“মোরা আর জনমে হংস মিথুন ছিলাম
ছিলাম নদীর চরে
যুগলরুপে এসেছি গো আবার মাটির ঘরে”
অদ্ভুদ পৃথিবী আর তার চেয়ে অদ্ভুত তোমার মন! এক জনমে তাই তোমার মন ভরেনা কবি। তুমি তাই ভাবতে চাও হয়তো বহুপুর্বে তোমার সাথে দেখা হয়েছিলো তোমার প্রিয়তমার। দেখা হয়েছিল কোন এক নদীর চরে। তাই সেই অনাদিকাল থেকেই তোমার ভালোবাসায় এত গভীরতা, অতঃপর যখন বিচ্ছেদ এলো; তুমি গাইলে –
“সে নাই বলে বেশী করে
শুধু তার কথাই মনে পড়ে
হেরি তার ছবি ভুবন ভরে
তারে ভুলিতে মিছে বলা
সে চলে গেছে বলে কি তার
স্মৃতি ও হায় যায় ভোলা”
এই গানটিতে যে কতটা আবেগ, কতটা ভালোবাসা মাখানো তা বলে শেষ করার নয়। শুদ্ধতম অনুভুতির এমন সাবলীল প্রকাশ আমাদেরকে বিমোহিত করে। আর তারপর, কবি যখন এভাবেই স্মৃতিকাতরতা অনুভব করছেন কোন এক শ্রাবনের রাতে একাকী। তখন তার বেদনা ভাষা পাচ্ছে বিমুর্ত হৃদয়ের গভীরতম প্রদেশ থেকে। আর মুখে তিনি উচ্চারণ করছেন-
“শাওন রাতে যদি স্মরণে আসে মোরে
বাহিরে ঝড় বহে নয়নে বারি ঝরে”
না, আমরা জানি ভালোবাসার বোধগুলো বোধকরি আর এমন নেই এখন। তবুও নজরুলের এইসব গানগুলি আমাদেরকে ভাবায়। কবির বিদ্রোহী স্বত্তার সাথেই যে কি মহান প্রেমিক হৃদয়ের সহাবস্থান ছিলো-তা ভাববার বিষয় বৈকি। এমন কতো অজস্র গান আছে নজরুলের যা আমাদেরকে ছুয়ে যায়-
"আধো আধো বোল
লাজে বাধো বাধো বোল
ব'লো কানে কানে
যে কথাটি আধো রাতে মনে জাগায় দোল
ব'লো কানে কানে"
" মোর ঘুমঘোরে এলে মনোহর.
নমো নম, নমো নম, নমো নম।
শ্রাবণ মেঘে নাচে নটবর,.
রমোঝম রমোঝম রমোঝম"
"ভুলি কেমনে আজো যে মনে
বেদনা-সনে রহিল আঁকা
আজো সজনী দিন রজনী
সে বিনে গণি তেমনি ফাঁকা"
"আকাশে আজ ছড়িয়ে দিলাম প্রিয়
আমার কথার ফুল গো , আমার গানের মালা গো
কুড়িয়ে তুমি নিয়ো"
" আলগা করো গো খোপার বাধন
দিল ওহি মেরা ফাস গেয়ি"
"আরো কতোদিন বাকী
তোমারে দেখার আগে বুঝি হায়
নিভে যায় , নিভে যায় মোর আখি "
“মোর প্রিয়া হবে এসো রাণী
দেবো খোপায় তারার ফুল”
কবিদের তো সাধ্য থাকে না, তাদের থাকে সাধ। তাই কবি আকাশের তারাকে প্রিয়ার খোপায় বসিয়ে দিতে চান। এইসব গানগুলোর কোনটা দুর্বোধ্য , কোনটা কঠিন?
কবির এই অকার্পন্য উপমার প্রয়োগ কি আমাদের মনকে চমকিত করে না ? আর চিরবিচ্ছেদ জেনেও যখন কবি বলেন-
“আমি চিরতরে চলে যাবো তবু
আমারে দেবো না ভুলিতে
আমি বাতাস হইয়া জড়াইবো কেশ
বেণী যাবে যবে খুলিতে
তবু আমারে দেবো না ভুলিতে”
কবি আমরা তোমাকে ভুলিনি। যারা এমন গভীর মানবিক অনুভুতিগুলোকে ভাষাময় করে তুলতে পারেন তাদেরকে কি ভোলা যায়? … যায় না। আমরা অনেকেই নজরুল সংগীত বলতেই নাক সিটকায়। অনেক বন্ধুর মুখে শুনি তারা নাকি নজরুল সংগীত বোঝে না, কেমন নাকি কঠিন কথা(!) অথচ ভারী ভারী ইংরেজি রক গান ঠিকই বোঝে। আশ্চর্য !
শুধু বিদ্রোহ নয় প্রতিবাদ নয় বরং জীবনের মৌলিক ও নান্দনিক অনুভুতিগুলোর সংমিশ্রনে নজরুল যে কতটা অনিবার্য তা তার এইসব হৃদয়স্পর্শী গানগুলো শুনলে কিছুটা হলেও বোঝা যায়। আমাদের শ্রবনেন্দ্রীয়ে নজরুলের একটা আলাদা স্থান থাকুক, আমরা যতোই ব্যস্ত অথবা আধুনিক হইনা কেন !
ধন্যবাদ।
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই জুন, ২০১৩ রাত ৯:৫২