আমাদের জাতীয়তা কি- এ নিয়ে অনেক কথা যেমন হয়েছে, অনেকেই আবার এ বিষয়ে নিরুত্তর, অনেকে তো এ বিষয়ে ভাবতেই নারাজ। আদতে বিষয়টা হেলাফেলার নয়। আমার জাতীয়তারই যদি ঠিক না থাকে মানে জাতীয়তাবোধটাই যদি পরিষ্কার না হয়, তাহলে আর সমাজে আমার অবস্থান কোথায় রইল!!
ছোটবেলায় আমাদের বই পুস্তকে লেখা ছিল- আমাদের জাতীয়তা কি? উত্তর- বাংলাদেশী। জোর করে আমাদের তা মুখস্ত করানো হতো। আসলে আমাদের জাতীয়তা কি বাংলাদেশী নাকি বাঙ্গালি?
আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম মূল ভিত্তি ও চেতনা ছিল জাতিসত্তাভিত্তিক বাঙালি জাতীয়তাবাদ। ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে ভাষা ও সংস্কৃতিভিত্তিক জাতীয়তাবাদের এ লড়াই শুরু হয়েছিল বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। মুক্তিযুদ্ধের আগে অসহযোগ আন্দোলনের সময় পূর্ব বাংলা জুড়ে ধ্বনিত হয়েছিল, "বীর বাঙালী অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো।" বাংলাদেশি নামে কোন জাতি কিংবা জাতীয়তাবাদের কথা তখন শোনা যায়নি। মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রকাশিত লিফলেট আর পোষ্টারে লেখা ছিল- "বাংলার বৌদ্ধ, বাংলার খৃষ্টান, বাংলার হিন্দু, বাংলার মুসলমান; আমরা সবাই বাঙ্গালি"। বাহাত্তরের মূল সংবিধানে ঘোষিত হয়েছিল, "বাংলাদেশের নাগরিকগণ বাঙালী বলিয়া পরিচিত হইবেন।"
স্বাধীনের পর গোড়ার দিকে বাংলাদেশের জাতীয়তা নিয়ে কোন বিতর্ক ছিল না। এই জাতীয় বিতর্কের প্রথম সূত্রপাত ঘটায়– ভারতীয় দক্ষিণপন্থী কিছু গোষ্ঠী ও কিছু ভারতীয় পত্র-পত্রিকা। ভারতীয় সাংবাদিক বসন্ত চট্টোপাধ্যায় স্বাধীন বাংলাদেশের বাঙালিদের ‘বাংলাদেশী’ নামকরণের প্রস্তাব দিয়েছিলেন তাঁর ১৯৭৪ এর ‘Inside Bangladesh today: an eye-witness account’ গ্রন্থে। বিভিন্নভাবে এরা প্রচার করা শুরু করে যে, বাংলাদেশের মানুষ যদি নিজেদেরকে বাঙালি জাতি বলে পরিচয় দেয়, তা হলে পশ্চিম বাংলার বাঙালিদের পরিচয় কি হবে? তারা দাবী তুলেছিলো– বাংলাদেশের অধিবাসীদের জাতীয়তা বাঙালি ছাড়া অন্য কিছু খুঁজে নেওয়া উচিত্। এই প্রচারণার অন্যতম হোতা ছিলেন পশ্চিম বাংলার প্রখ্যাত দৈনিক আনন্দবাজারের নির্বাহী সম্পাদক শ্রী সন্তোষ কুমার ঘোষ। এর সাথে যুক্ত হয়েছিল অখণ্ড ভারতে বিশ্বাসী ভারতীয় গোষ্ঠীগুলো। তাদের শঙ্কা ছিলো– বাংলাদেশ সৃষ্টির নিদর্শন দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে, পশ্চিম বাংলায় বাঙালি জাতীয়তাবোধ তীব্রতর হতে পারে এবং তা থেকে পশ্চিম বাংলায় পৃথক রাষ্ট্রের দাবি উঠতে পারে। '৭৫ পর্যন্ত ভারতীয়রা অজস্র লেখালেখি ও প্রচারণা সত্ত্বেও– বাংলাদেশের অধিবাসীদের জাতীয়তা বাঙালিই থেকে যায়।
এরপর শেখ মুজিবের বেশ কিছু ভুল সিদ্ধান্তে মুজিব বিরোধী কর্মকান্ড বেড়ে ওঠে এবং অবশেষে মুজিব হত্যার পর নতুন সামরিক শাসক হিসাবে জিয়াউর রহমান নতুন ধারা প্রয়োগের ম্যান্ডেট পেয়ে যান– তার নতুন রাজনৈতিক আদর্শের সাথে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ অংশ যুক্ত করে দিয়ে। ১৯৭৭ সালে জিয়াউর রহমান হ্যাঁ/না ভোটের মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর এই নূতন জাতীয়তাবাদের বিষয়টি সংবিধানে যুক্ত করেন। যদিও ১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ তারিখের দৈনিক বাংলা পত্রিকায় জিয়াউর রহমানও– বাঙালী জাতীয়তাবাদকে স্বীকার করে নিয়েছিলেন। উক্ত পত্রিকার ‘একটি জাতির জন্ম নামক’ প্রবন্ধের শুরুতেই লিখেছিলেন- ‘পাকিস্তান সৃষ্টির পর পরই ঐতিহাসিক ঢাকা নগরীতে মিঃ জিন্না যে দিন ঘোষণা করলেন উর্দু এবং উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা- আমার মতে ঠিক সেদিনই বাঙালী হৃদয়ে অঙ্কুরিত হয়েছিল বাঙালী জাতীয়তাবাদ।’ (সূত্র: আমরা বাংলাদেশী ও বাঙালি। আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরী। অক্ষরবৃত্ত প্রকাশনী। ফেব্রুয়ারি, ১৯৯৩)।
গ্রীক বীর আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটকে রুখে দেওয়া পৃথিবীর একমাত্র জাতি আমাদের পূর্বপুরুষ। সেইসব শত বীরত্বগাঁথা রযেছে আমাদের এ অঞ্চলের মানুষের রক্তে। হাজার বছরের পুরনো এ জাতি বরাবরই বাঙ্গালি নামেই পরিচিত। ভারত-বিদ্বেষ এর কারণে পশ্চিমবঙ্গ থেকে নিজেদের পৃথক করতে আমরা আমাদের বীরত্ব মাখা ঐতিহাসিক পরিচয় মুছে ফেলবো এটা কখনই কাম্য নয়। এমনকি পৃথিবীর ইতিহাসেও যদি তাকাই দেখবো, পূর্ব জার্মানি-পাশ্চিম জার্মানি কিংবা দুই ভিয়েতনাম কিংবা দুই কোরিয়া যখন রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ করে পৃথক হয়ে গেছে তখনও তারা সীমানার কাটাছেঁড়া করা ছাড়া জাতীয়বাদ পরিবর্তন করেনি। উভয় অংশই পূর্বের ন্যায় নিজের জাতীয়তার পরিচয় ধরে রেখেছিল/রেখেছে।
অন্যদিকে বাংলাদেশী জাতীয়বাদ নিঃসন্দেহে সংকীর্ণ ও ত্রুটিযুক্ত। এখানেও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীসমূহের সাংবিধানিক স্বীকৃতি নেই। উপরন্তু এতে একটি সাম্প্রদায়িক উপাদান রয়েছে, সেটি হল ধর্মীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতার প্রয়োগ। এর সাথে মিল রয়েছে ধর্মভিত্তিক দ্বি-জাতি তত্ত্বের, যা আমরা একাত্তরেই পরিত্যাগ করেছি।
আমি বাঙ্গালি- এর চেয়ে গর্বের আর কি হতে পারে? তবে হ্যা! রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় জাতীয়তার প্রশ্নে বাঙ্গালি জাতীয়তাবাদ তার ক্ষুদ্র জাতিসত্তার জনগোষ্ঠীসমূহের জাতীয়তার ব্যাখ্যা এখনও দিতে পারেনা, অধিকার নিশ্চিতও করতে পারে না। এ ব্যাপারে সর্বজনগ্রাহ্য একটি ব্যবস্থার প্রবর্তন প্রয়োজন। উল্লেখ্য, অস্ট্রেলিয়ার সরকার কয়েক বছর আগে তাদের আদিবাসীদের প্রতি সকল অবিচার এর জন্য ক্ষমা চেয়েছিল এবং তাদেরকে অস্ট্রেলীয় জাতীয়তাবাদ এর একটি বিশেষ অংশ হিসেবে বিশেষ মর্যাদা এবং অন্যান্য অস্ট্রেলীয়র মত সকল প্রকার সমান সুযোগ-সুবিধা দিয়ে পৃথিবীতে এক বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। এ থেকেও আমরা শিক্ষা নিতে পারি।
কিন্তু, কথা হলো- প্রসঙ্গটা তুলবে কে? এ বিষয়ে কথা বলতে গেলেই তো শুনতে হবে ধর্মের আফিমে জনগণকে বগলে রাখা দুই দলের খোড়ো যুক্তি- আমি দেশদ্রোহী কিংবা ভারতের দালাল!!!
[কৃতজ্ঞতাঃ এ লেখাটি আমার মৌলিক লেখা নয়, অনলাইন ও ব্লগ থেকে প্রাপ্ত তথ্যের আলোকে আমার মতামত।]