বিশেষ উপলক্ষ্যে দিবস পালন করা কখনই শুধু নির্দিষ্ট দিনটিতেই উদযাপনের জন্য তৈরী করা হয়নি। কিন্তু আজকাল দিবস পালন গুলো দিবস কেন্দ্রীকই থেকে যাচ্ছে।
লাখ টাকার ফুল দিয়ে আসলাম শহীদ বেদীতে আর বরকত দের কবর গহীন বাঁশঝাড়ে!
সারারাত ডিএসএলআর চার্জ দিয়ে ভোররাতে এলার্মে কাঁচা ঘুম ভেঙ্গে খালি পায়ে যে শহীদ মিনারে আসলাম সপ্তাহব্যাপী ভালবাসা উদযাপন শেষে মানিব্যাগের উচ্ছিষ্টটুকু দিয়ে কেনা ফুল হাতে, সে শহীদ স্মরণী যাদের বুকের রক্তে গড়া তাদের পরিবারের অবস্থা সম্পর্কে জানা দূরে থাক, তাদের কবরটা কই সে খোঁজও জানি না।
'বুকের রক্তে গড়া'-র মূল্য কি আমরা বুঝি? দেশের জন্য, পরবর্তী প্রজন্মের জন্য কতখানি ত্যাগ স্বীকার করতে পারলে জীবন দিতেও কুন্ঠাবোধ থাকে না, তা কি আমরা বুঝি?
আর আজ আমরা সেই প্রজন্ম সে ফসল ভোগ করছি সহলভ্য কল্কের দু' আনার কয়লার মতো।
আমরা প্রায়ই ছুতো পেলেই দাঁত-মুখ খিচিয়ে লাফিয়ে উঠে 'বাঙালি' জাতিটাকে বিষম রকম গালমন্দ করার সুযোগ হাতছাড়া করি না। এ প্রজন্ম অতীত ভুলে গেছে, এ প্রজন্ম তার গত প্রজন্মের ঋণ শোধ দূরে থাক, স্বীকার করে না। ততদিন পর্যন্ত এ মাটি এখনও অভিশপ্ত। দাদা, জাতটাকে গালাগাল করলে যে আপনারই কর্তব্য ভোলা অকৃতজ্ঞতার পরিচয় পাওয়া যায় তা কি ভেবেছেন?
ইতিহাস থেকে দূরে বলেই আজ আমরা নিজের আত্মপরিচয়ই জানি না। জানি না- পুরো পৃথিবীর শৌর্যে-বীর্যে সবচেয়ে গৌরবমন্ডিত জাতিটাই আমরা। গ্রীক বীর আলেকজান্ডারের নাম জানি, পুরো পৃথিবীর জয় করে এসে কোন জাতির কাছে এসে পরাজিত হয়েছিল তা জানি না।
হ্যা, সেসব ইতিহাস। কিন্তু বাঙালি জাতি পিছিয়েছি দু'বার, দু'বারই বিশ্বাসঘাতকার কারণে। প্রথমবার মীর জাফরদের বিশ্বাসঘাতকতায় অন্তত ২০০ বছর। পরেরবার রাজাকারদের বিশ্বাসঘাতকায় জাতির সূর্যসন্তানদের হারিয়ে ১০০ বছর। এখন যে উঠবো, কিন্তু কি করে? অতীত আত্মপরিচয়ই তো জানি না।
এই যে দেশে বিশেষ দুই নেতার মৃত্যুদিনে মসজিদে বিশেষ দোয়া'র ব্যবস্থা হয়, ভাষা শহীদদের জন্য হয়? মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য হয়?
একুশে ফেব্রুয়ারী আজ ফুরফুরে 'হলিডে'!! আজিমপুরে থাকা সজীবরা বিশেষ ছুটির দিন পেয়ে রাইডিং গ্রুপের সাথে হ্যাংআউটে বের হবে, দিনশেষে ফেসবুকে ছবি আপলোড দিবে- 'শহীদ দিবস রাইডস, ফিলিং হ্যাপী'- এই তো একুশে ফেব্রুয়ারী!
ভাষা আন্দোলনের দু'টি দাবির দ্বিতীয়টি ছিল- সকল স্তরে বাংলা ভাষার প্রয়োগ। ৬৩ বছরে সে চাওয়া থেকে আমরা আগাইনি, নিজস্ব স্বাধীন ভূমি পাওয়ার পরেও আমরা উল্টো পিছিয়েছি।
যুগ এমন যে টিভি খুলে দেখি একুশে ফেব্রুয়ারী কি দিবস সেটাই অনেক জানে না!
দুর্ভাগ্য আমাদের যে 'একুশ মানে মাথা নত না করা'-র অর্থ আমরা জানি না, আমাদের অনুপ্রেরণার জায়গাগুলো সম্পর্কেই অজ্ঞ, আমরা উঠবো কি করে!!
আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারী,
আমার বোনের কষ্টে গাঁথা একুশে ফেব্রুয়ারী।
ইতোমধ্যে এ প্রজন্মের কাছে হারিয়েই গেছে ভাষা আন্দোলন ও অন্যান্য আন্দোলনে আমাদের নারীদের সাহসী ভূমিকার কথা।
আবার মাঝে মাঝে মনে হয়, "৭ই মার্চে বঙ্গবন্ধু জয় পাকিস্তান বলেছিলেন" এর মতো ইতিহাস যে হারে বিকৃত হচ্ছে তাতে বিষ্মৃত হওয়াও কম খারাপ না। জাতির ইতিহাস, শহীদদের সংরক্ষণ ও সংশোধন এর পাশাপাশি ভাষারও সংরক্ষণ ও সংশোধন জরুরী হয়ে গেছে। কেননা, ইদানিং প্রায়ই মাতৃভাষাকে যে উচ্চারনে শুনে থাকি, তাতে মনে হয় কেউ যেন গালে চটাস করে থাপ্পড় কষালো! সংশোধনের দায়িত্বই না পালন করবে কে? ভাষা শহীদের স্মরণে নির্মিত বাংলা একাডেমী'র প্রকাশিতব্য প্রবন্ধেই ভুল পাওয়া যায়। তাছাড়া খোদ 'বাংলা একাডেমী' নামটাই তো পুরো বাংলা না।
যাই হোক! সে কখন থেকে বকবক শুরু করেছি। আজ থামি। তবুও স্বপ্ন দেখি- সেই কয়লার স্তূপের নিচেই হীরা জন্মাবে। কেউ আসবে? একদিন বাংলা কলংকমুক্ত হবে। এত কিছুর পরেও এ স্বপ্ন দেখি- কারণ আমি বাঙালি। সত্যিকারের বাঙালি একবার মরে, দুইবার মরে না।