somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কিছু প্রিয় বইয়ের রিভিউ ০৭ঃ ক্রাচের কর্নেল

২৫ শে নভেম্বর, ২০১৫ রাত ২:০২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



বইয়ের নাম: ক্রাচের কর্নেল
লেখক: শাহাদুজ্জামান
প্রকাশনী: মাওলা ব্রাদার্স

কত বই-ই তো পড়ি ... পাতার পর পাতা উল্টে যাই দ্রুত, বই শেষ হলে রেখে দেই শেলফে । তারপর একসময় ভুলেও যাই । কিন্তু কিছু বই পড়ার সময় বারবার থামতে হয়, খোলা জানলা দিয়ে বাইরের আকাশের দিকে চোখ চলে যায় একটু পরপর । বইয়ের পাতায় শব্দেরা যে গল্প শোনাচ্ছে তা অবিশ্বাস্য ঠেকে । মনে হয়- এমন অদ্ভুত সময়ও পার করেছে আমার দেশ!

দ্রুত পড়তে মন সাড়া দেয় না, ইচ্ছে হয় বইটা শেষ না করি । শেষ করলে তো শেষই হয়ে গেলো । কিছু বই আসলে সমাপ্তি ডিজার্ভ করে না, ডিজার্ভ করে আত্নীকরণ, নিজের মধ্যে ধারণ করা । ক্রাচের কর্নেল এমনই এক বই ।

মুক্তিযুদ্ধ এবং যুদ্ধ পরবর্তী দুই দশকের ইতিহাসের উপর ভিত্তি করে রচিত বই পড়ার মধ্যে বেশ বিপদ আছে । অধিকাংশ লেখকই যেহেতু আওয়ামী লীগ আর বিএনপি এই দুই রাজনৈতিক মতবাদে বিভক্ত, তাদের লেখায় তারা দলীয় ইতিহাসটাই তুলে ধরেন । এজন্যে কোন বইয়ে বঙ্গবন্ধুর সাত-ই মার্চের ভাষণই স্বাধীনতার ঘোষনা এবং যুদ্ধে মেজর জিয়ার কোন ভূমিকাই নেই । আবার কোন বইয়ে মেজর জিয়া মহানায়ক, স্বাধীনতার ঘোষক আর বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানে কারাবরণ করে আছেন আইওয়াশ হিসেবে । সেই সময়টায় আর যুদ্ধ পরবর্তী কয়েক বছরের টালমাটাল সময়ে দেশে আসলেই কি ঘটেছিলো তা সম্ভবত যারা ঐ সময়টাতে জীবিত ছিলেন তারাই জানেন, আমরা পরবর্তী প্রজন্ম তা কখনোই সেভাবে বুঝতে পারবো না । আর সামনের বিশ - ত্রিশ বছর পর প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মেই দেশে মুক্তিযোদ্ধারা যখন আর জীবিত থাকবেন না, ইতিহাস বিকৃত হবে আরও ভয়ংকর ভাবে ।

এতো সমস্যার পরও কিছু উৎস থাকে যা তুলনামূলক বিশ্বাসযোগ্য । " ক্রাচের কর্নেল " - এর লেখক শাহাদুজ্জামান আমার কাছে তেমনই একজন । লেখক কর্নেল তাহেরের জীবনের আবহে তৃতীয় দৃষ্টিতে তুলে এনেছেন মুক্তিযুদ্ধের গল্প, মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী জাদুর মতো এক সময়ের গল্প ।

কর্নেল তাহেরকে আমার মনে হয়েছে একজন বিপদপ্রেমী মানুষ, যিনি বিপদকে ভয় পাওয়া তো দূরে থাকুক, ভালোবাসেন । সেজন্যে পাকিস্তান আমলেই কোর্ট মার্শালের ভয় উপেক্ষা করে দেশে তরুনদের যুদ্ধের প্রশিক্ষণ দিয়ে গেছেন, প্রস্তুত করেছেন বিপ্লবের জন্যে । যুদ্ধ শুরু হলে ক্যান্টনমেন্ট থেকে পালিয়ে চলে এসেছেন নিজের দেশের পক্ষে লড়তে, কাঁধে তুলে নিয়েছেন সেক্টর কমান্ডারের দায়িত্ব । তার মা, সব ভাই - বোনেরা তার নেতৃত্বে পাশাপাশি অংশ নিয়েছেন তার সব কাজে, সম্মুখ যুদ্ধে একসাথে চালিয়েছেন স্টেনগান । আর শক্তির পেছনের রুধির ধারার মতো তাহেরকে সবসময় উৎসাহ - প্রেরণা যুগিয়েছেন তার অসামান্যা স্ত্রী লুৎফা ..... অদ্ভুত এক পরিবার । পরিবারের একেক সদস্য একেক রকম, কিন্তু দেশের জন্যে সবাই নিবেদিত প্রাণ। কর্নেল তাহের পরিবারের নিউক্লিয়াস, তাকে ঘিরে আবর্তিত সবাই । তাহের যেন রুপকথার পাতা থেকে উঠে আসা দুর্ধর্ষ এক নাইট । একই সাথে তিনি প্রেমিক এবং স্বপ্নবাজ বিপ্লবীও । হৃদয়বান, সাহসিকতা, বোকামী, জটিলতা এবং সারল্যের মিশ্রণে তৈরি তার চরিত্র ব্যাখ্যা করে বোঝানো দুষ্কর । তাহেরের মতো মানুষ ইতিহাসে দুই-একবারই আসে ... আসে, এবং বদলে দিয়ে যায় স্বয়ং ইতিহাসকেই ।

তাহের ছাড়াও বইয়ের পাতায় পাতায় নিজস্ব ক্যারিশমা নিয়ে আছেন দেশের ইতিহাসের মহারথীরা - মুজিব, জিয়া, সিরাজ শিকদার, তাজউদ্দীন, ভাসানী, খন্দকার মোশতাক, ডালিম, ফারুক, খালেদ মোশারফ, এ.কে খন্দকার, শাফায়েত জামিল, তাহেরের চার ভাই সহ আরও অনেকে । বইটা পরিচিত এসব চরিত্রের অনেকের ব্যাপারেই আমাদের ধারণা বদলে দেবে । লেখক শেখ মুজিবের চরিত্রকে উপস্থাপন করেছেন নির্মোহভাবে । তুলে এনেছেন মুদ্রার দুই পিঠ-ই, লিখেছেন মানব দেবতার উত্থান এবং পতনের পেছনের কথা । আর মেজর জিয়ার শীতলতা, নিস্পৃহতা, ব্যক্তিত্ব, অসম্ভব ধী শক্তি আর নিষ্ঠুরতা পাঠককে বিহ্বল করে দেবে ।

লেখক শাহাদুজ্জামানের ব্যাপারে কিছু বলাই বাহুল্য । তার প্রতি মুগ্ধতা প্রকাশের মতো উপযুক্ত বিশেষণ আমার জানা নেই । তার লেখা যেকোন বই চোখ বন্ধ করে হাতে তুলে নেয়া যায় । আর ক্রাচের কর্নেল তার অন্যতম উল্লেখযোগ্য কাজ । ক্রাচের কর্নেল এমনই এক বই যা আমার বিশ্বাস যুগ যুগ ধরে মানুষকে মুগ্ধ করে যাবে, প্রেরণা যোগাবে । কিছু বই না পড়লে আসলে পাঠকত্বই বোধহয় আসে না । বইটা আমাদের সবার পড়া উচিত, নিজের দেশকে জানার জন্যে, আমাদের শেঁকড়ের ইতিহাস জানার জন্যে ।

এ বইয়ের প্রধান সমালোচনাগুলোর মধ্যে আমার কাছে যেটা বেশী দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে তা হল লেখক এখানে নির্মোহ ভাবে তাহের কে উপস্থাপন করেন নি , তাহেরকে তিনি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত মহামানব হিসেবেই দেখিয়েছেন, ব্যক্তি তাহেরের নানা দোষ - ত্রুটি তুলে আনতে আগ্রহ দেখান নি । কথা সত্যি । তবে এই পক্ষপাতদুষ্টতার জন্যই " ক্রাচের কর্নেল " কে আমার কাছে বেশী ভালো লেগেছে , মানবিক মনে হয়েছে । বাদবাকি সমালোচনার বেশীরভাগই মনে হয়েছে সমালোচকদের জ্ঞান ফলানোর প্রচেষ্টা, নিজেকে অতি উৎকৃষ্ট পাঠক প্রমাণের এজেণ্ডা । সৃষ্টিশীলতার চেয়ে সমালোচনা বরাবরই সহজ কাজ ছিল , আছে , থাকবেও ।

থাকুক সেসব ..... নাগর দোলায় চেপে বসা এ জনপদের ঘোর লাগা অদ্ভুততম সময়ের এ বাস্তব গল্প যারা এখনও পড়েন নি, তাদের নিমন্ত্রণ ।

আমার রেটিং: ৫/৫ . কোন আবেগী রেটিং নয়, ঠান্ডা মাথায় ভেবে দেওয়া । নম্বারের বেঁড়াজালে বইয়ের মান বুঝিয়ে ফেলতে চাওয়ার চেষ্টাটাই যদিও আমার খুব একটা পছন্দ না, তবুও পাঠকের স্বার্থেই দেয়া .... এবং আমার মুগ্ধতা প্রকাশের ব্যর্থ চেষ্টা স্বরুপও।

হ্যাপি রিডিং এন্ড অ্যাবজর্বিং :-)
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে নভেম্বর, ২০১৫ রাত ২:০৩
১৬টি মন্তব্য ১৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

পার্বত্য চট্টগ্রাম- মিয়ানমার-মিজোরাম ও মনিপুর রাজ্য মিলে খ্রিস্টান রাষ্ট্র গঠনের চক্রান্ত চলছে?

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:০১


মিজোরামের মুখ্যমন্ত্রী লালদুহোমা সেপ্টেম্বর মাসে আমেরিকা ভ্রমণ করেছেন । সেখানে তিনি ইন্ডিয়ানা তে বক্তব্য প্রদান কালে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী chin-kuki-zo দের জন্য আলাদা রাষ্ট্র গঠনে আমেরিকার সাহায্য চেয়েছেন।... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাসান মাহমুদ গর্ত থেকে বের হয়েছে

লিখেছেন শিশির খান ১৪, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ১১:১২


যুক্তরাষ্ট্রের একটি বাংলা টেলিভিশন চ্যানেল হাসান মাহমুদের সাক্ষাৎকার প্রচার করেছে। আমি ভাবতেও পারি নাই উনি এতো তারাতারি গর্ত থেকে বের হয়ে আসবে। এই লোকের কথা শুনলে আমার গায়ের লোম... ...বাকিটুকু পড়ুন

দারিদ্রতা দূরীকরণে যাকাতের তাৎপর্য কতটুকু?

লিখেছেন রাজীব নুর, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ১১:১৮



দরিদ্র দূরীকরণে যাকাতের কোনো ভূমিকা নেই।
যাকাত দিয়ে দারিদ্রতা দূর করা যায় না। যাকাত বহু বছর আগের সিস্টেম। এই সিস্টেম আজকের আধুনিক যুগে কাজ করবে না। বিশ্ব অনেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

শেখস্তান.....

লিখেছেন জুল ভার্ন, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১২:১৫

শেখস্তান.....

বহু বছর পর সম্প্রতি ঢাকা-পিরোজপু সড়ক পথে যাতায়াত করেছিলাম। গোপালগঞ্জ- টুংগীপাড়া এবং সংলগ্ন উপজেলা/ থানা- কোটালিপাড়া, কাশিয়ানী, মকসুদপুর অতিক্রম করার সময় সড়কের দুইপাশে শুধু শেখ পরিবারের নামে বিভিন্ন স্থাপনা দেখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের বিয়ের খাওয়া

লিখেছেন প্রামানিক, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ২:৪৮


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

১৯৬৮ সালের ঘটনা। বর আমার দূর সম্পর্কের ফুফাতো ভাই। নাম মোঃ মোফাত আলী। তার বিয়েটা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল। বাবা ছিলেন সেই বিয়ের মাতব্বর।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×