এক
নাজনীনের আজকে অস্থির লাগছে। তার ছেলের এক বছর পূর্ণ হলো আর এক যুগ পূর্ণ হলো তার মার্কিন মুলুকে আসবার। সজীবকে বিয়ে করেছে সাড়ে তিন বছর হলো। নিউ ইয়র্কের যে জায়গাটায় তারা থাকে তার আশেপাশে অনেক বাঙালীর বাস। তবে নাজনীন'রা বন্ধু বাছাইয়ে সতর্ক তাই অনেক বেশি বন্ধু নেই তাদের। ওরা আজ ঠিক করেছে সপ্তাহের এই দিনটিতে আর বাসায় যেয়ে কষ্ট করে রান্না করবেনা, কাছের একটা বাংলাদেশি রেস্টুরেন্টে সবাই মিলে হৈ চৈ করে খেয়ে নেবে।
সজীবের অফিস থেকে টুইন টাওয়ার অনেক দূরে। টুইন টাওয়ার যখন ধ্বসে পড়ে তার কিছুক্ষণ আগে সজীব নাজনীনের সাথে ফোনে রেস্টুরেন্ট বাছাই করছিল ছেলের জন্মদিনের উৎসব করার জন্য।
নাজনীন আর ফিরে আসেনি। নাইন-ইলেভেনে আর হৈ চৈ করে কোনদিন ছেলের জন্মোৎসবও পালন করেনি সজীব।
দুই
আঁখি আজ অনেক সেজেছে। তার ছোট বোনকে দেখতে সাউথ শিল্ড থেকে ছেলের পরিবার আসবে। লন্ডনের আকাশে তাই বোধহয় আজ আর মেঘ জমেনি। ঠান্ডাও পড়েছে তুলনামূলকভাবে অনেক কম। মাগরিবের পর ছেলেরা আসবে। আঁখির বাবা কাছের সেন্ট্রাল মসজিদে নামাজ পড়তে গিয়েছেন। তার মনটা খারাপ। লন্ডন শহরে সাম্প্রদায়িকতার ঘনঘটা। তিনি ৪০ বছর ধরে এখানে আছেন কখনও এমনটি দেখেননি।
আঁখি চিন্তিত। ছেলেরা চলে এসেছে। মাগরিব পেরিয়ে এশার সময় হলো বাবা ফিরছেন না।
রাত ১০টা। থেমস হসপিটালের করিডোরে কান্নার রোল। কিছু ব্রিটিশ উচ্ছৃঙ্খল ছেলের হাতে আঁখির বাবা খুব হয়েছেন দাঁড়ি থাকবার অপরাধে।
তিন
লুসি'র মন খারাপ। তার বয়ফ্রেন্ড তার সাথে চিট করেছে। সেটা সে ধরতে পারিনি। ঘটনা নাকি অনেক দিন ধরেই চলছিল। জর্জের এপার্টমেন্টের সুপারভাইজার বুড়ি আকারে ইঙ্গিতে তাকে অনেক দিন ধরে বলবার চেষ্টা করলেও লুসি পাত্তা দেয়নি। তাদের সম্পর্ক ছ'বছর। সুইস একটা মেয়ের জন্য ৬ বছরের সম্পর্ক অনেকদিনের। এই সামারের ছুটিতেই তাদের বিয়ে করবার কথা। গতকাল এনিভার্সারির ফুল নিয়ে জর্জের ফ্ল্যাটের ভেতর ঢুকে লুসি যা দেখে তাতে তার আর বাঁচতে ইচ্ছা করেনা। মরফিনের ডোজগুলো পেয়েছে সে তার বান্ধবীর ডেন্টাল চেম্বারে। চুরি করে নিয়ে এসেছে।
মরফিনের ওভারডোজে মৃত লুসির লাশ জেনেভা পুলিশ উদ্ধার করে সাতদিন পরে তার ফ্ল্যাট থেকে।
চার
ক্রিসের মন খারাপ। তার বাবা-মা'র বিচ্ছেদ হয়ে গেছে। ইউনিভার্সিটিতে তার ফল খুব খারাপ হয়েছে। টিউসন ফি'র টাকা জোগাড় করতে পারেনি। তার কোন বন্ধু নেই। সবাই তাকে লুজার বলে। টরেন্টো থেকে কিউবেক যাবার রাস্তায় ১৯০ কিমি বেগে গাড়ি চালায় ক্রিস, কিছুক্ষণ পর পর মুখে ভরতে থাকে বিয়ারের সাত নাম্বার বোতলটা।
ক্রিসের লাশ পাওয়া যায় যে টুয়েন্টি ফোর হুইলারের চাকার নীচে তার সেডান ঢুকে গিয়েছিল নেশার ঘোরে তার নানা অংশে ছিন্নভিন্ন অবস্থায়।
পাঁচ
লাইবেরিয়ার মারগিবি শহরে থাকে ফ্রান্সিস। এখানেই জন্ম তার। পুরনো গাড়ি সারাবার একটা ওয়ার্কশপ চালাত সে। গতকাল তার পরিবারের শেষ সদস্য বুড়ি দাদি মারা গেছে এবোলায়। গত সপ্তাহে তার বান্ধবী, আগের সপ্তাহে বাবা-মা, বোন, বোনের জামাই, পাড়া প্রতিবেশি আর কে কে যে মারা গেছে এবোলা'র মরণ ছোবলে আর মনে নেই এখন ফ্রান্সিসের।
তাই আজ সে তার প্রিয় শহর মারগিবি ছেড়ে পাশের দেশে পাড়ি জমাচ্ছে।
ছয়
নাজনীন থাকে পিরোজপুরে। নার্সিং কলেজে পড়ে। তার মনটা খারাপ। এলাকার বখাটে ছেলেরা খুব জ্বালাচ্ছে। নাজনীনের ছেলে-বন্ধু ঢাকায় একটা ফার্মে চাকরি করে। কবে যে তাকে বিয়ে করে নিয়ে যাবে জানে না নাজনীন। এদিকে এই ছেলেগুলা খুব জ্বালাচ্ছে। গতকাল ওড়না ধরে টান দিয়েছে, অশ্লীষ কথাও বলেছে, তুলে নিয়ে যাবার হুমকিও দিয়েছে। সজীব এমনিতেও জীবন-জীবিকা নিয়ে অনেক টেনশনে থাকে, তাকে আর কিছু বলেনি নাজনীন।
নাজনীনের ধর্ষিত মৃতদেহ পরের দিন ভোরে পাশের একটা ডোবায় ভেসে ওঠে।
সাত
আঁখি গার্মেন্টসে কাজ করে ছ'মাস। তার ভালই লাগে। সম্মান আছে, নিজের পায়ে দাঁড়ানো গেছে। এবার ঈদে বাড়ি যাবে। নিজের টাকায় জামা-কাপড় কিনবে সে। গাজীপরের এই গার্মেন্টসে সুযোগ সুবিধাও কম না। ভালই আছে আঁখি।
আরও ১১৯ জন শ্রমিকের সাথে আঁখির পোড়া মৃতদেহ পরের দিন ভোরে উদ্ধার করে গাজীপুর পুলিশ তার প্রিয় গার্মেন্টস কারখানা থেকে।
আট
লুসির কি হয়েছিল কেউ জানে না। তীব্র পেটে ব্যথা নিয়ে সে যখন গুলশানের একটি অভিজাত হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল তখনও ডাক্তাররা বলেছিলেন তেমন কিছু না। তার তিন দিনের মাথায় লুসি জ্ঞান হারায়, ছ'দিনের মাথায় কোমায় আর তের দিনের দিন মারা যায়। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ লুসি'র স্বামীকে ১৯ লক্ষ টাকার বিল ধরিয়ে লাশ আটকে রাখে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত মর্গে।
নয়
আকলিমা খাতুন থাকে কারওয়ান বাজারের বস্তিতে। তার দিন কাটে তিন বাসায় ছুটা বুয়ার কাজ করে। একেক বাসা থেকে পায় ২২০০ টাকা করে। জামাই রিকশা চালায়। তার রোজগার মাসে ১৪০০০ টাকা। দুইজন মিলে ২০০০০ টাকার ওপর। ছেলেটা এস।এস।সি'তে জিপিএ ফাইভ পেয়েছে। প্রতিদিন সকালে রেললাইনের ধারে সবজি বিক্রি করে। আর ছোট মেয়েটার বয়স পাঁচ বছর, থাকে ভাইয়ের সাথেই।
বিকেলে ঘরে ফিরে আকলিমা খাতুন দুই সন্তানের সাত টুকরা লাশ বুঝে পান রেলের ডোমের কাছ থেকে।
দশ
হরিহরণ বড়াই সিলেটের চা-বাগানে কাজ করে। প্রতিদিন রাতে বাংলা মদ খেয়ে হেড়ে গলায় গান গাইতে গাইতে ঘরে ফেরে সে। মাঝে মাঝে বেদম পেটায় পরিবার পরিজনদের; যেদিন তার মেজাজের ঠিক থাকে না। আজকে যখন সে ঘরে ফেরে, ঘরে চলছে শোকের মাতম। পুরো চা-বাগানের শ্রমিকরা যেন ঢুকে পড়েছে তার দমবন্ধ করা ছোট্ট বাড়িটায়।
হরিহরণের তিন বছরের ছেলেটা ডায়রিয়ায় মারা গেছে পাশের ছড়ার পানি খেয়ে। কোটিপতি চা বাগানের মালিকেরা শ্রমিকদের জন্য সামান্য টিউবওয়েলের ব্যবস্থাও করেন নি।
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
যখন দিব্যি বেঁচে থাকার কথা তখন বিদেশের মাটিতে নাজনীন, আঁখি, লুসি, ক্রিস এবং ফ্রান্সিসের মৃত্যুর জন্য হতাশা, সন্ত্রাস, মৌলবাদ, নেশা, ভয়াবহ রোগব্যাধি লাগে।
আমাদের অত ঝুট-ঝামেলা নেই। আমাদের নাজনীন, আঁখি, লুসি, আকলিমা এবং হরিহরণ বড়াইয়ের মেয়ে শিশুর মৃত্যু হয় অতি স্বাভাবিক কারণে - ধর্ষণ, গার্মেন্টস কারখানায় আগুন, হাসপাতালের ভুল চিকিৎসা কিংবা ব্যবস্থাপনা, রেলগাড়ির নীচে চাপা পড়া এবং ডায়ারিয়ার মতো অতি সহজ একটি রোগে।
তবুও প্রতি সপ্তাহান্তে আমরা আরেকটা সপ্তাহ শুরু করি। প্রতিটি দিনের শেষে আরেকটা ভোরের অপেক্ষায় সবাইকে বলি,
"শুভ রাত্রি"
শামীম আহমেদ
১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৪
নিকেতন, ঢাকা।
একফোঁটা বৃষ্টি হতে যদি অদ্ভুত ইঙ্গিত আসে ঈশ্বর থেকে #ShamimAhmedJitu2014