কারো যদি হঠাৎ করেই মনে হয় লেখার বিষয়বস্তুর অভাব পড়ে গেছে অথচ যেভাবেই হোক ২-১ টা হাবিজাবি লেখা নামিয়ে দিতে ইচ্ছা করছে, তখন ভাল সমাধান হলো বসুন্ধরা সিটিতে ঢুকে ৩ বা ৪ তলায় উঠে চলন্ত সিঁড়িটার আশপাশে দাঁড়িয়ে থাকা। দেখতে না চাইলেও অনেক কিছু দেখা হয়ে যাবে, কত রঙের কত চিড়িয়া যে এই দুনিয়াতে ঘুরে বেড়ায় যার মাঝে সিঁড়ির ধারে বেহুদা দাঁড়িয়ে থাকা এই কীবোর্ডচালকও একজন, বেশ মালুম হবে ঐ চোখধাঁধানো শীতাতপনিয়ন্ত্রিত চিড়িয়াখানায় ঢুকলেই। উঠছে-নামছে-ঘুরছে-খেলছে-হাসছে-কাঁদছে-চেঁচাচ্ছে বারো স্কয়্যারে না হলেও একশত চুয়াল্লিশ রকমের মানুষ নামের পক্ষী, না চাইলেও ভাবতে হবে উপরওয়ালা তাঁর রঙের প্যালেট নিয়ে ইচ্ছামত রঙ গুলে সৃষ্টির ক্যানভাসে ছিটিয়েছেন আপন খেয়ালে আর তারপরে বলেছেন "হও" আর তার সবচেয়ে উদ্ভট জগাখিচুড়িগুলো এখানে এই বিশাল কমপ্লেক্সে নেমে এসেছে।
এই রাত ১০টায়ও জায়গাটা দেখে মনে হচ্ছে বিকাল ৪টা, বা অফিস ঘণ্টাও বলা যায়। পিলপিল করে লোকজন ঢুকছে তো ঢুকছেই, মোটাসোটা খালামনি থেকে শুরু করে রঙবেরঙের প্রজাপতি আপুমনি বা ফড়িঙের মত টিঙটিঙে ছোকরা, আবার নানী-দাদীরও অভাব নেই। এই অধমের উদ্দেশ্য অবশ্য কেনাকাটা নয়, অনুরোধে ঢেঁকি গিলে আগমন, এক বন্ধুর ঈদের কেনাকাটার জন্য তাকে সঙ্গদান।
বেচারার লক্ষ্য ছিল একজোড়া স্যান্ডেল কেনা, কিন্তু জুতোর দোকানগুলোতে ঢোকার পর থেকে আমাদের গলা শুকাতে শুকাতে এখন শিরিষ কাগজের মত ঠেকছে। আগুন দাম বলে একটা শব্দ ছিল, এখন এটাকে প্রতিস্থাপন করার মত কোন শব্দের দরকার, কারণ একদম রদ্দি মার্কা পুরোনো ডিজাইনের স্যান্ডেলের দামও যখন ১৫০০ টাকার উপরে, "আগুন" শব্দটা দিয়ে মধ্যবিত্তের কাছে এই দামের ভয়াবহতা বুঝানো যাবে না। দরজার সামনের দিকে বাটার দোকানে "নিউ আ্যরাইভ্যাল" ট্যাগ লাগানো কয়েকটা স্যান্ডেল, দাম দেখে আঁতকে উঠলাম, কোনটাই ২০০০ এর নিচে না, সর্বোচ্চ ৪৯০০ পর্যন্তও আছে। গ্যালারি অ্যাপেক্সে এমনকি রদ্দি মার্কাগুলোরও দাম ২০০০ এর উপরে, লোকজন দেদার কিনছে, আমরা বেইল পাবোনা বুঝে সরে পড়লাম। "হাশ পাপিজ" নামে নতুন একটা বিদেশী ব্র্যান্ডের দোকান খুলেছে, কোন কুক্ষণে উঁকি দিয়েছিলাম জানি না, সর্বনিম্ন দাম ৪৯০০ এবং আশপাশেরগুলো ১০ থেকে ১২ হাজার দেখে তখন থেকে চোখে সর্ষেফুল দেখছি।
কাজেই স্যান্ডেল কেনার আশা বাদ দিয়ে বন্ধু এখন গেছে চোখেমুখে পানি দিতে আর আমি দাঁড়িয়ে আছি ৪ তলায় রেলিং ধরে উদাস চোখে। নিজে অবশ্য ঈদ গায়ে দিয়েই ঘুরছি, গ্রামীন থেকে কেনা ২৫০ টাকার হালকা শার্ট আর অনেক কষ্টে চক্রাবক্রা ছেঁড়াফাটা না লেডিস-না জেন্টস জিন্সের ভিড় থেকে উদ্ধার করা একটা প্লেইন ব্লু জিন্স, আশপাশের ডিজুসদের ভিড়ে বেশ খ্যাত ধরণের লাগছে সেটা অস্বীকার করছি না। তবে আপাতত চিন্তা হলো বন্ধুর বাজেটের মাঝে কি করে একটা ভদ্রস্থ শার্ট কেনা যায় সেটা। দোকানে গিয়ে দোধারী তলোয়ারের আক্রমণের মত দ্বিমুখী সমস্যায় পড়া গেছে। প্রথম সমস্যা ডিজাইন নিয়ে, লোকে যতই খ্যাত বলুক, আজকালকার জোড়াতালি দেয়া ডিজাইন কিছুতেই আমাদের পছন্দ হচ্ছে না, বিশেষ করে হাতে-কাঁধে-পিঠে তালি মারা এবং আরো জঘণ্যভাবে কাঁধের উপর রেলওয়ের টিটিদের মত ব্যাজ লাগানো শার্ট কেন পয়সা দিয়ে কিনতে হবে সেটা অনেক ভেবেও বের করতে পারিনি। ওরকম চাইলে তো বাসার পুরোনো শার্টগুলোই এদিক ওদিক কেটে নিয়ে আরেক জায়গায় লাগালেই হয়, দোকানে আসতে যাবো কেন? নতুন প্রজন্ম মনে হয় আমাদের সাথে একমত নয়, দেখি এক ডিজুস কিশোর তার মা'কে বোঝাচ্ছে, আজকাল এসবই চলে, এটাই কিনবো, হাতে একটা রঙবেরঙের জিন্স আর ব্লাউজ সাইজের শার্ট। মাতাজী মনে হয় এখনো ঠিক মানিয়ে উঠতে পারেননি, বেশ একটা বিতর্ক জমে উঠেছে।
সবাই আবার এই মাতাজির মত নন, পাশ দিয়ে হঠাৎ কিম্ভুত কিছু একটা চলে যেতে ঘাড় ঘুরাই, বেশ খানিক সময় লাগে বুঝতে এটা একটা মানুষ, আরো স্পষ্ট করে বললে, একটা মেয়ে। ড্রেসআপের বর্ণনা নিষ্প্রয়োজন, কারো কৌতুহল হলে তিশমাকে দেখে নিতে পারেন, তবে মেকআপে তিশমাও পিছনে পড়েছে, এমন কালো রঙের মেকআপ দেখে গথিক ব্যান্ডের গায়িকারাও লজ্জা পেয়ে যাবে। সাথের ভদ্রলোক সম্ভবত তার বাবা, মেয়ের কীর্তিতে ঘাড় উঁচু করে মোরগের মত চলেছেন। আশপাশে এমন নমুনা আরো কয়েকটা দেখা গেল, আর নিশ্চিতভাবেই দেশে আজকাল সাম্যাবস্থা বিরাজমান, ছেলে-মেয়ে সবাই জিন্স জিনিসটাকে হাঁটু পর্যন্ত পড়ার ব্যাপারে চুক্তিবদ্ধ, এর নিচে হলে সম্ভবত সৌন্দর্য দেখানো যায় না। যদিও যারা ইয়োগা চর্চার হাঁটু উঁচু স্কিনটাইট ট্রাউজার পরে বসুন্ধরায় চলে আসেন, তারা হলিউডের নায়িকাদের ছবিটা পাশে রেখে নিজেকে একটু মিলিয়ে দেখতে পারেন আগে। নিশ্চিতভাবেই, নিজেই নিজেকে দেখে বলে উঠবেন--"ওহ, অবসিন"।
বন্ধুর আগমনে নীতিচর্চা বা পরীচর্চায় ছেদ পড়ে, একটা শার্ট কেনার কঠিন সংগ্রামে লিপ্ত হই। লোকজনের ভিড়ে দোকান গুলোতে ঢোকাই মুশকিল, কালো টাকা কোথায় যায় সেটা দেখার জন্য শপিং কমপ্লেক্সগুলো একটা ভাল জায়গা, কে কত দাম দিয়ে জিনিস কিনছে সেটা দেখে পিছন নিলেই কালো টাকা বা ঘুষখোরদের ধরতে কষ্ট করা লাগবে না বলেই মনে হয়। এখানে অবশ্য এই অধমের একটা ব্যক্তিগত অন্ধবিশ্বাস কাজ করে, সৎপথে না হোক, অন্তত কষ্ট করে যারা টাকা কামায়, তারা কেটে ফেলেও ঈদের মার্কেটে ১৫-২০ হাজার টাকা দিয়ে একটা জামা কিনে ফেলবে না, কোনভাবেই না। ইজি কাম, ইজি গো, কাজেই ঘরে এসে ঘুষের টাকা দিয়ে গেলে অথবা সাধারণ মানুষের গলায় ফাঁস লাগিয়ে যেসব ব্যবসায়ী রক্ত চুষে নেয়, তাদের জন্যই এভাবে লক্ষ লক্ষ টাকা উড়িয়ে দেশের পণ্যের দাম আকাশে উঠিয়ে দেয়া সহজ এবং সেটাই হচ্ছে, হবে আরো। এমনকি ব্লগেও যখন দেখি ৪০০০ টাকা করে ২ সেট কি এক হিন্দি ছবির ট্রেন্ডে উঠে আসা জামা কিনে সেটা নিয়ে গর্ব করে পোস্ট দেয়া হয় আর সেটা নিয়ে সবার আদিখ্যেতা ফেটে পড়ে, তখন আসলেই নিজেকে খুব বেশি ছোট, খুব বেশি অসামাজিক মনে হয়। কে জানে, আমরাই হয়তো ভুল, আমরাই হয়তো পিছিয়ে আছি, এভাবে হাওয়ার সাথে তাল মিলাতে পারলেই না আধুনিক, কি আসে যায় বাকি কোটি মানুষ ২ বেলা খেতে পারলো কি পারলো না!
নীতিকথা বাদ দিই, কারণ আমরা এখন আছি দুর্নীতির প্রদর্শনীর আখড়াতে। কয়েকটা দোকানে ঘুরাঘুরি করে আমাদের শুকনো গলা এখন মরুভূমি, কারণ যেটাই পছন্দ হয় দাম ১৭০০-৩০০০, অথচ গত ঈদেই প্রায় একই ডিজাইনের শার্টগুলো ছিল ১০০০ এর কাছাকাছি। চামে পেলেই দাম বাড়িয়ে দেয়ার এই সংস্কৃতি আমাদের মধ্যবিত্তদের শেষমেশ ফুটপাথে নামিয়ে দেবে কিনা সেটা ভেবে শংকিত, অবশ্য
কালো টাকা আর ঘুষের অবাধ স্রোতে সেই শংকা অনেকেই হাওয়ায় উড়িয়ে দেবে জানা কথা। ১০০০ এর নিচে শার্ট নেই তা না, তবে সেগুলো মনে হয় ৩-৪ বছর আগের গুদামের মাল সোজা এনে ফেলে দিয়েছে, এরচয়ে বঙ্গমার্কেট জিন্দাবাদই ভাল। অনেক ঘুরে শেষমেশ ঠিক ১০১০ টাকায় একটা পাওয়া গেল, শুকনো মুখে বন্ধু টাকা বের করে শার্ট নিয়ে বের হলো, বেচারা সিভিল এন্ঞ্জিনিয়ার,
বেতনের ১০ ভাগের ১ ভাগ ১টা শার্টেই খতম।
বের হতে গিয়ে ঘড়িতে দেখি ১১টা, এখনো খালাম্মারা ঢুকছেন, হাতে একগাদা ব্যাগ, মনে হয় শেষবেলার খ্যাপটা দিয়ে যাচ্ছেন। ডিজুস পোলাপানের প্যান্ট খুলে আন্ডারওয়্যার দেখানো ফ্যাশন আর উদ্ভট গথিক মেকআপ আর হেয়ারকাটিং আর অশ্লীল বাংলিশের মিশ্রণে শরীর দেখানোর ভিড়ে সবকিছু কেমন যে অবাস্তব লাগে। পুরো শপিং কমপ্লেক্সটায় একমাত্র মন ভালো করা দৃশ্য হলো ছোট ছোট বাচ্চাগুলো,
পুরো দুনিয়ার সব খুশি নিয়ে রঙিন প্রজাপতির মত উড়ে বেড়াচ্ছে যেন বাবা-মায়ের হাত ধরে। এর মাঝেই ২টা বাচ্চা আমার পায়ের নিচ দিয়ে গলে যাবার চেষ্টা করেছে, হাত দিয়ে চুলগুলো এলোমেলো করে দেবার পরে চোখ পাকিয়ে তাকিয়েছে, গায়ে এসে ধাক্কা খেয়ে পড়তে পড়তে বেঁচে গেছে আরো ৩টা, তারপরেই ছুটে গিয়ে আরো কারো ঘাড়ে পড়ার তাল, দেখলেই মনটা ভাল হয়ে যায়। কী এক
বিষাক্ত শহরে কতগুলো খোলা বাতাস, কি রেখে যাচ্ছি আমরা ওদের জন্য সীসা আর আবর্জনা বাদে? জবাব পাই না, আজকাল মাথা ঘামানো ছেড়ে দিয়েছি, খুব তাড়াতাড়ি যন্ত্র হয়ে যেতে হবে।
বের হয়ে স্বস্তির শ্বাস ফেলি, ফুটপাথেও ঈদের ধুম, তবে সেখানে "সব ২০০, মাত্র ২০০, নিয়া যান ২০০।" অনেক কম, তারপরেও কিনতে পারে না অনেকে, ঘ্রাণে অর্ধভোজনের মত তাদেরও দর্শনে অর্ধক্রয়। এখানে যখন হাজারে আর লাখে কারবার চলছে, ঠিক তখনই এই লাখের ক্রেতারা কোনদিক দিয়ে সিন্ডিকেট করে আমাদেরই সর্বস্বান্ত করার ধান্দা করছে, আর এই লাখে আর
কোটির "শো-অফ" এর খাঁড়ায় পড়ে দিন দিন সারা পৃথিবীর কাছে নিজেদের অসভ্যতম জাতি হিসেবে পরিচিত করে তুলছি আমরা, যাদের কিনা ৭০% লোক দু'বেলা খেতে পায় না কিন্তু যে দেশে ঈদের মার্কেটে লাখ টাকার লেহেঙ্গা-শাড়ি আর ১০ লাখের গরু বিক্রি হয়। বিশাল ঐ শপিং কমপ্লেক্সের আলো আর জাঁকজমক খুব বেশি অবাস্তব আর অসভ্য মনে হয় তখন, যদিও নিজেকে কখনোই প্রলেতারিয়েত হিসেবে দাবী করি না। সারভাইভ্যাল অভ দ্য ফিটেস্টের যুগে চিন্তাটাকে আলগা দুঃখবিলাস বলেও চালানো যায়, রাস্তায় জমে থাকা কাদাপানি ছোট্ট একটা লাফ দিয়ে এড়িয়ে উঠে পড়ি দাঁড়িয়ে
থাকা একটা অন্ধকার বাসে, মাথা ঝাঁকিয়ে বন্ধুর অফিসের গল্পে মন দিই।
রাতে ভাল করে একটা ঘুম দিয়ে মাথা থেকে এসব জন্ঞ্জাল বের করে দিতে হবে, স্রোতের সাথে না মিশে গেলে কোনদিন যে ঘূর্ণিতে তলিয়ে যাবো, লাশটাও কেউ খুঁজে পাবে না।