"উত্তম-সুচিত্রা'র চর্চা থেকে দূরে বলেই আমাদের এসময়ের অভিনেতা-অভিনেত্রীরা অভিনয়ে নিজেদের নামকে অনন্য উচ্চতায় পৌঁছতে ব্যর্থ হচ্ছে।"
-- বাংলাদেশ শিল্পকলা একডামীতে সুচিত্রা সেন স্মরণে উত্তম কুমার ও সুচিত্রা সেন অভিনীত ১০টি চলচ্চিত্র নিয়ে শুরু হওয়া ১০ দিন ব্যাপী চলচ্চিত্র প্রদর্শনী 'এ ট্রিবিউট টু সুচিত্রা সেন' এর উদ্বোধনী দিনে তাদের অভিনীত "শিল্পী" চলচ্চিত্রটি দেখার পর মন্তব্যটি করেছেন দার্শনিক। ( এই দার্শনিককে আপনারা সবাই-ই চিনেন )
কথাটি হেলায় ফেলে দেয়ার জন্য নয়।
(এ যুগের) আমরা বাপ-চাচাদের মুখে আর ইলেকট্রনিক মিডিয়ার বার্ষিক বিশেষ প্রতিবেদনে পাই বহুল বিখ্যাত আর স্বল্প আলোচিত উত্তম কুমার ও সুচিত্রা সেনের পরিচয়। কিন্তু, আমাদের মুভিপাগলদেরই বা কজন এমন আগ্রহবোধ করেছি যে, বাংলার চলচ্চিত্র ইতিহাসের এমন দুজন লিজেন্ডের লিজেন্ড হয়ে ওঠার সেইসব কালজয়ী চলচ্চিত্রগুলো দেখব কিংবা তাদের লিজেন্ডারিকে গ্রহণ করব; আর সাধারণজনদের কথা বাদই দিলাম।
অনেকদিন আগে একবার মন্তব্য করেছিলাম, "সাহিত্যের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়ার পর থেকেই আমাদের চলচ্চিত্রের গল্পগুলো আর জীবন্ত হয়ে উঠছে না।"
হবে কি করে বলেন- এখন তো ফিল্মে লিখেই দেয়া থাকেঃ 'এই ছবির কাহিনী সম্পূর্ণ কাল্পনিক। এর ঘটনা বা চরিত্রের সাথে বাস্তবের কারও মিল হলে তা সম্পূর্ণই কাকতালীয়।' !!
মানে-গল্পগুলোই এখন আর জীবন থেকে নেয়া না। তা সেটা আপনার-আমার জীবনের সাথে না মিললে কি করে জীবন্ত জীবন্ত লাগবে বলেন তো! তারপরেও আছে- আমাদের সেই 'কাল্পনিক' এর অবস্থা দেখলে তো আরও অবাক হতে হয়! কিভাবে যেন আমাদের কল্পনাগুলো ভিনদেশী নির্মাতাদের সাথে মিলে যায়! কি অদ্ভুত!!! নিন্দুকেরা আবার সেটাকে 'স্ক্রিপ্ট নকল' বলে গাল দিয়ে থাকেন!
দেখে এলাম "শিল্পী"। অসাধারণ একটি গল্পে খাদহীন অভিনয়- এমন অভিনয় বুঝি শূধু উত্তম-সুচিত্রা'র পক্ষেই সম্ভব। বিশেষ করে- ডায়লগ থ্রোয়িং। বহু জায়গায় এমন সাহিত্যিক কিছু উদ্ধৃতি ছিল, এমন প্রাঞ্জল কিছু ডায়লগ ছিল যে অনেকের পক্ষেই এমন ডায়লগ থ্রোয়িং স্বাভাবিকভাবে করা প্রায় অসম্ভব। এক্ষেত্রে মনে পড়ছে আমাদের দেশের দুই লিজেন্ড রাজ্জাক ও শাবানা অভিনীত 'অবুঝ মন' মুভিটির কথা। রাজ্জাক-শাবানা উভয়ই অসাধারণ গুনী শিল্পী, তাদের অভিনয় মুগ্ধ করে রাখে। কিন্তু প্রথম দিকের বলেই হোক আর যেকারণেই হোক 'অবুঝ মন' চলচ্চিত্রে তাদের ডায়লগ থ্রোয়িং এ যে ন্যাকামি ভাব চলে এসেছিল, তা হয়ত তারাও স্বীকার করবেন এবং একারণেই সে চলচ্চিত্রটি শৈল্পিক মানও হারিয়েছে। রাজ্জাক-শাবানা'র অভিনীত এমন চলচ্চিত্র দেখে আমি হতাশই। তবে আশার কথা যে, 'অবুঝ মন' বাদে তাদের অভিনীত আর কোন চলচ্চিত্রে আমি এখন পর্যন্ত তা পাইনি।
বলছিলাম- 'শিল্পী' চলচ্চিত্রে উত্তম-সুচিত্রা'র ডায়লগ থ্রোয়িং এর কথা। তাদের বাচনভঙ্গি এত সুন্দর ছিল, তারা সেসব কাব্যিক ডায়লগও এমন সহজ-সাধারণভাবে বলেছেন যে তা হয়ে উঠেছে অনন্যসাধারণ। হয়ে উঠেছে মনের ভাষা, যে ভাষা আমাদের হৃদয়ে প্রতিদিন কাব্যিকতায় জন্ম নেয়, হয়ত তা কাব্যে প্রকাশে আমরা ব্যর্থ হই অথচ সেগুলোই কি সাবলীলভাবে বলে যাচ্ছেন এ দুজন।
এমন চলচ্চিত্রই জীবন্ত- যে চলচ্চিত্র দেখে দর্শকের মনে হবে এ তো আমারই ভাবনা, এ তো আমারই গল্প আর আমার মত চলচ্চিত্র নির্মাতা হবার স্বপ্নবাজদের উৎসাহ দিবে- এমন জীবনের গল্প নিয়েই তো আমিও চলচ্চিত্র নির্মাণ করব।