[ন্যাট জিওতে কোন ডকুমেন্টারি দেখলেই সেটা নিয়ে বকবক করে সবাইকে বিরক্ত করতে ইচ্ছা করে,সেজন্যই এই লেখা]
মেশিনগানের ধারণাটা কার প্রথম মাথায় এসেছিল,সেটা ভাবতে গেলে চীনাদেরই কৃতিত্বটা দিতে হয়। অবশ্য,সেটায় গুলির বদলে ছিল তীর,সময়টা ১০০০ বছর আগে। একটা আয়তাকার বাক্সের মুখে ৩২ টা তীর রেখে সেগুলোকে একটা লিভারের মাধ্যমে টানা এবং ছেড়ে দেয়া,একসাথে অনেকগুলো ফায়ার করার প্রথম ধারণা।
এরপর সময় গড়িয়েছে,মানুষ মারার আরো হাজারো পদ্ধতি চলে এসেছে,এসেছে আগ্নেয়াস্ত্র,বুলেট।আর সিঙ্গেল ফায়ার বন্দুকের সাথেই এসেছে একইসাথে অনেক বুলেট ছোঁড়ার ধারণা। ধারণাটা প্রথম কাজে লাগান গ্যাটলিং,১৯ শতকের শেষদিকে,৮ নলা গ্যাটলিং গানের মাধ্যমে, যেটার ৮টা নল ঘুরে ঘুরে ফায়ার করতো আর সেটাকে ঘোরাত একটা বিদ্যুৎচালিত মোটর। কিন্তু জিনিসটা ছিল মহা জটিল আর ওজনও তেমনি। গ্যাটলিং গানের পথ ধরেই এরপর যুদ্ধক্ষেত্রে আসে হেভি মেশিন গান। কিন্তু সবকয়টা মেশিনগানেরই অভিন্ন সমস্যা ছিল তার ওজন,একেকটা ৪০-৫০ কেজির মেশিন গান আর যাই হোক বহনযোগ্য কিছু না,কাজেই এক জায়গায় রেখেই গোলাগুলি চালাতে হয়।
তো,এই ভারি মেশিন গানের সাথে একজন মানুষই বহন করতে পারে এমন একটা অটোমেটিক ফায়ার আর্মসের দরকার হয়ে পড়লো প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়। দেখা গেল,মুখোমুখি যুদ্ধে,বিশেষত ট্রেন্ঞ্চ ওয়ারফেয়ারে,যুদ্ধটা হয় বেশ ক্লোজ রেন্ঞ্জে,২০০ থেকে ৩০০ মিটারের মাঝে,আর সেখানে জার্মানদের কাছে মিত্রবাহিনী ক্রমাগতই নাকাল হয়ে যাচ্ছে। কাজেই তাড়া এল,কার্যকরী,হালকা,নতুন কোন অস্ত্র চাই। আর সেই তাড়াতেই, জেনারেল থমসন আবিষ্কার করলেন ইতিহাসের
সবচেয়ে বিখ্যাত অস্ত্রগুলোর একটা,থমসন সাবমেশিন গান,যার আরেক নাম--"টমি গান"। টমি গানই প্রথম সাব-মেশিন গান ধারণাটার প্রচলন করে। হালকা,ছোট,অটোমেটিক ফায়ার,মিনিটে ফায়ার করতে পারে ৯০০ রাউন্ড,ট্রিগার টেনে ধরে রাখলেই মুহূর্তেই খালি করে ফেলে তার ৩০ রাউন্ডের ড্রাম ম্যাগজিন,যেখানে বুলেট হিসাবে থাকে নরম পিস্তল কার্তুজ। তবে,যে যুদ্ধের জন্য টমি গানের উৎপত্তি,সেখানে সরবরাহ করার আগেই প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়ে যায়,ফলে যুদ্ধক্ষেত্রে এর ব্যবহার দেখার আর সুযোগ হলো না কারো।
কিন্তু টমি গানের গল্প মাত্রই শুরু হলো। সেনাবাহিনী নয়,অস্ত্রটাকে বিখ্যাত করে তুললো গ্যাংস্টাররা,রক্তাক্ত এক ইতিহাসের সূচনা হল এর হাত ধরে। পেশাদার খুনী আর গ্যাংস্টাররা গ্যাংওয়ারের জন্য এমন একটা অস্ত্র পেয়ে যারপরনাই খুশ হলো,টমি গানের পাল্লায় পড়ে লক্ষ্যবস্তু তো বটেই,আশপাশে থাকা দু'চারজনও নিয়মিতই পরপারের টিকেট পেয়ে যেত। শিকাগোর গুণ্ডাসর্দার আল-কাপোনের প্রিয় অস্ত্র ছিল এই টমি গান,মারতে আর মরতে,তুলনাহীন,শিকাগোর গুণ্ডাদের মাঝে এর আরেক নাম ছিল শিকাগো পিয়ানো। অপরাধের ইতিহাসে টমিগানের প্রথম লক্ষ্য অবশ্য ব্যর্থ হয়েছিল,খুনী ম্যাকিনলী তার এক প্রতিপক্ষ বুটলেগার,মানে জালিয়াতকে মারার জন্য টমিগানের পুরো ম্যাগজিনটাই খালি করেছিল, কিন্তু সে ব্যাটার বরাত বলতে হবে,মাটিতে শুয়ে পড়ে সে আর প্রতিটা গুলিই অলৌকিকভাবে তার আশপাশে নয়তো উপর দিয়ে চলে যায়। বেঁচে থাকার কৃতজ্ঞতাতেই হয়তো,সে জালিয়াত তওবা করে অপরাধের জগৎ থেকে সরে যায়,টমিগান জিনিসটা মনে হয় ঐ একবারই ভাল কোন কাজ করেছিল।
টমি গানের সবচেয়ে বড় সমস্যাটাই ছিল এখানে,কম গতির পিস্তল বুলেট আর প্রচণ্ড ঝাঁকির কারণে এর গুলি প্রায়ই লক্ষ্যভেদ করতে পারতো না,অহেতুক গুলি খরচও হতো। সমাধানের জন্য থমসন টমি গানের নলের মুখে যোগ করলেন অনেকটা সাইলেন্সারের মতই ভারি একটা নল, একে বলে কম্পেনসেটর,যেটা গুলি করার সময় নলটাকে নিচের দিকে রাখতে সাহায্য করে,আর যোগ করে দিলেন সেমি-অটোমেটিক করার ব্যবস্থা,যাতে ইচ্ছা করলে একটা একটা করেও গুলি করা যায়। কিন্তু তারপরেও পাল্লাটা একটু কমই হয়ে গেল,মনে রাখা দরকার যে অস্ত্রটা আসলে সেনাবাহিনীর জন্য উদ্ভাবন করা হয়েছিল,টার্গেট একটু দূরে হলেই টমিগান দিয়ে লক্ষ্যভেদ করা ভাগ্যের ব্যাপার ছিল। সৈন্যদের দরকার ছিল কিছুটা দূরের টার্গেটেও অনবরত ফায়ার করা নিখুঁতভাবে, কাজেই এর ডিজাইনে পরিবর্তন করা হল বেশ কিছুটা। সাথে বদলে দেয়া হল বুলেট,কমপাল্লার পিস্তল বুলেটের বদলে ব্যবহার করা হল ৭.৬২ মিমি রাইফেল বুলেট,গোলাকার ড্রাম ম্যাগজিনের জায়গায় ব্যবহার করা হলো চ্যাপ্টা ম্যাগজিন,জন্ম নিল আধুনিক অ্যাসল্ট রাইফেলের প্রথম নমুনা--"এম-১৪।"
এম-১৪ দূরপাল্লায় কাজ ভালই করতো,কিন্তু তারপরেও আমেরিকানরা সেটা নিয়ে ঠিক সন্তুষ্ট হতে পারছিল না। ততদিনে রাশানরা হাতে পেয়ে গেছে মিখাইল কালাশনিকভের সেই কিংবদন্তীর "একে-৪৭", হালকা, দূরপাল্লাতেও কার্যকরী এক কিলিং মেশিন,সে তুলনায় এম-১৪ এর লক্ষ্যভেদের ক্ষমতা কমই বলতে হবে,৩০০ মিটারের বেশি দূরত্বে খুব ভালো স্নাইপারের পক্ষেও এই জিনিস দিয়ে টার্গেটে লাগানো ছিল প্রায় অসম্ভব। ইউএস আর্মির এক প্রতিভাবান অস্ত্রবিশারদ,ইউজিন স্টোনার বের করলেন সমস্যাটা কোথায়। এম-১৪ এর বাঁট বা স্টকটা নিচের দিকে বাঁকানো,ব্যারেলের সাথে একই রেখায় নয়। ফলে যখন ফায়ার করা হয়,ব্যারেল আর বাঁটের সংযোগস্থলটা কাজ করে একটা পিন সাপোর্ট হিসেবে,অনেকটা দরজার কব্জার মত,ফায়ারিংয়ের ঝাঁকুনিতে মাঝের এই
জায়গাটাকে কেন্দ্র করে নলটা ঘুরে যায় সামান্য উপরের দিকে,ফলে জায়গামত গুলি লাগানো হয়ে পড়ে কঠিন। সমাধান হিসেবে,স্টোনার ডিজাইনটা বদল করে,বাঁট টা করে দিলেন একদম সোজা,নলের সাথে একই রেখায়,ফলে ফায়ারিংয়ের যে ধাক্কা বা রিকয়েল,সেটাও নেয়া গেল আরো ভালভাবে,যোগ করা হল একটা রিকয়েল স্প্রিংও। দেখা গেল,৪৫০ মিটার দূরেও টানা অটোমেটিক ফায়ারিংয়েও বেশ নিখুঁতভাবে গুলি লাগানো যাচ্ছে। ব্যবহার করা হল হালকা অ্যালুমিনিয়াম স্টক আর স্টিল,তবে সবচেয়ে বড় পরিবর্তন আনা হল বুলেটে,৭.৬২ মিমি ভারি বুলেটের বদলে স্টোনার ব্যবহার করলেন ৫.৫৬ মিমি স্লিম বুলেট,যার গতি এবং লক্ষ্যভেদ ক্ষমতা,দু'টোই অনেকটা বেশি। সব মিলে যে জিনিসটা দাঁড়ালো,সেটাই মানুষ খুনের এ যাবৎকালেরই সবচেয়ে ভয়ংকর বন্দুক--"এম-১৬"। প্রথম এটা কাজে লাগানো হয় ভিয়েতনাম যুদ্ধে,আর্দ্র আবহাওয়ায় ভাল কাজ করে না বলে এর সাথে দেয়া হত বিশেষ ক্লিনিং কিট। মানুষের দেহে এই বুলেট টা ঢোকার পর বুলেটের উপরের অংশটার গতি যায় কমে,আর নিচের অংশটা এগিয়ে যেতে চায়,পরিস্থিতি দাঁড়ায় অনেকটা হোঁচট খাওয়ার মত,ফলে বুলেটটা
টুকরো হয়ে সবদিকে ছড়িয়ে শরীরের চারপাশের অনেকগুলো 'ভাইটাল অর্গান' ছিন্নভিন্ন করে দেয়। বলা হয়,আজ পর্যন্ত কোন মানুষ এম-১৬ এর বুলেট খাওয়ার পরে সোজা হয়ে চলতে পারেনি,এমনই ভয়ংকর এর কাজ।
এতক্ষণ যে মেশিন গান গুলোর কথা বলা হলো,সেগুলোর সবগুলোর চাইতে বেশি ক্ষমতাসম্পন্ন একটার কথা দিয়েই শেষ করা যাক। এটাও একজনই চালায়,তবে,ফাইটার জেটে চড়ে। বলা হচ্ছে আমেরিকান এ-১০ ফাইটার জেটের সাথে যুক্ত কুখ্যাত মেশিন গান,"গাও-এইট অ্যাভেন্ঞ্জার" এর কথা। গ্যাটলিং গানের মতই এরও ৮টা নল,বসানো হয় ফাইটার জেটের নাকে,বসানোর পর জেটের কাঠামোটাকে বসানো হয় একে কেন্দ্র করে। ওজন ১৮৩০ কেজি,বুলেট হিসেবে ব্যবহার করা হয় ডিপ্লেটেড ইউরেনিয়াম ৩০ মিমি বুলেট,২৯ সেমি লম্বা বুলেটগুলো অনায়াসে ভেদ করে যেতে পারে ট্যাংকের দেয়ালও। মিনিটে ৪২০০ রাউন্ড বুলেট ছোঁড়া যায়,লক্ষ্যভেদেও নিখুঁত,৪০০০ ফিট উপর থেকেও ৪০ ফিটের একটা বৃত্তের মাঝে আঘাত করতে সক্ষম প্রায় সবগুলো বুলেট। ১-২ সেকেন্ড করে ফায়ার করা হয়,তাতেই ১৫০ রাউন্ডের মত গুলি ছুটে যায়। মূলত গ্রাউন্ড অ্যাটাককে সমর্থন দেয়ার জন্যই এ-১০ ফাইটার জেট কাজ করে, ১১৭৪ রাউন্ড বহনকারী গাউ-৮ এর চেয়ে ভাল কোন অস্ত্র আর কি-ই বা হতে পারে তার জন্য?
লেখাটার শেষদিকে এসে উপসংহারে তেমন ভাল কিছু বলার খুঁজে পেলাম না,পাওয়ার কথাও না,কারণ আলোচনাটা হচ্ছিল মানুষ খুন আর ধ্বংসের কাণ্ডারিদের নিয়ে। শুধু মনে হচ্ছে,মানুষকে ধ্বংস করার জন্য হাজার হাজার বছর ধরে যত মেধা আর পরিশ্রম গেছে,তার ১০০ ভাগের ১ ভাগও যদি মানুষকে বাঁচাবার জন্য করা হলে পৃথিবীটা ঠিক কি অবস্থায় থাকতো? মনে হয়,আমাদের জীবদ্দশায় সেই উত্তরটা জেনে যাবার সৌভাগ্য কারো হবেনা।
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে সেপ্টেম্বর, ২০০৯ রাত ৮:০৭