ইনঅরগানিক কেমিস্ট্রির,যে বিষয়টা আমার দু'চোখের বিষ ছিল ভার্সিটির প্রথম বর্ষে (অবশ্য পড়ালেখা জিনিসটাই সবসময় তাই ছিল),একটা শব্দ আমার অনেকদিন পরে সেদিন মনে পড়লো,রিকশাতে বসে। সুপার স্যাচুরেটেড সল্যুশন,সাধু বাংলায়,অতি সম্পৃক্ত দ্রবণ। পড়ালেখার কোন ব্যাপার আমার মনে থাকে,বা ভুল করেও মনে পড়ে,অতি বড় শত্রুও এমন দাবী করবে না,মনে পড়াপড়ির কাল ফেলে এসছি স্কুলেই,এখন,বা অনেক আগে থেকেই,শুধু ভুলেই যাই আর না ভুলে গেলে শুধু ভুলতেই চাই সবকিছু।এই যখন অবস্থা,তখন চরম খটমটে একটা বিষয়ের ততোধিক খটমটে একটা শব্দ মনে আসায় নিজের উপরই বিরক্ত হই,আর এরপর বুঝতে পারি টাকা যেমন টাকা আনে সেভাবেই বিরক্তিকর ব্যাপারস্যাপারও লগারিদমিক স্কেলে বেড়ে গিয়ে আরো বিরক্তিকর ব্যাপারের জন্ম দেয়।
যাই হোক,দ্রবণে ফিরে যেতে হচ্ছে। শব্দটা যখন মাথায় চলেই এল,এর শানে নুযুল আর উৎস সন্ধান করাও জরুরী। মাথা চুলকাই,সূত্রমতই চুলকানো বাড়ে। ইংরেজিতে পড়তাম তখন,ভাষাটায় দক্ষতা নেই একেবারেই, কাজেই সব সংজ্ঞা ব্যাখ্যা তত্ত্বের একটা বাংলা ব্যাখ্যা বুঝে নিতে হতো কোন সদয় সহপাঠীর কাছ থেকে,সেরকমই কোন একটা সংজ্ঞা মনে করার জন্য মনমাথা হাতড়াই।মোটামুটি মনে পড়ে,সংজ্ঞা না,উদাহরণ। পানিতে চিনি মেশানো নিয়ে। মানে কিনা,একগ্লাস পানিতে চিনি মেশাচ্ছি,যতক্ষণ আরো চিনি মেশানো যাবে,সেটা অসম্পৃক্ত দ্রবণ। তারপর এমন এক অবস্থা চলে আসে,যখন আর এককণা চিনি পড়লেও সেটা থেকে চিনির অধঃক্ষেপ পড়ে যাবে,সেই অবস্থাটাই সুপার স্যাচুরেটেড, অনেকটা চিনির কণার পুলসিরাতের হাল আরকি।(পরীক্ষাতেও এইভাবেই লিখেছিলাম,গ্রেডটা আর মনে করতে চাইনা)।
তত্ত্বটা মনে পড়ায় স্বস্তি পাই,যাক এখনো মগজে মানুষের কিছু অংশ অবশিষ্ট আছে,গর্দভ প্রজাতিকে আরো কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে নিজেদের দল ভারি করার জন্য।তত্ত্ব মাথায় ঢোকার পর,কার্যকারণও যেন একটু একটু করে ঢুকতে শুরু করেছে। বসে আছি রিকশায়,চিরচেনা সেই মৌচাক মোড়ে, ডানে রিকশা বামে প্লাস্টিক সামনে ফাল্গুন পিছে সিএনজি,সবাই মহাব্যস্ত তবে একদম ডেডলকে আটকা,প্রাণপণে হর্ন আর গালাগালি চলেছে আর সিগন্যালে ট্রাফিক লালন সাঁইয়ের ভাব ধরে দাঁড়িয়ে আছে। স্যাচুরেটেড,সুপার স্যাচুরেটড,পিঁপড়াটাও গলে যাবার উপায় নেই।
পিঁপড়া নিয়ে অবশ্য না,ঠিক এই মুহূর্তে আমার চিন্তা মৌচাকের মোড়টা এই রিকশা আদৌ আজকে পার হতে পারবে কিনা। বসে বসে দেখার মতও কিছু নেই,গ্রামীন বাংলালিংক নেসলে লেমু রাঁধুনি ইত্যাদি ইত্যাদি দেখে দেখে মুখস্থ হয়ে গেছে,মোবাইলের ছোট্ট স্টার দেয়া বিশেষ শর্ত থেকে শুরু করে নেসলের দুধের উপাদান সবই মাথায় বসে গেছে। ফাল্গুন বাসটার ভিতরে থাকলে কিছু সুন্দরী দেখা যেত,যদিও সন্ধ্যার বাসের ভেতরটায় এত বেশি গাদাগাদি আর অফিসফেরত মানুষগুলো এত বেশি অবসন্ন বিষন্নতায় সম্পৃক্ত হয়ে থাকে যে হলিউডের নায়িকা বাসের ভেতরে ঢুকে পড়লেও মনে হয় কেউ একবারের বেশি তাকাবে না।ঢাকার মানুষগুলোর জীবনটাও স্যাচুরেটেড,দৌড় আর দৌড় আর দৌড়,অর্থ বিত্ত সাফল্য বা ভোগবাদীতা অথবা কিছুই না,তারপরেও দৌড়। অর্থহীন
আনন্দ,অর্থহীন হাসি,চাকরি ব্যবসা ঘোরা শপিং ফাস্টফুড ডেটিং বিলিয়ার্ড আর সবশেষে দ্রবণের অধঃক্ষেপের মতই বিছানায় পরে ভোঁস ভোঁস করে ঘুমানো বউ বা কোলবালিশ বা বান্ধবীর সাথে।
আবোলতাবোল ভাবি আর এইবারে ডানবাম বাদ দিয়ে উপর নিচেও তাকাই। তাকানোর বিশেষ জায়গা রাখেনি কেউ,সম্পৃক্ত শহরের দালানকোঠাও তাল রেখে উপরে নিচে গজিয়ে গেছে,কংক্রিটের জঙ্গলে আকাশ আর পাখি এখন পথ খুঁজে পায়না। ধোঁয়ায় ধুলোটে রাতের আকাশে সপ্তর্ষিমণ্ডল খুঁজি,কোথায় কি? সবচেয়ে উঁচু দালানটার উপরে উঠে একদিন ধোঁয়ার মেঘ ভেদ করে দেখতে খুব ইচ্ছা করে,ঘোলাটে চাঁদটা আসলেই জীবনানন্দের মনে মরিবার সাধ জাগাতো কিনা জানতে ইচ্ছা করে। ধুলোঢাকা চাঁদটা ভূতের কাছেও ভুতুড়ে লাগবে সন্দেহ নেই,ঢাকার উজাগড় মানুষকে চন্দ্রাহত করেনা,স্যাচুরেটেড জোছনায় শুধু একদানা অধঃক্ষেপই বাড়িয়ে যায়।
জ্যাম ছুটেছে,সিগন্যাল পার হয়ে সিদ্ধেশ্বরীর গলিতে ঢুকি।কোচিং সেন্টারগুলো থেকে পিলপিল করে দেশের ভবিষ্যৎরা বের হচ্ছে,দলে দলে,আবার জোড়ায় জোড়ায়ও।পড়াশোনায় না হোক বয়সের আগেই পেকে ওঠার ব্যাপারে অন্তত এরা মূল্যবান অবদান রেখে চলেছে সন্দেহ নেই,রাধা-কৃষ্ঞের যুগে কোচিং সেন্টার থাকলে বেচারি রাধাকে সাপের মাথার মণি চেপে ধরে অভিসারে বের হতে হতো না। প্রেমও মনে হয় স্যাচুরেটেড হয়ে যাচ্ছে,কে যে কয়জনের সাথে আছে বুঝে ওঠা মুশকিল,৩-৪ টা সিমের ক্রস কানেকশনে রাতের পর রাত পার,শেষমেশ সবাইকেই অধঃক্ষিপ্ত আর কাউকে ক্ষিপ্ত করে আবারো নতুন কোন এলিমেন্টে ভালবাসার রসায়ন খোঁজা।
ছাত্রের বাসায় ঢুকি,একঘেয়ে সেই পুরানো পড়া, ঘ্যানঘ্যান,ছুঁড়ে ফেলতে ইচ্ছা করে সবকিছু। ছেলেটা নিরীহ, ঝাড়ি দিয়ে লাভ নেই,মোটের উপর কিছু পয়সা তো দিচ্ছে। ফিরতি পথে জ্যাম কম,কিন্তু মানুষের কমতি নেই। একটা বাস এলেই ঝাঁপিয়ে পড়ছে মোড়ের সবকয়টা লোক,রিকশাবিলাসের দিকে কারো আগ্রহ নেই,রিকশাওয়ালারা এখন নবাব,বিড়ির সুখটানে মধ্যবিত্তকে উপেক্ষা করা এখন ডালভাত। একঘেয়ে বাড়ি ফেরা বাসের চাপাচাপিতে,নেমে পড়ি একটু আগেই। শান্ত
একটা রাস্তায় ঢুকে পড়ি,মধ্যরাতের বাউল হতে ইচ্ছা করে একবারের জন্য হলেও। সাহস পাই না শুধু পালাতে,স্বীকার করি বা না করি কংক্রিটের কঠিন বন্ধনে নিজেও আটকা পড়েছি কখন যেন। সংসারছাড়া বাউলের দুরন্ত প্রকৃতির দিকে ঈর্ষাভরা চোখে তাকিয়ে থাকাই শুধু নিয়তি,লালনের ভাস্কর্য দেখে মডার্নিজমের চর্চা করলেও অন্তরে লালন হয়ে ঘর ছাড়ার ভাগ্য সবার হয়না। শিরোনামহীনের একটা গানে কয়দিন ধরেই অবসেসড হয়ে আছি,জ্বালাচ্ছে,মাথা থাকে তাড়াতে পারছি না,বেজেই চলেছে,অন্ধকার গলি দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে গুনগুন করে উঠি --"আমি তাকিয়ে রই,নীল আদিগন্ত,মানুষ ভরা খোলা প্রান্তরে,আর চেয়ে দেখি,তোর খোলা চুলে,ভেসে যায় আমারি স্বপ্নগুলো,নিশ্চুপ আঁধারে।"
নিস্তব্ধ অন্ধকারে কেউ কি আমার সাথে হাঁটতে আসবে,একবারের জন্য হলেও সম্পৃক্ত দ্রবণ থেকে বাষ্পকণা হয়ে উড়ে যাবার জন্য?
[লেখাটা লেখার সময়েও মনে হচ্ছিলো,সুপার স্যাচুরেটেড হয়ে গেছি,খামোকাই একটা বাড়তি অখাদ্য লেখা দিয়ে হয়তো অধঃক্ষেপ ফেলে দিলাম বিরক্তির দ্রবণে]
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে অক্টোবর, ২০০৮ রাত ৩:২৭