নিজের পশ্চাদ্দেশটা ঘ্যাঁষ ঘ্যাঁষ করে খানিক চুলকে নিয়ে চেয়ারে হেলান দেয় তারেক মামদো, (যদিও অন্যেরটা চুলকেই বেশি আরাম পায় সে)লুঙ্গির গিঁঠটা একটু ঢিলে করে দিয়ে ল্যাপটপের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে 'বিমল' হাসিতে ভরে ওঠে হোঁৎকা মুখটা। আজ উটুদা'র পয়সায় কাওরানবাজারের "খাই খাই হোটেল"-এ জব্বর একটা ভোজ মারা গেছে বটে! গোমড়ামুখো উটুদা'র কালোপানা মুখটাতেও আজকে খুশির আভা, হুঁ বাবা, এতদিনে হুলোটা তার যোগ্য শিষ্য হয়ে উঠেছে। একটা বেকুবগোছের টার্গেট খুঁজে বের করে ভজিয়ে তার পেট থেকে জিলিপির মত পেঁচিয়ে রসালো কথামালা বের করা, নাহ, ভালু ভালু, মামদো এবার ভূত হয়েছে। উটুদা'র স্বীকৃতিতে মামদো অভিভূত, তার সাথে পাকা কথা হয়ে গেছে পরের বড় সফরটায় ফরেন ভ্রমণে সে-ই যাচ্ছে, ওই সময়টায় ওস্তাদ আবার বিসিবিতে গন্ধ শুঁকতে ব্যস্ত থাকবেন কিনা, আজকাল এইসব ছোটখাটো লেখালেখিতে গুরুর উৎসাহ কম।
ঘটনার শুরু এক দুপুরে, ক্রিকেট বোর্ডে চুকলিবাজি করতে গিয়ে সাকিবের ধাতানো খেয়ে উটুদা'র মেজাজ সেদিন ভয়ানক গরম। গিয়েছিলো একটু এর নামে ওর, ওর নামে তার কথা লাগিয়ে একটু মজা দেখতে, ফাঁকে যদি কারো মুখ থেকে ২-১টা বেফাঁস কথা চলেই আসে, পরের ৭ দিনের রসদ হয়ে গেল। "হাডুডু" পাতায় অনেকদিন হলো কোন খবর নেই, আর দ্রব্যমূল্য, ভেজাল, ভাঙা রাস্তা নিয়ে বরাবর দৌড়ে থাকা বাঙালি এখন এমনই উড়ন্ত হালে আছে যে জিম্বাবুয়ে গিয়ে পোলাপানগুলো যে রাম ঠ্যাঙানি খেয়ে কোঁত পাড়ছে সেদিকে কারো খেয়ালই নেই। উটুদা'র মতলব ছিল এই সুযোগে যদি সাকিবকে একটা ঠেলা দিয়ে পেয়ারের আশুকে জায়গামত বসিয়ে দেয়া যায়, হাজার হোক এতদিনের "ইসপিশাল চা" আর বিনা পয়সার "ফরেন মাল"-এর একটা দেনা আছে না? পোলাটা বেশ বিনয়ীও বটে, দেখা হলেই বিগলিত মুখে সালাম-আদাব দেয়, আজকাল এমন দেখাই যায় না। উটু মাঝে মাঝে "আলুর কারবারী" পত্রিকার অফিসে সবাইকে বলে বেড়ায়, আরে, এই একটা পোলা জন্মাইসিলো এই বেজন্মা দ্যাশে, পোলা তো না য্যান আগুনের গোলা, ওরে বাদ দিয়া কাপ্তান করসে কিনা কোন এক সাকি-বাল রে, কিছু কইবার গেলেই পিছন দিয়া আঙ্গুল দেখাইয়া দেয়, চেহারা দেখলে মনে লয় আঙ্গুলটা আমাগো পিছে ঢুকাইবার পারলে আরো খুশি হইতো।"
তা উট-পালের দুঃখের কারণ আছে বৈকি। দীর্ঘদিন ধরে হাবুল বাশার, যাকে দুর্মুখেরা হাবা বলেও ডাকে, আর আশু'র কল্যাণে ক্রিকেট বোর্ডে বেশ একটা ভাবের জায়গা পেয়ে আসছিলো, আর বিদেশ থেকে এলে "ফরেন মাল"-এর ভাগ তো ছিলই। ছেলেগুলো বড় বিনয়ী, তাকে বেশ ভক্তি-শ্রদ্ধা করে। আর সাকিব পোলাটা "জোম্মের বিয়াদ্দপ",তাকে দেখলে একটা "সালামালকি"ও দেয় না। যদিও পয়সার দিকে বেশ লোভ আছে ছোঁড়াটার, কিসব টি-২০ খেলে এত কামায়, তাও "আলুর কারবারী"তে কলাম লিখে দু'টো পয়সার লোভ ছাড়তে পারেনা। খুশিই হয়েছিল উটু, কলামের লোভে তাকে হয়তো একটু তেলাবে, এই সুযোগে এবার বিদেশ গেলে দু'টো স্কচের অর্ডার দিয়ে দেবে। হা-হতোস্মি, মহা নিমকহারাম, কলাম লিখে পয়সাটা পেয়েই আর তাকে চেনে না। আলু ব্যবসা বোঝে, সাকিবের লাগামছাড়া কথাবার্তা পাবলিক খায় ভাল, কাজেই লেখাটা বন্ধও করে দিতে পারছে না। চামে অবশ্য সেবার "বিনয় শিক্ষা"র উপর বেশ কিছু তৈরি লেকচার দিয়ে ফেলেছিল, কিন্তু খোমাখাতা আর "বোলোগ"-এ আরো এত এত বেয়াদব গজিয়ে গেছে যে তার সেসবশিক্ষা পানিতে গেছে।
তো এসব কারণে এবার বিদেশ সফরে সদ্য গোঁফ গজানো একটা দলের কাছে সাকিবালের দলকে আড়ং ধোলাই খেতে দেখে উটুদা বেশ দিলখুশ। আশু আবার টেস্টে ভাল করে ফেলেছে, এ নিয়ে বেশ ক'দিন বগল বাজানো গেছে, এরপর সাকিবাল কে "ক্যামনে কি" শিখিয়ে দেয়ার একটা প্রস্তুতিও নিয়ে ফেলেছে, কিন্তু ছোকরাটা বেয়াদব হলেও নিজের কাজ জানে, কিছুতেই আশুর মত ১০০ ভাগ ডাব্বা নিয়ে ফেরে না। তামিমটা আরেক বেয়াদব, এবার অবশ্য ঠাণ্ডা হয়ে গেছে, তবে উটু'র ধারণা, যতই ফেয়ার অ্যান্ড হ্যান্ডসাম মাখুক, এই পোলা ফর্সা, থুক্কু, বিনয় শিখবে না, কয়লা সে কয়লাই থাকবে। ফোকটে এবার উটু চেষ্টাও করেছে জিম্বাবুয়ে সফরে সবার "পারফর্ম্যান্স রেটিং" করে আশুকে একটু তোলা যায় কিনা, কিন্তু গাধাটা দুই ইনিংস ভাল খেলেই যথারীতি কর্তব্য শেষ করাতে সেখানেও সুবিধে হয়নি। সব মিলে খেলার পাতা ঠাণ্ডা, মতি ভাই পর্যন্ত ঠারেঠোরে বুঝিয়ে দেন, রোববারের দিন বিক্কিরি কমে যাচ্ছে হে, তোমাদের ঈদ বোনাস দিতে তো কষ্ট হয়ে যাবে উটুবাবু!
সেজন্যই নতুন কিছুর খোঁজে উটু নিজেই গেসলো বিসিবি অফিসে। ড্রেসিংরুমের দিকে যাওয়ার পথেই তামিমের সাথে দেখা, পশ্চাদ্দেশ কিন্ঞ্চিৎ ভারী, একটু ফর্সাও হলো নাকি? ফেয়ার অ্যান্ড হ্যান্ডসাম কেমন কাজ করছে জিজ্ঞেস করবে কিনা ভাবতে ভাবতেই তামিম এগিয়ে এসে হাত বাড়ায়, উটু ভাবে, মনে হয় ভয়ে আছে, হুঁ হুঁ বাবা, ধরা খেয়েছো কিনা! কুশল প্রশ্ন শেষে হালকা খোঁচা মারে-- কিহে তামিমবাবু, ভিটরি কি স্বপ্নে দেখা দেয়? হেহেহে করে খানিক হেসে তামিম বলে--আরে উটুদা এইটা একটা কথা কইলেন, আমি লর্ডস ছাড়া ভাল খেলিনা এইটা তাবৎ দুনিয়ার লোকে জানে, ভিটরির মত সেইদিনের পোলারে মারলে আমার একটা ইজ্জতের ব্যাপার আছে না? আর টিমের বেকতেই বাল ফেলায়, খালি সাকিব এট্টু ভাল খেলে,এইসব নিয়া ভাবতাসি না, দেখেন না, আমারে বিজনেস ক্লাস না দিয়া পারসে?আরেকটা সেন্ঞ্চুরি মারলে ভাবতাসি ডাইরেক্ট পাইলটের লগে সিট চামু, হালায় না দিয়া যাইবো কই? চোখ টিপি দিয়ে এগিয়ে যায় তামিম, এই কথাগুলো গুছিয়ে লিখলে একটা ভাল খবর হতে পারে কিনা ভাবতে ভাবতে এগোয় উটু, সিডু যাওয়ার পরে জুনায়েদ বেশ ভয়ে আছে, ওরে চাপ দিলে কিছু "ইনসাইড" নিউজ আসতে পারে। ভাবতে ভাবতেই ড্রেসিংরুম এসে যায়, উঁকি দিতেই হুংকার, কে রে? উট-পাল আঁতকে উঠে দু'পা পিছিয়ে যায়, ভয়ে ভয়ে আবার এগোয়, নবাবজাদার মত সাকিবাল বসা, ভঙ্গি দেখলে গা জ্বলে যায়। উটু হালকা হাসি দিয়ে বলে, আসবো? সাকিব থমথমে মুখে বলে, না আসবেন না, আপনাদের সবার প্রবেশ নিষেধ, এখন বিদায় হন, বহুৎ বিলা আছি। অপমানিত বোধ করে সে, কিন্তু হাম্বা হতে হলে অপমানবোধ থাকতে হয় না, আমতা আমতা করে বলে, কোন সমস্যা? সাকিবাল এবার কোন কথা না বলে উঠে এসে দড়াম করে দরজা লাগিয়ে দেয়, উটুর মুখের ওপরই।
এমন অপমানের পর আর কার মেজাজ ঠিক থাকে? মনে মনে সাকিবালের মাতাসংযোগে কিন্ঞ্চিৎ গালিবর্ষণ করতে করতে আলুর বারান্দায় পা দেয়, আর সোজা সামনে মামদো। আর যায় কোথায়? "কি মিয়া কই থাকো, বালসাল তোমাগো খুঁইজা পাওয়া যায় না, এই গরমের মধ্যে তোমরা ঠাণ্ডা হাওয়ায় বাল ছিঁড়বা আর আমি বিসিবি অফিসে দৌড়ামু? নেক্সট সপ্তাহে ভাল ফিচার দিবার পারলে দেও, নাইলে বিদায় হও, বলদ পালার দরকার আমার নাই, মতি ভাইরে কমু ১টা ছাগল আইনা দিতে।" হতভম্ব মামদোকে রেখেই গরগর করতে করতে ভেতরে চলে যায় উটপাল, ব্যাপার কিছু খারাপ বুঝে মামদোও চুপ থাকে, তবে কিছু একটা যে করতে হবে সেই জেদ তার মাথায়ও চেপে যায়। বলদ, হাহ! তুমি শেয়াল হলে আমি নেকড়ে,বাবা উটু, দেখো কি করতে পারি।
তো সেই "করা"র ফলাফল এখন ল্যাপটপের স্ক্রিনে জ্বলজ্বল করছে, এককালের জাতীয় দলের ফাস্ট বোলার শাহাদাঁতের আস্ত একখানা সাক্ষাৎকার। পড়ছে আর দাঁত বের করে নিজেই হাসছে মামদো, কি সব প্রশ্ন আর কি তার জবাব, প্রতিটা বাঁধাই করে রাখার মত। জাতীয় দলে এখন বেয়াদবগুলোর আনাগোনা, উটুকে কিছু বলে না বটে, কিন্তু তাকে চড়চাপড় মেরে দিতে পারে, ওদিক গেলে লাভ নেই, কাজেই খুঁজেপেতে দল থেকে বাদ পড়া রামছাগল প্রকৃতির একটাকে দরকার ছিল তার। নারায়নগন্ঞ্জের সকল কলেজ বালিকাদের পেছনে শাহাদাঁতের ঘুরপাক খাওয়ার বিষয়টা জানা ছিল তার, কোরবানী করার জন্য এই বলদটাই ভাল মনে হলো। পয়সাকড়ি পেলে আসলেই যে মূর্খগুলোর মাথা বিগড়ে যায় সেটা একে দেখলে বোঝা যায়, নব্য ধনীর মতই সামান্য তেল দিলেই হড়বড় করে সব বের হতে থাকে। অবশ্য মামদো আরেকটু সাফল্যের জন্য দু'ঢোক গিলিয়েছেও ছোঁড়াকে, নিজেও চালান করেছে কয়েক পেগ, অবশ্যই ছাগলটার পয়সায়, নিজের পকেট থেকে তারা কখনোই খায়না। শুরুতে ভেবেছিল প্রেম-ভালবাসা নিয়ে দু'চার কথা বের করতে পারলেই উটুকে ঠাণ্ডা করার মত একটা খবর হবে, কিন্তু উপরওয়ালা সেদিন তার দিকেই তাকিয়ে ছিলেন, কাজেই শাহাদাঁতের প্রেমের ইতিহাস থেকে শুরু করে সে যে "ল্যাক্সাস" এ চড়ে তার বান্ধবীদের ঘুরাতো সেটার রসালো বর্ণনাও শোনা হয়ে গেছে, সাথে সিনেমায় নামলে বিন্দুকে নিয়ে কি কি করবে তার বিশদ বর্ণনা। সাক্ষাৎকারে অবশ্য সেসব লেখা যায় না, তবে রেকর্ড করা আছে, ছোকরা ঝামেলা করলে দেখানোর জন্য। বলদটার এত বুদ্ধি নেই, নিজেকে শাহরুখ খান ভেবে মহা ফুর্তিতে তাকে দু'প্যাকেট লেক্সাস বিস্কিট সহ নিজের লেক্সাসে চড়িয়ে বাড়ি নামিয়ে দিয়ে গেছে, ভাগ্যে গভীর রাত ছিল, নয়তো মাতালটার গাড়ির নিচে দু'চারটা চাপা পড়লে অবাক হবার কিছু ছিল না।
সাক্ষাৎকারটার ড্রাফট উটুদা'কে দেখানোর পর গুরু বাকরুদ্ধ হয়ে তাকে জড়িয়ে ধরেছেন, পিঠে দু'টো চাপড় দিয়ে বুঝিয়েছেন, শিষ্যের কাছে তার আশা আজ পূরণ হলো। এইরকম কাদা ঘেঁটে নোংরা বের না করলে আর উটুদা'র চ্যালা? নিজে সংশোধন করে দিয়েছেন লেখা, পরদিন লেখাটা ছাপা হবার পর থেকে বিপুল সাড়া দেখে মামদো নিজেই মুগ্ধ। খোমাখাতা আর বোলোগে ঝড় বয়ে যাচ্ছে, বলদটার কথাবার্তায় সবাই ঈদের আনন্দ পাচ্ছে। কিছু দুর্মুখ অবশ্য এর মাঝেও তাকে গালি দিয়ে গেছে, কিন্তু মামদোর মতে--"কোন মার্কেটিংই খারাপ নয়।" স্বয়ং মতিভাই এসে অভিনন্দন জানিয়ে গেছেন, বলেছেন এমন আর দু'চারটা রিপোর্ট করলেই বেতন বাড়িয়ে দেবেন। এমনকি উটুদা'র মত হাড়হাভাতে পর্যন্ত নিচে নেমে খাসির "ইসপিশাল চাপ" আর "খাস্তা পরাটা" খাইয়ে দিল, কি কপাল! মৃদু মৃদু হাসতে হাসতে ভুঁড়ির ওপর হাত বোলায় সে, সুখের চোটে মনে মনে বিন্দু মেয়েটাকেও কল্পনা করে ফেলে নিজের পাশে দু'এক মুহূর্ত, অরুণ চোধরি পারলে সে নয় কেন?
কল্পনায় বাধা পড়ে মোবাইলের রিংটোনে--ঢিংকা চিকা ঢিংকা চিকা তালে মোবাইলটা কানে লাগায় সে। হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে উটুদা'র উত্তেজিত গলা-- ওরে মামদো, মার দিয়া কেল্লা। সোজা হয়ে বসে সে-- কি হলো বস? কেডা মরলো? "আর কেডা, বেয়াদব সাকিবাল, লগে তাইম্মা। ২টাই ফিনিশ। দিসি লাগায়া। আমাগো লগে বিয়াদ্দবি করসে তো করসেই, আমাগো হাবু ভাইরেও নাকি রুমে ঢুকবার দিত না, এইবার ফিনিশ, ক্যাপ্টেনসি গেসে। জলদি সোনারগাঁওতে আয়, এট্টু পানির লগে প্ল্যান করি আমগো আশুরে এই চান্সে কাপ্তান বানায়া দেওন যায় নাকি!"
ফোনটা কেটে দিয়ে শিষ দিয়ে "শীলা কি জওয়ানি" ভাঁজতে ভাঁজতে আন্ডারওয়্যারটা নিচে গলায় মামদো, হাবুল বাশারের পকেট কেটে আজকে "ফরেন জিনিস" দিয়ে ভাল ফূর্তি হবে।
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই সেপ্টেম্বর, ২০১১ রাত ১১:৪৪