(১)
পল্লব হালদার ফটোগ্রাফিটা শুরু থেকেই ভাল করতেন। কবি মন নিয়ে ঝোলা কাঁধে বেড়িয়ে পড়তেন এদিক সেদিক। সে ঝোলায় খাতা-কলম এর বদলে থাকতো ক্যামেরা- ডিএসএলআর। আমাদের হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালাটা শুধু জাত চেনাতেই পারছিলেন না। পরিচিতি বাড়াতে তাকে অগত্যা পরিচিত মহলের সুন্দরী কন্যাদের দিকেই ফিরতে হলো। শাটার পড়তে লাগলো হেমন্তের শেষ বৃষ্টির পর শীতের মত হুড়মুড় করে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বদৌলতে সে খ্যাতি ছড়ালো মাল্টি লেভেল মার্কেটিং এর মতো। ‘অসাধারণ ফটোগ্রাফার’ মন্তব্যের সংখ্যা স্বীয় ভুখন্ড অতিক্রম করতেই তার মনে হলো- এসব তো আত্মপ্রতারণা! কাব্যরসের যথেষ্ট উপাদান পেলেও কবির কাব্যগাঁথা রচনা হচ্ছিলো না। ‘এখানে গল্প কোথায়?’ ভাবলেন, হালের স্রোতে গা না ভাসিয়ে তাকে যেতে হবে প্রকৃতির মাঝে। প্রেম ও জীবন যেখানে সমার্থক শব্দ।
দীর্ঘ সময়ের জন্য কোথায় যেন উধাও হয়ে গেলেন। অনলাইনে ফিরলেন মাসখানেক পরে। জানালেন ঘুরে বেড়িয়েছেন নানা জায়গায়। আরও জানালেন আগামী মাসেই একটি ফটোগ্রাফি প্রদর্শনী দিবেন “সমগ্র বাংলাদেশঃ ৫ টন” শিরোনামে। কিছু সঞ্চয় দিয়ে আয়োজন করলেন সে প্রদর্শনীর। শুভাকাংখীদের আগ্রহের ভারে সফল হলো সে প্রদর্শনী। মাস দুয়েকের ব্যবধানে এলেন “নগর, জীবন ও জীবিকা” প্রদর্শনী নিয়ে। এবার পেয়ে গেলেন স্পন্সর, শিরোনাম হলেন পত্রিকার বিনোদন পাতায়। আলোচক-সমালোচকদের মন্তব্যে খ্যাতির শীর্ষে এসে গেলেন পল্লব ভাই। আর তখনই তার সাথে আমার পরিচয়।
পরবর্তী বছর খানেকের জন্য তিনি কয়েকটি পত্রিকা ও ম্যাগাজিনে চুক্তিবদ্ধ হলেন। প্রাকৃতিক নৈসর্গিক সৌন্দর্য্য থেকে রাজনীতির ময়দানে জনগণের ভাষা- সবই উঠে আসলো পল্লব ভাইয়ের ফ্রেমে। বছর খানেক পর ‘লাইফ’ ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদে আসলো তার ছবি। ছোট-বড় নানা পুরষ্কার পেয়ে ততদিনে তার স্বর্ণসময়। নানা অনুষ্ঠান, কর্মশালা আর প্রদর্শনীতে অতিথি হিসেবে আমন্ত্রণ পেতে লাগলেন পল্লব ভাই। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রমোশন আর পীপিলিকার মিছিলের মত বন্ধু-স্বজন ও শিষ্যদের ভীড়ে পল্লব ভাই হয়ে উঠলেন আদর্শ।
মনস্থির করলেন দেশের অজানা-অদেখা সৌন্দর্যগুলোকে মানুষের সামনে নিয়ে আসবেন। খ্যাতির সুবাদে সহজেই পেয়ে গেলেন নামকরা স্পন্সর। ফেসবুকে ইচ্ছার কথা প্রকাশ করতেই এক পাল আগ্রহী শিষ্যের হাজির হলো। সেই স্পন্সর প্রতিষ্ঠানেই কাজ করার সৌভাগ্যে আমরা কয়েকজন তার সফরসঙ্গী হবার সুযোগ পেয়ে গেলাম। কথা ছিল জুলাই মাসের ৭ তারিখেই যাত্রা শুরু করবো আমরা। যাত্রা শুরু হবে শেরপুর থেকে। কিন্তু বাঁধ সাধলো বন্যা। হঠাতই বন্যায় আক্রান্ত হলো বাংলাদেশ। দেশপ্রেম বেঁচার সুযোগ হাতছাড়া হলো আমার সেই স্পন্সর প্রতিষ্ঠানটির, অপেক্ষা বন্যা নামা পর্যন্ত। উপরন্তু ডাক এলো পত্রিকাগুলো থেকে- বন্যা নিয়ে প্রতিবেদনের ছবির জন্য। পল্লব ভাই সব ফেলে একাই দৌড়ে গেলেন সুনামগঞ্জে।
(২)
হাওড় অঞ্চলের রাজধানী এই সুনামগঞ্জ সহ আশপাশের জেলাগুলোতে বন্যার পানি বাড়ছে। যে বিপর্যয়টি এ দেশে প্রতি বছর রুটিন মাফিক হয়, সেটারও সময়মত বন্দোবস্ত থাকে না। প্রথমে পত্রিকার শিরোনাম হতে হবে, তারপর আসবে টিভি চ্যানেলগুলোর সরেজমিন প্রতিবেদন। এরপর পত্রিকার দ্বিতীয় দফা প্রতিবেদনে স্থানীয় সরকারের বন্যা মোকাবেলায় কার্যত অকার্যকারতা প্রকাশ পেলে তখন গিয়ে জনগণের ‘সেন্টিমেন্টাল ইস্যু’ হবে। বাড়বে মিডিয়ার ‘টক শো’, টনক নড়বে সরকারের। বাণের পানি ততদিনে বাড়ির উঠোন মাড়িয়ে গৃহকর্তার নাক বরাবর। আর যাই হোক, এ তো কিছুতেই হতে দেওয়া যায় না। দেবতার মত তখন জীবন বাঁচাতে ঝাঁপিয়ে পড়বে সরকার দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থাগুলোকে নিয়ে। কিন্তু হয় কালবিলম্ব, কেননা আন্তর্জাতিক সাহায্যের আশায় জিহ্বা বের করে বরাদ্দ তহবিলে তখন কৃত্তিম ঘাটতি। অবশেষে বহির্বিশ্বের সাহায্যের পর একসম্য আসে ত্রাণ। ত্রাণের বস্তা কিন্তু ঠিক ততখানিই উঁচু হয় যতখানির উপরে দাঁড়িয়ে গৃহকর্তা শুধু নাক নয়, মুখ বাঁচিয়ে টিভি চ্যানেলের সামনে স্থানীয় সরকারের পাশে দাঁড়িয়ে দুটো হাস্যোজ্জ্বল কথা বলতে পারে। ব্যস! “জীবনে ফিরে এসে হাসি ফুটেছে হাওড় অঞ্চলে” শিরোনামে পত্রিকারও কাটতি বাড়ে, সরকারের মেয়াদেরও। শুধু বাস্তবে সে ত্রাণ নিয়ে বন্যা থেকে পরিত্রাণ মেলেনা হাওড়বাসীর।
পল্লব ভাই সুনামগঞ্জ পৌঁছে প্রথমে উঠলেন স্থানীয় এক চেয়্যারম্যানের বাড়িতে। চেয়্যারম্যান সাহেব অনেক ভাল মানুষ, যথেষ্ট আপ্যায়ন করলেন। হাসিভরা মুখ দেখে বোঝারই উপায় নেই যে শুধু তার গ্রামেই এখন ৪০ পরিবার বন্যায় আক্রান্ত। পরদিন থেকে পল্লব ভাই বের হয়ে গেলেন বন্যাদুর্গত অঞ্চলগুলোতে। বন্যা আক্রান্ত মানুষগুলোর দুঃখ-কষ্টের ছবি তুলতে লাগলেন একের পর এক। ‘পানিতে শুধু ঘর নয়, স্বপ্নও ভেসে যাচ্ছে’ শিরোনাম দিয়ে পাঠাতে লাগলেন ছবিগুলো। পত্রিকা থেকে টিভি মিডিয়া হয়ে স্থানীয় সরকারের ভীড় বাড়তে লাগলো। দিনে দিনে পরিচিত সাংবাদিকদেরও পেয়ে গেলেন।
পরিচিত কয়েকজন মিলে প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানবেতর জীবন-যাপনের উপর বেশ কিছুদিন কাজ করে ফিরছিলেন শহরের দিকে। দেখলেন ভীড়টা এখন আরও বেড়েছে। একদল শহুরে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ফটোগ্রাফারের দলের সাথে দেখা হলো ফিরতি পথে। তখনই শুনলেন সুনামগঞ্জে ঐতিহাসিক নৌকা বাইচের আয়োজন করা হয়েছে। অতিথি হয়ে আসছে মাননীয় মন্ত্রীবর্গের বেশ কয়েকজন, গুরুত্বপূর্ণ কিছু আমলা, ব্যবসায়ী, স্থানীয় সরকার-নেতাগণ। ঢাকা ও অন্যান্য জেলা থেকে আসছে প্রচুর দর্শনার্থী। চারদিকে এজন্যই উৎসবমুখর পরিবেশ। ঐ ছেলেদের আগমনও সে কারণেই।
হাওড় অঞ্চলে বন্যার পানিতে নৌকাবাইচের আয়োজন শত বছরের। নদীমাতৃক পুরো বাংলাতেই এ প্রথা বিদ্যমান। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের পরে সকল প্রতিকূলতা কাটিয়ে আবারও জীবনে ফিরে আসতে এই নৌকাবাইচ এ অঞ্চলের মানুষদের প্রেরণা জোগায়, নৌকাবাইচ এখানে জীবনের জয়গান গায়।
কিন্তু নৌকাবাইচের কথা শোনার পর থেকেই পল্লব ভাই গভীর চিন্তার মধ্যে পড়ে গেলেন। সাথের সাংবাদিক বন্ধুদের ঔৎসুকতা উপেক্ষা করে তিনি একাই থেকে গেলেন গ্রামে। রাতে প্রতিবেদন লিখতে বসলেন। ঘুরে ফিরে আসলো নৌকাবাইচের কথা-
"নৌকাবাইচ হাওড় অঞ্চলের শতবর্ষের প্রথা। জীবনের সাথে লড়াই করে যাওয়া মানুষগুলোর মাঝে আনন্দ ফিরে আনে এই আয়োজন। কিন্তু তারও তো একটা সময়জ্ঞান আছে। সে কি জীবন-মৃত্যুর সন্ধিখানে? আমি এমন পরিবারকেও দেখেছি যারা না ধনী না গরীব, তারা না পারছেন ‘রেফারেন্স’ থেকে বরাদ্দ বাড়াতে, না পারছেন ত্রাণের লাইনে মারামারি-কাড়াকাড়ি করতে। স্থানীয় কিছু আমলার উদ্যোগে কতিপয় বড় বড় ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতায় এখানে শিঘ্রই নৌকাবাইচের আয়োজন হতে যাচ্ছে। যেখানে অংশ নেবেন মাননীয় মন্ত্রীমহোদয়, ব্যবসায়ীগণ। দেশের মানুষের চোখ এখন যে বাণের পানিতে সেখানে ব্র্যান্ডিং এর সুযোগ কেউ হাতছাড়া করতে চান না। দুর্গাপুর গ্রামে সেই অনাহারেই মারা যাওয়া দাদীর কথা বলা বিনোদদের পরিবারের কান্না ছাপিয়ে বিনোদন চলছে ঘটা করে।
মাননীয় মন্ত্রী, আপনাকে বলছি। এ মুহুর্তে নৌকাবাইচের চাইতেও এখানে বেশি দরকার আপনার দৃষ্টি, আপনার সাহায্য, আপনার উপস্থিতি। আপনি আপনার ত্রাণ ভান্ডার নিয়ে আসুন, দেখে যান এখানের জীবনের সংজ্ঞাকে। এমনকি বোধ করি এ সাহায্য আপনাকে ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার সামনে নৌকাবাইচ উদ্বোধনের ফুটেজের চাইতেও বেশি ‘হাইলাইট’ করবে পরদিন পত্রিকার পাতায়। এ আয়োজন তো পরেও হতে পারে। বাণের পানি কমলে নাহয় আমরা এ আয়োজন করি সবাইকে সাথে নিয়েই, আয়োজন করি সত্যিকারের হাসিমাখা মুখগুলো নিয়ে। নৌকাবাইচে স্পন্সর প্রতিষ্ঠানগুলো ও আমলারা যে পরিমাণ বরাদ্দ করেছেন, তাতেই তো অর্ধেক সাহায্য হয়ে যাবে এখানে। সে টাকা ত্রাণে ঢালুন।"
প্রতিবেদনটি পত্রিকায় ছাপানোর পর বেশ ধাক্কা লাগলো টক শো গুলোতে। পল্লব ভাই অবশ্য বুঝতে পারছিলেন খুব একটা লাভ হবে না। সেজন্যই মন খারাপ ছিল তার। দু’দিন ঘর থেকেই আর বের হলেন না। ভাবতে লাগলেন সমাজকে নিয়ে, জীবনকে নিয়ে, নিজেকে নিয়ে। মানুষের ভাবনা কখনও এক জায়গায় স্থির থাকে না। পল্লব ভাইয়ের ভাবনা চলে আসলো নিজের জীবন নিয়ে। তিনি নিজেই কি করেছেন এতদিন, কি করছেন! তিনিই বা কতটুকু সাহায্য করছেন এ মানুষদের!
রাত-দিন পানিতে চুবানি খেয়ে ক্যামেরা হাতে দৌড়ে গেছেন হাওড় অঞ্চলের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত। শুনেছেন তাদের দুর্দশার কথা, দুটো ছবি তোলার পর তাদেরকে সান্ত্বনার কথা শোনানোর প্রয়োজন হয়নি তার। বরং তারাই তাকে শুনিয়েছেন তাদের এভাবেই সংগ্রাম করা ইতিহাসের গল্প, শিখিয়েছেন জীবনের আরেক সংজ্ঞা। হ্যা, তার তোলা ছবিই তো ছাপা হচ্ছে পত্রিকার পাতায়, জনগণের নজরে আসছে দুর্দশার ভয়াবহতা, তবেই না বাড়ছে তহবিল, আসছে ত্রাণ। কিন্তু এসবই তো পেশার কারণে করা। যদি এ তার পেশা না হতো, তবে কি সত্যিই তিনি মানবিক বোধ থেকে এ দুর্গম মানুষদের অবর্ণনীয় কষ্ট দেখতে আসতেন? হয়ত আসতেন সেই নৌকাবাইচে, যার দুটো ছবি হয়ত তাকে এনে দিত আরেকটি প্রতিযোগিতার শীর্ষস্থান। পেতেন স্পন্সর, বাড়তো রমরমা ব্যবসা! যতই চিন্তা করছেন ততই তলিয়ে যাচ্ছেন। কর্পোরেট সামাজিকতা, পুঁজিবাদী অর্থনীতির তোড়ে তিনিও তো বাণের পানিতে খড়কুটোর মতই ভেসেছেন এতদিন, ভেসে চলেছেন এখনও। সে বাণে ত্রাণ নিয়ে যারা এসেছে, তারা তো তাকে ধন্য করেনি, তারা ধন্য করেছে তার চিন্তা বিক্রির মানসিকতাকে, বরং নিয়ে গেছে তার শিল্প-সংগ্রাম-সময়। এ চিন্তা তাকে কুড়ে কুড়ে খেয়েছে সে রাত।
(৩)
সমস্ত চিন্তার জগত ওলট পালট করে পরদিন তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন- আজই ঢাকায় ফিরে যাবেন। ঢাকায় ফিরে ছবির পেছনের গল্পগুলো বললেন তার পরিচিতজন ও শিষ্যমহলের সবাইকে ডেকে। এরপর তাদেরকে আহ্বান জানালেন নিজ দায়িত্ব মনে করে মানবতার জন্য স্বেচ্ছায় ত্যাগ, শ্রম দিতে যারা ইচ্ছুক তারা যেন তার সাথে ফিরে যায় বন্যাদুর্গত অঞ্চলে। নিজেদেরকে অর্থকড়ি জোগাড় করতে হবে, থাকবে না নিজেদের প্রচারণা। যার যা কিছু আছে, তাই নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে কর্তব্যজ্ঞান মনে করে। ৮ জন সদস্যের একটি দল হয়ে গেল। এক জীবনের সবচেয়ে বড় সৌভাগ্যবশত সে যাত্রায় পল্লব ভাইয়ের সাথে যাওয়ার সুযোগ পেলাম।
পল্লব ভাই ঢাকায় ফেরার দুই সপ্তাহের ব্যবধানে আমরা ফিরে গেলাম হাওড় অঞ্চলে। কবির কবিতা বুঝতেও কবি মন থাকা লাগে। পল্লব ভাই ঢাকা ফিরে এখানের যে গল্প বলেছিলেন তাতে আমাদের মন টলেছিল। কিন্তু আত্মায় গিয়ে আঘাত করলো চাক্ষুস পর্যবেক্ষণে। চারিদিকে শুধু পানি আর পানি। দেশে খরা হয়, জরা হয়, প্রলয়ংকরী ঘুর্ণিঝড় হয়। যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙ্গে তো পড়েই, খাদ্য সংকটও দেখা দেয়। কিন্তু বন্যা! চোখের সামনে একটু একটু করে বাড়ছে পানি। প্রথমে গিলছে ফসলের ক্ষেত, তারপর বাড়ির জাংলা, উঠোন। এরপর ভিটেমাটি, তারপর ঘড়। চোখের সামনে মরছে হাস-মুরগী-গরু। ‘তিলে তিলে মারা’ হচ্ছে যেন জীবনকে। যেখানে পা দেয়ার মত মাটিই নেই, থাকতে হয় ঘরের চালে সে কেমন জীবন!! জনসংখ্যার হিসেবে দুর্যোগকালীন ‘শেল্টার’ এর ধারণক্ষমতা অপ্রতুল বললেও বাড়িয়ে বলা হয়। তাছাড়া যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ায় প্রান্তিক মানুষজনের পক্ষে এখানে আসাও সম্ভব হয় না। আমরা এসেই দুর্গত অঞ্চলে চলে আসলাম। আমাদের কি কি কাজ ও দায়িত্ব তা আগেই ঠিক করা ছিল।
ঢাকায় থাকার সময়ই প্রচারবিমুখ কিছু ব্যক্তি ও সেচ্ছাসেবী সংস্থা থেকে আমরা এ ক’দিনে একটা সাহায্য ফান্ড গঠন করেছিলাম। তার পাশাপাশি যে অঞ্চলেই এসেছি সেখানে স্থানীয় সরকার তথা চেয়্যারম্যানদের সাথে দেখা করে তাদের থেকেও অর্থ কিংবা নানা রকম সাহায্যের বন্দোবস্ত করেছি। সেসব নিয়ে আমরা দুর্গত অঞ্চলে গেলাম। আদ্রকে শুকনো বস্ত্র দিলাম, রান্না করা খাবার দিলাম। পল্লব ভাই দলের সাথে ডাক্তার শুভ্রদাকে নিয়েছিলেন। তিনি প্রাথমিক চিকিৎসা দিতে লাগলেন। প্রবীণ বৃদ্ধকে নৌকায় করে এনে শেল্টারে রেখে গেলাম। নিজে ফটোগ্রাফার হওয়ায় পল্লব ভাইয়ের পরিচিত মহলও ছিল এদিকের, এই সাহায্য দলেও ফটোগ্রাফারের সংখ্যাই বেশি। গায়ে খেঁটে সাহায্যের পাশাপাশি একটু সুযোগ পেলেই তারা ফ্রেমে বেঁধে নিচ্ছেন এখানের দৃশ্য, সে সবি পাঠিয়ে দিচ্ছেন ঢাকায়। ঢাকায় আরেকদল স্বেচ্ছাসেবীর প্রচেষ্টায় সে ছবিগুলোর প্রচারণা হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের গণজোয়ার হয়ে। যে মানুষটি পৃথিবীতে এসেছে, পৃথিবী ছেড়ে চলে যাবার আগে আরেকটি জীবন দানের মাধ্যমেই যে তার জীবনের সার্থকতা থেকে যায় এ বোধটা আমাদের জীনের মধ্যে থাকলেও আমরা কখনও আলাদাভাবে ভেবে দেখিনি। ভেবে পেলাম এখানে এসে। একজনকে জীবনের পথে নিয়ে আসার মধ্যে যে কি আনন্দ তা আমরা সবাই দ্রুতই ধরে ফেললাম। এরপর আর রাত-দিন একাকার করে বিভিন্ন প্রান্তে ছুটে যাওয়া কষ্টের লাগেনি কারও। এক সময় বন্যার পানি কমতে শুরু করলো।
পুরো হাওড় অঞ্চল আমাদের পক্ষে সাহায্য করা সম্ভবপর ছিল না। আমরা একটি ছোট অঞ্চলে কাজ করতাম। এখানে পানি নেমে এলে আমরা এবার নামলাম ঘর-বাঁধার কাজে। দুঃস্বপ্নের রাত শেষে ভোরের আলোয় আবারও স্বপ্ন দেখা শুরু করলো এখানের মানুষের। মুখের হাসি দেখে বোঝার উপায়ই নেয় কি ভয়াবহ সময় কাটিয়ে এসেছে এরা। এই তো সংগ্রাম, এই তো জীবন। এই তো বড় উৎসব!
দিন দশেক পরে মোটামুটি ঘর-বাঁধার কাজ যখন শেষ হয়ে আসছে তখন বহুদিন পর আমরা ঘুরে দেখার অবকাশ পেলাম স্বাভাবিক গ্রামখানাকে। নৌকায় চলতে চলতে আমরা এগোচ্ছিলাম। হঠাতই আমার চোখ আটকে গেল সামনের এক দৃশ্যে। স্বর্গ এমন হলেও হতে পারে! আমার মুখ থেকে শুধু বেড়োল- “ওয়াও”! সহযাত্রীগণের সবার কানে পৌছতেই দৃষ্টি দিলেন সেদিকে।
ওটা গ্রামের একটি প্রান্ত। একপাশে দেখা যাচ্ছে বিলের পানি, অন্যপাশে গ্রামের শুরু। বিলের পানিতে ভেসে আছে খড়কুটো, উপড়ানো গাছ, গাছের ডালপালা, ঘড়ের বেড়া। সেদিকে দূরের গ্রামে তালগাছের সারির উপরে শেষ বিকেলের সূর্য যে হার মানছে এ অধ্যায়ের। গ্রামের দিকে নতুন ঘড় বাঁধা হচ্ছে সারি সারি। গ্রামের কিছু মানুষ বসে আছে হাসিমাখা মুখ নিয়ে। ঠিক বিলের প্রান্তেই দুটি শিশু খেলা করছে।
সৌন্দর্যের সংজ্ঞা একেকজনের কাছে একেকরকম। কবি নজরুল ঘাসফুল থেকে যুদ্ধের ময়দানেও সৌন্দর্য দেখেছিলেন। গাঁয়ের এ অতি সাধারণ দৃশ্যই যে এমন অনন্য অসাধারণ সৌন্দর্যের প্রতীক হয়ে আমাদের চোখে ধরা দিবে তা আমরা বুঝতাম না এখানে না আসলে। ভাল লাগা সে দৃশ্য ফ্রেমে বন্দী করতে আমাদের দলের ফটোগ্রাফাররা সবাই ক্যামেরা হাতে নিলেন। ছবি তুলে একেকজনের সে কি প্রাপ্তি! কি আনন্দ! আমি পল্লব ভাইকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘ভাই এমন দৃশ্য আমাদের চেয়ে আপনার হাতে তো আরও ভাল আসবে। আপনি তুলুন না একটা।’
পল্লব ভাই উত্তর দিলেন, ‘সারাজীবন তো লেন্সের চোখ দিয়েই দেখে গেলাম, আজ নাহয় এর সৌন্দর্য নিজের চোখ দিয়েই মনে ধরে রাখি।’
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই মার্চ, ২০১৫ রাত ১২:৪২