সকাল সাড়ে ৮টায় মহাখালী থেকে বাসে উঠলাম, গন্তব্য টাঙ্গাইল জেলার মধুপুর উপজেলার অন্তর্গত কালিয়াকুরি গ্রামের 'কালিয়াকুরি হেলথ কেয়ার সেন্টার'। উদ্দেশ্য, ৩০ বছর যাবৎ সেখানকার গরীব মানুষদেরকে প্রায় বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবা দিয়ে যাওয়া এক সাদা চামড়ার ডাক্তার, ডা. এড্রিক বেকার এর সাথে সাক্ষাত ও পত্রিকার জন্য তার সাক্ষাৎকার গ্রহণ। সঙ্গী দু'জন- ফ্রিলেন্সিং ফটো সাংবাদিক ফাহিম ফয়সাল ও জুনিয়র রিপোর্টার মির্জা জাম্মি আলম।
জ্যামের শহর ঢাকা ছেড়ে বের হতেই নামল বৃষ্টি। বাসের জানালা দিয়ে দূরের কালো মেঘের সাদা গর্জন দেখতে দেখতে ভাবতে লাগলাম এড্রিক বেকার কে নিয়ে। দেশ-সমাজ-পরিবার ফেলে, হাজার হাজার মাইল দূরের সম্পূর্ণ ভিন্ন এক পরিবেশে, চিকিৎসক পেশায় অর্থ উপার্যন ছেড়ে, নিঃস্বার্থভাবে গরীব মানুষদের সেবা করতে কিভাবে একজন মানুষ ৩০টি বছর ধরে পড়ে থাকতে পারে!!! ফ্রিলেন্সিং সাংবাদিকতায় জীবনের প্রথম কারও সাক্ষাৎকার নিতে যাচ্ছি, তাও আবার এমন মহামুভব একজন ব্যক্তির!!
ভাবতে ভাবতে চলে আসলাম মধুপুর। সেখান থেকে বেবি ট্যাক্সি নিয়ে যেতে হবে কালিয়াকুরি গ্রাম। প্রায় দেড় ঘন্টার যাত্রাপথ শেষে এসে পৌঁছলাম কালিয়াকুরিতে, মধুপুর গড় অঞ্চলের অনেক অনেক ভিতরের এক গ্রামে। একদম পাশেই কালিয়াকুরি হেলথ কেয়ার সেন্টারে ঢুকতেই দেখলাম মাটির ঘরের বারান্দায় বেশ কয়েকজন প্যারামেডিক্স ডাক্তার ও কম্পাউন্ডার বসে আছেন রোগীদের প্রাথমিক চিকিৎসা সেবা দিতে।
পরিচয় দেয়ার পর আমাদেরকে বসতে দেয়া হল, আপ্যায়নও করা হল এবং এই সৌজন্যের কোনটিই লোকদেখানো ছিল না। প্রত্যেকেই ছিলেন যথেষ্ট আন্তরিক।
ময়মনসিংহের একদল সাক্ষাৎকারীর সাথে ডাক্তার সাহেব এর সাক্ষাত সময় শেষ হতেই মিলল আমাদের কাংঙ্খিত সুযোগ। প্রথম দেখাতেই হাস্যোজ্জ্বল করমর্দন ও শুভেচ্ছা বিনিময়ে টিনি আমাদের মন কেড়ে নিলেন। তিনি ছিলেন যথেষ্ট কৌতুকপ্রিয় ও হাস্যরসে ভরপুর এক অমায়িক ব্যক্তি। গ্রামের মানুষের কাছে তিনি প্রিয় 'ডাক্তার ভাই'। পরিচয় পর্ব শেষ হতেই জিজ্ঞেস করলেন আমাদের আসার উদ্দেশ্য নিয়ে। শুরু হল আমার সাক্ষাতকার গ্রহণ পর্ব।
আমিঃ আপনি কেন এই কাজটাকে বেছে নিলেন?
ডাক্তারঃ দেখেন- সবার আলাদা আলাদা জীবন, ইতিহাস, মূল্যবোধ, উদ্দেশ্য আছে। আমরা সবাই মানুষ এবং অনেক জিনিসই আমাদের এক। আমার জীবনের ইতিহাসে যেই অভিজ্ঞতা পেয়েছি, যা দেখেছি, এমন একটি জায়গায় কাজ না করতে পারলে আমি মনে শান্তি পেতাম না। সবার তো এমন সুযোগ হয় না।
কেন আমি মনে করি এমন কাজ গুরুত্বপূর্ণ। একটা হল- সমাজের উদ্দেশ্য। একটা সমাজের মধ্যে একটা দল সব সুযোগ-সুবিধা পায় আর আরেকটি দল যদি সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়, তাহলে সেই সমাজের উন্নতি হয় না। অন্তত আমি সেই সমাজে চাই না। আবার ধরেন- ধর্মের কথা। ওটা আমাদের করতেই হবে, তাই আমরা করি। না করলে আমরা মনে শান্তিও পাই না, আবার শাস্তিও আছে। এটাও ওরকমই অবশ্য কর্তব্য একটি বিষয়। এইটা হল আরেকটা কারণ। আরেকটা হল মেডিক্যাল। আমি একজন মেডিক্যাল ডাক্তার। আমি যদি মেডিক্যাল কাজ না করি তাহলে আমার এই সব শিক্ষা হারিয়ে যাবে, শিক্ষার সার্থকতাও থাকবে না। যেখানে রোগী বেশি, সেখানে ডাক্তার বেশি প্রয়োজন, ওখানেই আমার যাওয়া প্রয়োজন, তাই না? মনে করেন- গুলশান, বারিধারায় কি অনেক মানুষ বাস করে না? করে। কিন্তু সেখানে তো ডাক্তারও বেশি। কিন্তু যেখানে ডাক্তারের সংখ্যা কম সেখানেই তো আমাকে বেশি প্রয়োজন। এরকম আরও আছে। আমি যা বলতে চাই- আসলে এমন জায়গা যেখানে ডাক্তারও নেই, ডাক্তারের কাছে যাওয়ার সামর্থ্যও নেই, সেখানেই আমাকে বেশি প্রয়োজন।
আমিঃ হ্যা! আমারও একটা জিনিস মনে হয়। একটা মানুষের এই পৃথিবীতে আসার সার্থকতা কোথায়? ধর্মের দিক থেকে প্রত্যেকেরই একটা গন্তব্য আছে। কিন্তু ধর্ম বিভেদে বাদে সকল মানুষের কথা যদি ধরি- তাহ্লে মানুষের জন্মের সার্থকতা আসলে সে তার পরবর্তী প্রজন্মের কি রেখে গেল, কি কাজ করে গেল তার উপর।
ডাক্তারঃ প্রত্যেক মানুষেরই কিছু আশা আছে। আবার কারও কিছু সার্থপরতা আছে, না? এখানে আমি তুলনা করি গ্রামের ডাক্তারের সাথে। গ্রামে দাই ও আছে আবার ডাক্তার ও আছে। গ্রামের দাই- সে কিছু কাজ শিখেছে। লোক যখন ডাকে, তাকে তখন যেতেই হবে, সে না করতে পারে না। কিন্তু গ্রামের ডাক্তারের কাছে রোগী আসলে সে চিকিৎসা দেবে, ওষুধ দেবে, যদি সে টাকা পায়। কিন্তু দাই এর তো যেতেই হবে, সে না করতে পারে না। এবং অনেকদিন আগে আমার এরকম ধারণা হয়ে গেল যে- আমাদের হয়ত মুসলমান-খৃষ্টান-হিন্দু ধর্ম আছে। এগুলোর সাথে আরেকটা ধর্মের মানুষ আছে- গ্রামের দাই রা। গ্রামের দাই এর ধর্মই হল- একটা ডাক পরলে তাকে যেতেই হবে। অনেক সময় আমি মনে করি- আমি এখানে আর থাকতে পারব না, আমার অসহ্য লাগে। কিন্তু আমি যেতে পারি না।
আমিঃ এখানে তো বেশ অনেক মানুষের বাস। এবং, তাদের চিকিৎসা বেশ খরচ সাপেক্ষ ব্যাপার। তো জানতে চাচ্ছি- আপনি এই খরচ চালান কিভাবে?
ডাক্তারঃ অনেক মানুষ বলতে কয়েকদিন আগে আমরা একটা হিসাব করে দেখলাম যে- ৩ বছরের মধ্যে ১ লাখ ২০ হাজার আউটডোর সেবা দিয়েছি আমরা। আর, ঐ ৩ বছরে ভর্তি রোগী ছিল ৪ হাজার। আর, টাকা-পয়সা কোত্থেকে আসে? (হাত পেতে দেখিয়ে) ভিক্ষা করে। রোগী থেকে আমরা তেমন কিছু পাই না। আমাদের সাহায্য আসে ২টা দেশ থেকে- নিউজিল্যান্ড এবং আমেরিকা। তবে আমি আশাবাদী যে, সামনের বছর থেকে আমাদের সাহায্য আসবে সমানভাবে ৩টা দেশ থেকে আর তৃতীয় দেশটি হল- বাংলাদেশ। সব দেশের রীতি, সমাজ তো এক না। সব দেশ একই রকম টাকা দিতেও পারে না। তবে, বাংলাদেশ তো আর আগের মত নেই। বাংলাদেশ এখন উন্নত হচ্ছে। বাংলাদেশও চাইলে এটার দেখাশোনা করতে পারে। এবং, আমি আশা করি- এটা বাংলাদেশীরাই চালাবে।
আর, আমার মনে হয়- বাংলাদেশের মানুষ দলগত ভাবে একটা কাজ ভাল করতে পারে, কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে তেমন পারে না। এই দেশে যে সমস্যা- বেশি টাকা দিতে কোন একজনের খুব ভয় লাগে। নিউজিল্যান্ডে আমার এক সাহায্যকারী আছে যে প্রতি বছর ৬৫ লাখ টাকা দেয়। সেজন্য আমরা ঠিক করেছি- বিভিন্ন জায়গায় মাটির ব্যাংক রাখব। যে যা পারে তাই দিবে। ধরেন- ১ জনে দিল ২০,০০০ টাকা আর ১০০০ জনে মাত্র ২০ টাকা করে দিলেই আমাদের ২০,০০০ টাকা উঠে গেল।
আমিঃ নিজ দেশ থেকে আপনি কিভাবে সাহায্য পান?
ডাক্তারঃ আমি একটা জিনিস মনে করি- এখানে আমরা যা করছি তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ৩ বছর আগে আমি আমার দেশে গিয়েছিলাম এবং আমি প্রায় ৮৪টা জায়গায় লেকচার দিয়েছিলাম, এটার জন্য অর্থ সংগ্রহ করতে। কিন্তু, আমি চিন্তা করছিলাম- আমার বিবেক কি সায় দিবে এটা করতে? কারণ- বাংলাদেশের চাইতেও অনেক দেশ বেশী গরীব আছে। আমাকে তো সেখানে দরকার। এটা তো হয় না। এবং, আমার যখন চলে যেতে হবে, সেসময় আমাকে যদি সবাই ভুলে আমি খুব সন্তুষ্ট হবে। কিন্তু এই জিনিস যদি বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে অনেক দুঃখের বিষয় হবে। সকল পরিশ্রম বৃথা যাবে। আমি চাই এই প্রতিষ্ঠান সম্পূর্ণভাবে বাংলাদেশীদের হাতে থাকবে, বাংলাদেশীদের অর্থায়নেই চলবে। এমন একজন থাকবে যে বিশেষভাবে এটাকে ভালবাসবে, যে বিশ্বাস করে- এমন কাজ না করলে তার মনে শান্তি আসবে না।
আমিঃ আপনার পরিবার আপনাকে এই কাজ সম্পর্কে কি বলেছে? তাদের সাথে যোগাযোগ কিভাবে হয়?
ডাক্তারঃ তারা বুঝেই নিয়েছে যে- এই মানুষকে বলে কিছু হবে না। আমি মাঝে মাঝে দেশে ফোন করি। আর, ৩ বছর পর পর দেশে যাই। এই বছর আমার যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু, রেখে যাওয়ার মত এখনও কোন এমবিবিএস ডাক্তার পাইনি বলে এখনও যাওয়া হচ্ছে না।
আমিঃ আপনি ঠিক এই জায়গায় কেন আসলেন? এই জায়গাটা কে কেন বেছে নিলেন?
ডাক্তারঃ আমি বুঝলাম যে- আমাকে গরীব সমাজের মধ্যে কাজ করতে হবে। এবং, আমি কয়েকটি কারণে বাংলাদেশকে বেছে নেই। আমার এরকম মনে হয়েছিল যে, আমি সমাজের মধ্যে কাজ করতে পারব না। আমি সেনাবাহিনীতে আসবার আগে আমি এত নিরাশ ছিলাম যে আমার হাসপাতালে বিশ্বাস ছিল না। একেবারে স্বাস্থ্য প্রোগ্রামে আগ্রহী হলাম। আমি মনে করলাম যে আমি গ্রামীণ অঞ্চলে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করব। এরপর যুদ্ধ দেখার পর আমার চিন্তা আরও পরিবর্তন হয়।
আমি ইংল্যান্ড থেকে বাংলাদেশে প্রথম এসেছিলাম মেহেরপুরে। আমি খুঁজতে লাগলাম কোথায় আমাকে বেশি দরকার। তখন সেখানকার মুক্তিযুদ্ধের একজন ইনচার্জ আমাকে এ জায়গার খোঁজ দেয়। এরপর এ জায়গা দেখে আমি সিদ্ধান্ত নেই যে- হ্যা, এখানেই আমাকে বেশি দরকার।
আমিঃ বাংলাদেশের কোন ব্যক্তি কিংবা প্রতিষ্ঠান কিংবা এনজিও আপনা্কে সাহায্য করতে এসেছিল কি?
ডাক্তারঃ এই কিছুদিন আগে ‘মাটি’ নামে একটি এনজিও আমাদের সাথে সংযুক্ত হয়েছে।
ফাহিমঃ আসলে সমস্যা হল- আমাদের দেশে এমবিবিএস পড়তে পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থার তুলনায় খরচ এত বেশি যায় যে কারও পক্ষে সম্ভব হয় না পরিবারকে অর্থ সহায়তা ফেলে এসে বিনা পয়সায় চিকিৎসা করানোর। এমন চিকিৎসকের পক্ষেই এটা সম্ভব- যার পরিবারকে ভরণ-পোষণ নিয়ে কোন চিন্তা নেই এবং স্বেচ্ছায় গরীবদের সেবা দিতেই খুব আগ্রহী।
ডাক্তারঃ হ্যা! আমি সেটা বুঝি। এজন্যই ডাক্তার পেতে আমাদের এত দেরি হচ্ছে। এমন একজনকে প্রয়োজন যে একদম নিবেদিত প্রাণ হবে গরীবদের জন্য। যে মনে করবে এটা তার দায়িত্ব, এটা তাকে করতেই হবে। আর, বাংলাদেশীদের এগিয়ে আসতে হবে। কারণ, এটা তাদের নিজেদের জিনিস।
এরপর সহকারী মোজাম্মেল ভাই আমাদেরকে ইনডোর বাড়িগুলো ঘুরিয়ে দেখালেন। কাছাকাছির মধ্যে এখান থেকে ২০ কি.মি. দূরে মধুপুরে একটি এবং ১৫ কি.মি. দূরে কেন্দুয়া তে একটি হাসপাতাল আছে। আর, এই হাসপাতাল অত্র অঞ্চলের ১৭টা গ্রামে মেডিক্যাল সেবা দিয়ে যাচ্ছে। তিনি আমাদেরকে জানালেন যে, প্রতিদিন গড়ে ৩৫-৪২ জন রোগী এখানে আউটডোর সুবিধা নেয়। ডাক্তার ভাই তার সহযোগিতার জন্য এখানে প্রায় ১৭ জন কে চিকিৎসা সেবা শিখিয়ে প্যারামেডিক্স ডাক্তার করেছেন। রোগীর চিকিৎসাপত্রে খরচ ৫-১০ টাকা, অতি গরীবদের জন্য বিনা পয়সায় চিকিৎসা।
প্রতিদিনের রোগী আসা ছাড়াও অত্র প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রমের আওতায় প্রতি সপ্তাহে এই ১৭টি গ্রামে সার্ভে করা হয়, বিশেষত মা ও শিশুদের। তবে, এখানে ডায়াবেটিস এর রোগীর সংখ্যাই বেশি এবং তা প্রায় ১৮০০ এর মত।
তারা আমাদেরকে থেকে যাওয়ার অনুরোধ করলেন। কিন্তু, আমরা ডাক্তার ভাই এর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে আসলাম আবার আসব বলে। ফিরতে ফিরতে ভাবতে লাগলাম- একজন ভিনদেশী মানুষ যেখানে এতটা পথ এগিয়েছেন, আমরা কি পারিনা নিজেদের দেশকে নিজেরাই আরেকটু এগিয়ে নিতে। আমাদের মাঝে ডাক্তার এড্রিক বেকার এর মত একজন মহতী নিবেদিত প্রাণ আসবে না? নাকি এড্রিক বেকার এর ৩০ বছরের স্বপ্ন-শ্রম সব বৃথা যাবে
বিঃদ্রঃ এই ব্লগ তথা প্রতিবেদন টি অনলাইন পত্রিকা ডেইলিদর্পন এ ৩রা জুন, ২০১৪ তে প্রকাশিত হয়েছে।
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা জুন, ২০১৪ রাত ১:১৯