেক্ষণ বলে, বেশিরভাগ বিবিএ বা এমবিএ করা ছাত্র-ছাত্রীর লক্ষ্য থাকে হয় কোন বহুজাতিক কোম্পানি বা দেশী-বিদেশী ব্যাংকে ঢোকা, আর যেহেতু আপনার সিনিয়র বা সহপাঠীরা সেগুলোতে আছেন কাজেই ঢোকাটা খুব কঠিন হয় না। কিন্তু একদম নিজের মত করে ক্যারিয়ার গড়ার স্বপ্ন নিয়ে চলতে চাইলে, নিজের মনের কথা শুনতে হবে, অন্যদেরটা না।
মীথ ১০-- বিখ্যাত প্রতিষ্ঠানে এমবিএ করলে অন্য এমবিএ-দের তুলনায় সাফল্য বেশি: আগেও এসেছে প্রসঙ্গটা। বড় প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করলে প্রাথমিকভাবে অবশ্যই কিছুটা সুবিধা পাওয়া যায়, হয়তো চাকরিটাও পাইয়ে দেবে, কিন্তু এরপর পুরোটাই আপনার নিজের উপর। বরং বড় প্রতিষ্ঠানের এমবিএ-দের আগের ৯টা মীথের শিকার হবার সম্ভাবনা আরো বেশি থাকে। এনরনের প্রধান নির্বাহী জেফ স্কিলিং-ও হার্ভার্ডের এমবিএ ছিলেন, তার সিভি একেবারে সোনা দিয়ে বাঁধাই করে রাখার মত, কিন্তু পৃথিবীর ইতিহাসের বৃহত্তম ব্যর্থতাগুলোর একটির জন্যেই তাঁর নাম মনে রাখতে হবে। কাজেই সাধু সাবধান!
এতক্ষণ যা বলা হলো, তার উদ্দেশ্য অবশ্যই যারা বিবিএ বা এমবিএ করছেন বা করতে চান তাদেরকে নিরুৎসাহিত করা নয়, বরং তারা যেন সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে, কি করছেন, কেন করছেন এবং স্নাতক হবার পর কি পরিস্থিতিতে পড়বেন সেটার জন্য আগাম প্রস্তুতি নিয়ে এগোতে পারেন সেটার জন্যই লেখা, সম্ভবত মূল লেখক (যিনি নিজেও একজন সফল বিজনেস গ্রাজুয়েট)-এর উদ্দেশ্যও তাই ছিল। একাডেমিক পড়াশোনা শেষে চাকরি করতে গেলে সবকিছুই অন্যরকম লাগে, কিন্তু পরিবর্তিত পরিস্থিতির ব্যাপারে মানসিকভাবে তৈরি থাকলে সেটা সময়ে স্বাভাবিক হয়ে আসে। যে কোন বিজনেস স্কুল একটা দারুণ শেখার জায়গা, ইচ্ছা থাকলে এখান থেকে ভবিষ্যতের জন্য যথেষ্ট রসদ নেয়া যায়, সেটা চাকরি বলুন বা ব্যবসা বলুন। শুধু আগে থেকেই নিজেকে বিশাল কিছু ভাববেন না, পৃথিবীটা কঠিন জায়গা, অনিশ্চয়তার-ও, পা দু'টো মাটিতে রাখুন, একদিন হয়তো সেগুলো আপনাকে আকাশে পৌঁছে দেবে। শুভকামনা সবার জন্য।
[ মূল লেখাটা এখানে:
Click This Link ]