গত এক সপ্তাহ বলতে গেলে স্বপ্নের মত গেল। মধ্যবিত্ত বাঙ্গালীর জীবনে চমক কম। বছরে দু'বার ঈদের অপেক্ষায় কাটে দু'মাস। সে ঈদ চোখের পলকে আসে আর পলক ফেলতে না ফেলতেই আবার চলে যায়। মধ্যবিত্ত বাঙালীর ঈদের আগের ক'দিন, ঈদের দিন আর পরের ক'দিন আনন্দের আতিশয্যে কেটে যায়। তারপর হঠাৎ এক সন্ধ্যায় টের পায় ঈদের ছুটি শেষ, আগামীকাল আবার অফিস, আবার জীবনের ঘানি টানার কাব্য!
ঈদের আগে আগে যারা উদ্বাস্তু বাঙালী অর্থাৎ যারা ঈদ করে ঢাকায়, তারা খুশিতে আটখানা হয়ে যায়। শহরের অধিকাংশ মানুষ বাড়ি, গাড়ি, দরজায় তালা ঝুলিয়ে গ্রামের পথ ধরে। গ্রামের সবুজ, কাঁদা, পুকুরের মাছ, দোকানের মিছরি, পাখির ডাক, ঝি ঝি পোকার শরীর ঠিকরে বেরুনো আলোয় তাদের ঈদ কাটে ঈদের মতো।
আর যেসব মানুষ উদ্বাস্তু, যারা ঈদে আর গ্রামে যায় না; যাদের আর গ্রামে যাবার পথ নেই; তারা ঢাকা শহর পাহারা দেয় এই একসপ্তাহ। তাদের নিজেদের স্বান্তনা দেবার জায়গা তৈরি করতে হয় – তারা বলে আহ! আমাদের ঢাকা এমন থাকলেই তো ভাল; যারা গ্রামে গেছে তারা গ্রামেই থাকুক – আর ফিরবার দরকার নেই! আমরা গাড়ি নিয়ে, বাড়ি নিয়ে, রিকশায় চড়ে, পায়ে হেঁটে ঢাকার রাস্তায় জারুল গাছ দেখি। চড়ুই পাখি দেখি। ট্রাফিক পুলিশ দেখি। আমাদের বেশ লাগে।
আমরা ঢাকার উদ্বাস্তু মানুষ সব – নিজেদের যাযাবর পরিচয়ে অস্থির হয়ে ঢাকার দখল নিতে চাই সেসব মানুষের কাছে যাদের কাছে ঢাকাও আছে, যাদের কাছে গ্রামও আছে। যারা কংক্রিটের পথ মাড়িয়ে সবুজ ঘাসের ডগায় শিশিরের স্পর্শ নিতে পারে; যারা ভোরের আলো ফোটবার আগে পুকুরের পানিতে গোড়ালি ডুবিয়ে মাটির সোঁদা গন্ধে জীবনের স্বাদ নিতে পারে।
ঢাকা যখন ফাঁকা হয়ে যায় একসপ্তাহের জন্য তখন আমারও বেশ লাগে, তবে তখন এই শহরের নাম আর ঢাকা থাকে না। এই শহর তখন অন্য কোন শহর হয়ে যায়। সে শহরে আমিও নিজের অজান্তে নিজেকে খুঁজে ফিরি, বহু আগেই নিজের হারিয়ে যাওয়া পরিচয়টাকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকবার চেষ্টা করি।
এই নিরালায় একা একা আমি আমার ঢাকা শহরটাকে খুঁজে বেড়াই। যে রিকশাওয়ালা আমাকে নিকেতন থেকে গুলশান ১ এর ডিসিসি মার্কেটে নিয়ে যায় ২০টাকায় – কিন্তু ৩০টাকা পেয়ে তার মুখে ঘাম মুছিয়ে হাসির আলাপন শুনি নিভৃতে; যে ছেলেটি আমার পাশের গাড়িতে আমার মতই সন্ধ্যাবেলা ১০ মিনিটের পথ দু’ঘন্টায়ও পাড়ি দিতে না পেরে হতাশ বসে থাকে; যে মেয়েটি অফিস শেষে ক্লান্ত হয়ে সিএনজি না পেয়ে দাঁড়িয়ে থাকে লক্ষ্মী হয়ে – যার সাথে চোখের পাতায় অজানা কথা হয়ে যায় কোন কথা না বলেই – আমি সারা সপ্তাহ তাদের অপেক্ষাতে থাকি।
এই ঢাকা শহর কখনও আমার; আমার নিজের শহর মনে হয় না ওই রিকশাওয়ালা চাচা, ওই গাড়ি চালানো ছেলেটি কিংবা ওই যে মায়া মায়া মেয়েটিকে ছাড়া। ওদের সবাইকে নিয়েই তো আমার ঢাকা। ওরা যখন ফিরে আসে এই মৃতপ্রায় শহরের অলিতে-গলিতে-ধুলিতে; আমার নিজেকে কম উদ্বাস্তু মনে হয়; কম কম যাযাবর মনে হয়।
ঢাকা শহর ছেড়ে যাওয়া সেইসব; সব সব ভাগ্যবান মানুষকে আবার ঢাকায় স্বাগত জানাই। ঢাকা আবার বিষময় হবে আমাদের সবার পদচারণায়; কিন্তু মানুষ হিসেবে তাদের ছাড়া আমাদের এই ঢাকায় আমরা বাঁচব কি করে?
স্বাগতম ঢাকাবাসী; সুস্বাগতম বন্ধুগণ। তোমাদের পদচারণায় ঢাকা হোক ঢাকা! বন্ধু দিবসের শুভেচ্ছা তোমাদের সবাইকে।
শামীম আহমেদ
৩ আগস্ট ২০১৪
নিকেতন, ঢাকা।