বইয়ের নাম: ক্রাচের কর্নেল
লেখক: শাহাদুজ্জামান
প্রকাশনী: মাওলা ব্রাদার্স
কত বই-ই তো পড়ি ... পাতার পর পাতা উল্টে যাই দ্রুত, বই শেষ হলে রেখে দেই শেলফে । তারপর একসময় ভুলেও যাই । কিন্তু কিছু বই পড়ার সময় বারবার থামতে হয়, খোলা জানলা দিয়ে বাইরের আকাশের দিকে চোখ চলে যায় একটু পরপর । বইয়ের পাতায় শব্দেরা যে গল্প শোনাচ্ছে তা অবিশ্বাস্য ঠেকে । মনে হয়- এমন অদ্ভুত সময়ও পার করেছে আমার দেশ!
দ্রুত পড়তে মন সাড়া দেয় না, ইচ্ছে হয় বইটা শেষ না করি । শেষ করলে তো শেষই হয়ে গেলো । কিছু বই আসলে সমাপ্তি ডিজার্ভ করে না, ডিজার্ভ করে আত্নীকরণ, নিজের মধ্যে ধারণ করা । ক্রাচের কর্নেল এমনই এক বই ।
মুক্তিযুদ্ধ এবং যুদ্ধ পরবর্তী দুই দশকের ইতিহাসের উপর ভিত্তি করে রচিত বই পড়ার মধ্যে বেশ বিপদ আছে । অধিকাংশ লেখকই যেহেতু আওয়ামী লীগ আর বিএনপি এই দুই রাজনৈতিক মতবাদে বিভক্ত, তাদের লেখায় তারা দলীয় ইতিহাসটাই তুলে ধরেন । এজন্যে কোন বইয়ে বঙ্গবন্ধুর সাত-ই মার্চের ভাষণই স্বাধীনতার ঘোষনা এবং যুদ্ধে মেজর জিয়ার কোন ভূমিকাই নেই । আবার কোন বইয়ে মেজর জিয়া মহানায়ক, স্বাধীনতার ঘোষক আর বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানে কারাবরণ করে আছেন আইওয়াশ হিসেবে । সেই সময়টায় আর যুদ্ধ পরবর্তী কয়েক বছরের টালমাটাল সময়ে দেশে আসলেই কি ঘটেছিলো তা সম্ভবত যারা ঐ সময়টাতে জীবিত ছিলেন তারাই জানেন, আমরা পরবর্তী প্রজন্ম তা কখনোই সেভাবে বুঝতে পারবো না । আর সামনের বিশ - ত্রিশ বছর পর প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মেই দেশে মুক্তিযোদ্ধারা যখন আর জীবিত থাকবেন না, ইতিহাস বিকৃত হবে আরও ভয়ংকর ভাবে ।
এতো সমস্যার পরও কিছু উৎস থাকে যা তুলনামূলক বিশ্বাসযোগ্য । " ক্রাচের কর্নেল " - এর লেখক শাহাদুজ্জামান আমার কাছে তেমনই একজন । লেখক কর্নেল তাহেরের জীবনের আবহে তৃতীয় দৃষ্টিতে তুলে এনেছেন মুক্তিযুদ্ধের গল্প, মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী জাদুর মতো এক সময়ের গল্প ।
কর্নেল তাহেরকে আমার মনে হয়েছে একজন বিপদপ্রেমী মানুষ, যিনি বিপদকে ভয় পাওয়া তো দূরে থাকুক, ভালোবাসেন । সেজন্যে পাকিস্তান আমলেই কোর্ট মার্শালের ভয় উপেক্ষা করে দেশে তরুনদের যুদ্ধের প্রশিক্ষণ দিয়ে গেছেন, প্রস্তুত করেছেন বিপ্লবের জন্যে । যুদ্ধ শুরু হলে ক্যান্টনমেন্ট থেকে পালিয়ে চলে এসেছেন নিজের দেশের পক্ষে লড়তে, কাঁধে তুলে নিয়েছেন সেক্টর কমান্ডারের দায়িত্ব । তার মা, সব ভাই - বোনেরা তার নেতৃত্বে পাশাপাশি অংশ নিয়েছেন তার সব কাজে, সম্মুখ যুদ্ধে একসাথে চালিয়েছেন স্টেনগান । আর শক্তির পেছনের রুধির ধারার মতো তাহেরকে সবসময় উৎসাহ - প্রেরণা যুগিয়েছেন তার অসামান্যা স্ত্রী লুৎফা ..... অদ্ভুত এক পরিবার । পরিবারের একেক সদস্য একেক রকম, কিন্তু দেশের জন্যে সবাই নিবেদিত প্রাণ। কর্নেল তাহের পরিবারের নিউক্লিয়াস, তাকে ঘিরে আবর্তিত সবাই । তাহের যেন রুপকথার পাতা থেকে উঠে আসা দুর্ধর্ষ এক নাইট । একই সাথে তিনি প্রেমিক এবং স্বপ্নবাজ বিপ্লবীও । হৃদয়বান, সাহসিকতা, বোকামী, জটিলতা এবং সারল্যের মিশ্রণে তৈরি তার চরিত্র ব্যাখ্যা করে বোঝানো দুষ্কর । তাহেরের মতো মানুষ ইতিহাসে দুই-একবারই আসে ... আসে, এবং বদলে দিয়ে যায় স্বয়ং ইতিহাসকেই ।
তাহের ছাড়াও বইয়ের পাতায় পাতায় নিজস্ব ক্যারিশমা নিয়ে আছেন দেশের ইতিহাসের মহারথীরা - মুজিব, জিয়া, সিরাজ শিকদার, তাজউদ্দীন, ভাসানী, খন্দকার মোশতাক, ডালিম, ফারুক, খালেদ মোশারফ, এ.কে খন্দকার, শাফায়েত জামিল, তাহেরের চার ভাই সহ আরও অনেকে । বইটা পরিচিত এসব চরিত্রের অনেকের ব্যাপারেই আমাদের ধারণা বদলে দেবে । লেখক শেখ মুজিবের চরিত্রকে উপস্থাপন করেছেন নির্মোহভাবে । তুলে এনেছেন মুদ্রার দুই পিঠ-ই, লিখেছেন মানব দেবতার উত্থান এবং পতনের পেছনের কথা । আর মেজর জিয়ার শীতলতা, নিস্পৃহতা, ব্যক্তিত্ব, অসম্ভব ধী শক্তি আর নিষ্ঠুরতা পাঠককে বিহ্বল করে দেবে ।
লেখক শাহাদুজ্জামানের ব্যাপারে কিছু বলাই বাহুল্য । তার প্রতি মুগ্ধতা প্রকাশের মতো উপযুক্ত বিশেষণ আমার জানা নেই । তার লেখা যেকোন বই চোখ বন্ধ করে হাতে তুলে নেয়া যায় । আর ক্রাচের কর্নেল তার অন্যতম উল্লেখযোগ্য কাজ । ক্রাচের কর্নেল এমনই এক বই যা আমার বিশ্বাস যুগ যুগ ধরে মানুষকে মুগ্ধ করে যাবে, প্রেরণা যোগাবে । কিছু বই না পড়লে আসলে পাঠকত্বই বোধহয় আসে না । বইটা আমাদের সবার পড়া উচিত, নিজের দেশকে জানার জন্যে, আমাদের শেঁকড়ের ইতিহাস জানার জন্যে ।
এ বইয়ের প্রধান সমালোচনাগুলোর মধ্যে আমার কাছে যেটা বেশী দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে তা হল লেখক এখানে নির্মোহ ভাবে তাহের কে উপস্থাপন করেন নি , তাহেরকে তিনি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত মহামানব হিসেবেই দেখিয়েছেন, ব্যক্তি তাহেরের নানা দোষ - ত্রুটি তুলে আনতে আগ্রহ দেখান নি । কথা সত্যি । তবে এই পক্ষপাতদুষ্টতার জন্যই " ক্রাচের কর্নেল " কে আমার কাছে বেশী ভালো লেগেছে , মানবিক মনে হয়েছে । বাদবাকি সমালোচনার বেশীরভাগই মনে হয়েছে সমালোচকদের জ্ঞান ফলানোর প্রচেষ্টা, নিজেকে অতি উৎকৃষ্ট পাঠক প্রমাণের এজেণ্ডা । সৃষ্টিশীলতার চেয়ে সমালোচনা বরাবরই সহজ কাজ ছিল , আছে , থাকবেও ।
থাকুক সেসব ..... নাগর দোলায় চেপে বসা এ জনপদের ঘোর লাগা অদ্ভুততম সময়ের এ বাস্তব গল্প যারা এখনও পড়েন নি, তাদের নিমন্ত্রণ ।
আমার রেটিং: ৫/৫ . কোন আবেগী রেটিং নয়, ঠান্ডা মাথায় ভেবে দেওয়া । নম্বারের বেঁড়াজালে বইয়ের মান বুঝিয়ে ফেলতে চাওয়ার চেষ্টাটাই যদিও আমার খুব একটা পছন্দ না, তবুও পাঠকের স্বার্থেই দেয়া .... এবং আমার মুগ্ধতা প্রকাশের ব্যর্থ চেষ্টা স্বরুপও।
হ্যাপি রিডিং এন্ড অ্যাবজর্বিং :-)
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে নভেম্বর, ২০১৫ রাত ২:০৩