১
‘পরিচ্ছন্ন গল্প এখন পাবলিক খায় না’ এই বোধ থেকে অত্যন্ত ভারাক্রান্ত মন আর কিছুটা অপরাধবোধ নিয়ে খানিকটা ইতস্তত কলমে একটা গল্পের প্রথম লাইনের শেষে গল্পকার লিখে ফেললেন একটি শব্দ; ‘যৌনতা’।
কিছু কিছু পাঠকের চোখ নিশ্চয়ই বড়ো বড়ো হয়ে গেছে। কেউ কেউ হয়তো খানিকটা উষ্ণতা অনুভব করতে শুরু করেছেন এরই মধ্যেই। কী ঘটতে চলেছে গল্পে এরপর - এই ভাবনায় আক্রান্ত হলেন কেউ কেউ। উৎসুক পাঠক কামুকে পরিণত হলেন। ইন্দ্রিয় সাড়া দিতে শুরু করেছে কারো কারো। সেরেটোনিন নাকি অন্য কিছুর প্রভাব? কে জানে। তবু গল্পটা টানছে পাঠকের মন। যার মূল কারণ একটি শব্দ। এই শব্দটিই বুঝিয়ে দিচ্ছে কি নিয়ে গল্প। আগ্রহী পাঠক তাই নড়ে চড়ে বসছেন। তাকিয়ে দেখে নিচ্ছেন যে কেউ তাকে লক্ষ্য করছে কি না। যেহেতু শব্দটা গোপনীয়তা দাবী করে।
নিশ্চয়ই কোন রসালো গল্প বলতে যাচ্ছেন গল্পকার। এক্সাইটমেন্ট। রোমান্স। থ্রিল। সাসপেন্স। রিলিজ। রিল্যাক্স। উহ, ভাবতেই গা শিরশির করে উঠলো বিছানায় বসে থাকা লম্বাচুল বলিষ্ঠ এক পাঠকের। মুখে খোচাখোচা দাঁড়ি, চোয়ালের রুক্ষতা আর কপালের ভাঁজ দেখলে সহজেই বোঝা যায় জীবনের অভিজ্ঞতার ঝুলিটা কানায় কানায় পূর্ণ তার। চশমার ভেতর দিয়ে তাকিয়ে আছেন ল্যাপটপ-স্ক্রিনে। পরনে আকাশী রঙের নাইটড্রেস। ঘরে জ্বলছে, অনিচ্ছায় আলোকিত হতে বাধ্য হওয়া, হাঁসের ডিমের মতো একটা ডিম-লাইট। সেটাও আকাশী রঙের আলো ছড়াচ্ছে। ঘরের তিনদিকে সাদা দীর্ঘ পর্দায় ঈষৎ প্রতিফলিত হচ্ছে সে আলো।
আজ নিয়ে পরপর দু’রাত একাকী কাটছে লোকটার। ঢাকায় স্ত্রীকে ছেড়ে তিনি ব্যবসার কাজে এসেছেন চট্টগ্রাম। থাকতে হবে সপ্তাখানেক। উঠেছেন বেশ নামীদামী একটা হোটেলে। কিন্তু আগে রিজার্ভ করা ছিলো না বিধায় ম্যানেজার আজ রাতে কাউকে সাপ্লাই দিতে পারেনি। তবে আশ্বাস দিয়েছে আগামীকাল রাতে বেশ ভালো একটা ‘মাল’ পাওয়া যাবে। তবে একচুয়াল রেটের চেয়ে কিছু ‘একস্ট্রা’ দিতে হবে। তা হোক। ভালো মাল পেলে এক্সট্রা দিতে আপত্তি নেই তার। কিন্তু সেতো আগামীকালকের কথা, আজ রাতের কি হবে? তাই কিছুটা উষ্ণতার লোভে ল্যাপটপটা অন করে ঢুকলেন অন্তর্জালে। ব্রাউজারের সার্চবারে গিয়ে লিখলেন তার সবচেয়ে প্রিয় শব্দটি, যেটা লেখা আছে গল্পের প্রথম লাইনের শেষ শব্দে।
২
মধ্যবয়সী একজন পাঠক ভাবলেন, একটা হট ফিগারের ছবি সংযুক্ত থাকলে আরো আকর্ষণীয় হতো গল্পটা। না হলে গল্প পড়ে লাভটা কি? একটা গল্পই তো পড়তে চায় পাঠক। আর তো কিছু না। কিন্তু সে গল্পে যদি মনকে তৃপ্ত করার উপাদানই না থাকলো তা হলে সেসব ‘রাবিশ’ পড়ে শুধুশুধু সময়ের অপচয় করে কি হবে? আপনি নিশ্চয় কারো নিঃসঙ্গতার আদ্যোপান্ত জানতে গল্প পড়বেন না। অন্য মানুষের কষ্টের কথা জেনে লাভ কি আপনার? অতো সময় কই?
আনপ্রোডাকটিভ কোনো কিছুর পক্ষপাতি নয় মধ্যবয়সী লোকটি। একবার ভাবলো বইটা বন্ধ করে কালকের কেসের ফাইলটা নিয়ে বসা যাক। তাতেও দুপয়সা পাওয়া যাবে। আজকাল মক্কেলের যা অভাব। ‘কোর্টে কেস করে কোনো লাভ হয় না’- এ বিশ্বাসটা মানুষের মনে দিনদিন এতোই বদ্ধমূল হয়ে যাচ্ছে যে কোর্ট-কাচারিতে আর আস্থা নেই কারো। সবাই সবকিছু এখন আপোষে মিটিয়ে নিতে চায়। অথবা ব্যক্তিগতভাবে প্রতিশোধ নেবার ব্যবস্থা করে। কিন্তু তবুও এই মধ্যবয়সী বন্ধ করলেন না বইয়ের পৃষ্ঠা। বরং বইটা আরো কিছুটা কাছে এনে লকলকে চোখ নিয়ে তাকিয়ে থাকলেন প্রথম লাইনের শেষ শব্দটার দিকে।
কিছু হয়তো পাওয়া যাবে লেখাটায়। শব্দটা সেটাই জানান দিচ্ছে। টানছে। গালের চামড়া টানটান হয়ে যাচ্ছে তার। একটা রোমাঞ্চকর ঘটনা হয়তো এখনি শুরু হতে যাচ্ছে। শব্দটার একটা অদ্ভুত আবেদন আছে।
৩
মেয়েটা পড়ছিল খবরের কাগজ। বরাবরই তার ভালো লাগে বিনোদন পাতা। আজ শুক্রবার বিধায় সাথে ছাপা হয়েছে ‘সাহিত্যপাতা’। সাহিত্যপাতার সাথে শুক্রবারের কি সম্পর্ক, কে জানে! নইলে কেন সাহিত্যপাতা শুক্রবারেই ছাপা হতে হবে? মানুষের ঐদিন অবসর বলে। সাহিত্য কি শুধুই অবসরের জিনিস? হবে হয়তো।
যাহোক, মেয়েটা তার প্লাক করা ভ্রু আর কাজল টানা চোখের সামনে মেলে ধরলো সাহিত্যপাতাটি। এবং যথারীতি প্রথম লাইনের শেষ শব্দে আঁটকে গেল তার চোখ। পাশে তাকিয়ে দেখে নিলো কেউ আছে কি না।
না, বাবা বাসায় নেই। বাবা বেরিয়ে গেছেন জুম্মার নামাজ পড়তে। মা এখন রান্নাঘরে ব্যস্ত। বুয়াকে এটা সেটা বোঝাচ্ছেন। আজ জুবায়ের ওর বাবাকে নিয়ে আমাদের বাসায় আসবে। অনেকদিন ধরেই ঝুলে আছে ব্যাপারটা আজ ফাইনাল হবে হয়তো। ডেট ফিক্সড হবে। ফিক্সড হবে কার্ড, শাড়ি, গহনা, ডেকোরেশন, সাউন্ড সিস্টেম এমনকি কমিউনিটি সেন্টারও। জুবায়ের ডাক্তার। মা-বাবার বিন্দুমাত্র আপত্তি নেই এবার। বরং তারা ভীষণ খুশি। খুশি আমার সকল আত্মীয়-স্বজন আর বন্ধুবান্ধবও।
আগেরবার যখন এক লেখকের প্রেমে পড়েছিলাম, উফ, সে সময়ের কথা ভাবলেও দম বন্ধ হয়ে যায়। সারাদিন মায়ের ঘ্যানঘ্যানানি। কি আছে ওই ছেলের? করে তো পত্রিকার ছোট্ট একটা চাকরি। কয়টা টাকা বেতন পায়? আমাদের সাথে কি যায়? ঢাকায় বাড়ি আছে? গাড়ি? ব্যাংক-ব্যালেন্স কতো? ওর বাবা কি করে? ভাই-বোনেরা? আত্বীয়-স্বজনের কে কে বিদেশ থাকে? উফ, কান একেবারে ঝালাপালা হয়ে গিয়েছিল তখন। সব প্রশ্নেরই হতাশাজনক উত্তর শুনে বাবা-মা আমাকে টানা দুইদিন অনেক কিছু বোঝালেন।
না বোঝার মতো মেয়ে আমি নই। অবশেষে বুঝলাম। ভেবে দেখলাম, তাই তো, কিছুই তো মেলেনা। এ ছেলে তো আমার বিন্দুমাত্র যোগ্য নয়। আমার ভালোলাগে নিত্য নতুন রেস্টুরেন্ট, গেট-টুগেদার, পার্টি। অথচ ওর ভালোলাগে টিএসসি’র লনের সবুজ ঘাস, রবীন্দ্র কিংবা নজরুল সংগীত, কবিতা। উফ, আস্তো একটা খ্যাত! কোন পাপে যে একদিন ‘ভালোবাসি’ বলেছিলাম! এতোদিনে ভ্রম ঘুচলো আমার। ভুল হয়েছিল। তবে বেশি দেরি হয়নি এ যাত্রায় তাই রক্ষা।
যাহোক, একদিন একটা সামান্য অজুহাতে এমনভাবে ঘটনাটা ঘুরিয়ে দিলাম যেন সৈকত মনে করে দোষটা ওরই। ভ্যা ভ্যা করে কাঁদছিল সৈকত। আমার মেজাজ তখন আরো খারাপ হয়ে যাচ্ছিল। এতো সহজেই যে ছেলে চোখের জল ফেলতে পারে, সে তো কোনদিনই বিষয়বুদ্ধিতে পাকা হতে পারে না। তার জীবনে উন্নতির আশা করা তো আকাশকুসুম কল্পনা। মা ঠিকই বলেছেন, আবেগ আর কল্পনা দিয়ে দুনিয়া চলে না। যাহোক, বাবার বন্ধুর ছেলে জুবায়ের। বেশ ফিটফাট কেতাদুরস্ত। চেহারা, ব্যক্তিত্বের সাথে মানানসই। সোসাইটিতে খুব মানিয়ে যাবে। যেতেই হবে। ডাক্তার সে। থাকে লন্ডনে। জুবায়েরকে দেখে আমার বুক থেকে একটা ভারী পাথর নেমে গিয়েছিল।
জুবায়ের আসবে তিনটায়। মানে হাতে এখনও ঘন্টা দুয়েক সময় আছে। কিছুক্ষণ পেপার পড়া যাক, এই ভেবে টি-টেবিলের উপর থেকে পেপারটা হাতে নিয়ে সোফায় হেলান দিয়ে বসলো চৈতী। উলটে পালটে সহিত্যপাতায় যেয়ে তার চক্ষুস্থির। একটা গল্প। গল্পকারের নাম তার অপরিচিত নয়। আর সবচেয়ে বড়ো কথা, গল্পের শুরুর লাইনের একেবারে শেষে লেখা আছে জীবনের সবচেয়ে গোপণীয়, আকাঙ্ক্ষিত, প্রয়োজনীয় এবং অনিবার্য শব্দটি। যদিও আশেপাশে কেউ নেই তবুও পত্রিকাটা নিয়ে চৈতী নিজের ঘরের দিকে পা বাড়াল। কেননা ‘শব্দ’টা গোপণীয়তা দাবী করে।
৪
ক্লাসের পেছনের বেঞ্চটা ছাড়া অন্য কোনো বেঞ্চে বসতে অভির ভালো লাগে না। যদি সামনের দুটো বেঞ্চ ফাঁকাও থাকে তবুও শেষ বেঞ্চে বসে অভি। বসে বসে মোবাইল টেপে। অথবা সহপাঠীর সাথে গল্প করে। ক্লাসে এই নিয়ে কতোদিন অপদস্ত হয়েছে সে। ম্যামের কাছে বকাও শুনেছে বহুবার। তবুও বদলাতে পারে না অভ্যাস।
ম্যাম বোর্ডে কি সব হিজিবিজি লিখছেন। ইন্ডাস্ট্রিয়াল ক্যেমিষ্ট্রি পড়াচ্ছেন। কিছু বুঝতে না পেরে বিরক্ত লাগছে অভির। অবশ্য বোঝার চেষ্টাও সে করছে না। কি যে বিরক্তিকর লেকচার! এই ম্যামের ফিগারটাও এমনই বেধড়ক যে একবার তাকালে আর দ্বিতীয়বার তাকাতে ইচ্ছা করে না। সুতরাং কোনো আকর্ষণ নেই ক্লাসে। পাশের সারির মেয়েদের দিকে তাকানো যায়। কেউ কেউ ওড়না একপাশে ফেলে রেখেছে। অতি আধুনিকা কেউ কেউ আবার পরেই নি ওড়না। বুক দেখানোটা ইদানিং মেয়েদের মধ্যে ট্রেন্ড হয়ে গেছে। ছবি তুলবে? তো দাঁড়াও, ওড়নাটা একপাশে সরিয়ে নেই। পার্টিতে যাবে; তো, ওড়না পরার দরকারটা কি? শুধু শুধু ঝামেলা। নাচতে গিয়ে বিপত্তি পোহাতে হবে। আর তাছাড়া কী এমন মহাভারত অশুদ্ধ হবে যদি ওড়না না পরি? তার চেয়ে বরং ফিগারটাকে একটু ছেড়ে দিয়ে আকর্ষণীয় করে তুলতে পারলে হয়তো কোনো একজনের কামনার খোরাক মেটানো যাবে, অথবা কেউ দেখে বলবে, ওয়াও! তোমাকে খুব ‘সেক্সি’ লাগছে। আগের চেয়ে দিন দিন কিউট হয়ে যাচ্ছো তুমি। সেটাও কি কম আনন্দ? নিচু মন-মানসিকতার ভলগার লোকজন অবশ্য সেসব বোঝে না। ভয়াবহ মিডল-ক্লাস-মোরালিটি। মধ্যবিত্তের মধ্যম মন মানসিকতা। যত্তোসব!
হ্যাঁ, মেয়েদের দিকে অবশ্য তাকানোই যায়। কিন্তু ক্লাসের প্রায় সব মেয়েই অভির পরিচিত। পরিচিত শরীরের আনন্দ বেশীক্ষণ স্থায়ী হয় না। অগত্যা অনুচ্চ স্বরে ‘ধুত্তোরি’ বলে মোবাইল বের করলো অভি। ওর পাশে বসে আছে নাহিদ। ট্যাবে কি যেন করছে। হঠাৎ ট্যাবটা অভির সামনে নিয়ে চুপি চুপি বলল, দোস্ত আয় এই গল্পটা পড়ি, মনে হয় সুড়সুড়ি গল্প।
খুবই স্বাভাবিক। এইতো বয়স। এখন না হলে আর কখন? পড়ন্ত বয়সে কি আর রোমান্টিকতা কারো ভালো লাগে? তখন ভালোলাগে দর্শন। তখন জীবন যে একঘেয়ে হয়ে যায়। যেটা যৌবনের জিনিস সেটা যৌবনেই মানায়। অভি নাহিদের আহ্বান উপেক্ষা না করে চোখ রাখে ট্যাব-স্ক্রিনে। এবং প্রথম বাক্যের শেষ শব্দে পৌঁছে খানিকটা ভরসাও পায় সে। যাক, একটা কিছু পাওয়া গেল তাহলে। ক্লাসের একঘেয়ে সময়টা বেশ পার হয়ে যাবে ভেবে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো অভি।
৫
প্রথম বাক্যের শেষ যে শব্দটার জন্য গল্পটাকে ভীষণ আকর্ষণীয় বলে ভেবেছিল পাঠকেরা, শেষে দেখা গেল সারা গল্প জুড়ে সে শব্দটা আর একটিবারও ব্যবহার করেননি গল্পকার। না আছে তেমন উত্তাল কোন ঘটনা। না আছে আর কোনো আবেদন। আসলে গল্পকারের ইচ্ছেই হলো না। তিনি ভাবলেন, না, সবকিছু একেবারে আলগা করে দেখিয়ে দেওয়াটা অনুচিত। কিছুটা পর্দা রাখা ভালো। সামান্য আড়াল ভালো। সব প্রকাশিত করে লাভ কি? উত্তেজনার মিশেল থাকলে যেকোনো গল্পই অনেকবার পঠিত হয় সত্য কিন্তু গল্প তার প্রকৃত সৌন্দর্য হারিয়ে কুৎসিত ও অসুন্দর হয়ে যায়। গল্পের গভীরতা থাকে না। লেখক ভাবলেন, কেউ না পড়ে না পড়ুক তবু আমি রুচিহীন গল্পের জন্ম দিতে চাই না।
অবশেষে যা হবার তাই হলো। সকল উৎসাহী পাঠকের মোহভঙ্গ হলো। কেউ কেউ মুখ বেঁকিয়ে ভ্রু কুচকে বিড়বিড় করে বললেন, ধুর, কি রাবিশ লেখা। একেবারে জঘন্য।
৬
পরদিন সকালে চৈতীর বেডরুম থেকে একটা দোমড়ানো মোচড়ানো অকেজো গল্পকে , যেটা শুক্রবারের সাহিত্যপাতায় ছাপা হয়েছিল, মেঝে থেকে তুলে নিয়ে বা’দিকের জানালার বাইরে ছুড়ে দিলেন চৈতীদের বাড়ির গৃহপরিচারিকা।