আমাদের একজন আলম কাকা ছিলেন। আমাদের শৈশবের ফুটবল কোচ। যে যুগে আমরা টিভিতে স্কলারিকে দেখে ফুটবল খেলা শিখছি, সে যুগে আলম কাকা আমাদের দলে আর্শিবাদস্বরুপ কোচ হয়ে আসলেন...
ভোরে ঘুম থেকে উঠা, ব্যায়াম করা, সকাল-বিকাল ফুটবল প্রাকটিস ইত্যাদি, ইত্যাদি ভালো প্লেয়ারের লক্ষণ নিয়ে আমাদের এগিয়ে নিতে থাকলেন...
আমরা প্রতিদিন ফুটবল ম্যাচ শুরুর আগেও ওয়ার্মআপ করতাম।
মাঠের এই প্রান্তর থেকে ওই প্রান্তরে দৌড়...
হাঁটা।
সবাই গোলাকার হয়ে পাসিং দেওয়া-নেওয়া...
পেনাল্টি শর্ট নেওয়া...
৩ জন প্লেয়ারকে কীভাবে বিট করা যায় তার টেকনিক শেখানো (যদিও আমরা সফল হতাম না ম্যাচে)...
হেডিং প্রাকটিস ইত্যাদি...
আলম কাকার চোখে যে প্রাকটিসটা বেষ্ট মনে হতো, সেই প্রাকটিসের একটা উদাহরণও দিয়ে ফেলতেন।
আর বলতেন, অমুক সালে তমুক প্লেয়ার এমন শর্ট নিয়েই দলকে জিতিয়েছিলেন, একদম সেম টু সেম হয়েছে। আমি মুগ্ধ, তুরা পারবিই...
একবার আমি ভুল করে প্রাকটিসে বল হেড দিয়ে জালের কোণায় পাঠিয়ে দিলাম, যদিও তখন জাল ছিলো না, দুই কোণায় দুইটা স্যান্ডেল দিয়ে বার বানাতাম...
আলম কাকা ৩০ সেকেন্ডের মত চুপ থেকে ইতিহাসের ঝুলি হতে একটা হেডিং ইতিহাস বের করে নিয়ে আসলেন...
বললেন, ১৯৯৮ বিশ্বকাপে ব্রাজিলের লিমা রোনাল্ডো এরকমই একটা হেড দিয়ে গোল করেছিলো। একদম সেম টু সেম হয়েছে...
আলম কাকার এমন ইতিহাসে আমাদের কনফিডেন্স লেভেল দ্বিগুণ হয়ে যেতো, আমরা প্রত্যেকেই হয়ে যেতাম কেউ কেউ লিমা রোনাল্ডো, কেউ ম্যারাডোনা, কেউ বা পেলে...
কিন্তু বিপত্তি বাঁধতো ম্যাচ হারারপর। বিপক্ষ দলের সাথে গো হারা হারারপর আমাদের কনফিডেন্স লেভেল পৌছে যেতো শূণ্যের কৌঠায়...
আমরা পড়ে যেতাম হতাশায়।
পুরো ফুটবল মাঠ হয়ে যেতো অন্ধকারে আচ্ছন্ন।
কেউ মাঠে শুয়ে থাকতাম, কেউ বা বসে থাকতাম...
মনে হত, আমরা বিশ্বকাপ থেকে ছিটকে পড়েছি...
ম্যাচ হারারপর প্রতিবারই আলম কাকা একটাই কথা বলতেন, সমস্যা নেই, আগামীবার হয়ে যাবে, প্রাকটিস করতে হবে বেশি বেশি করে...
আমরা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে আলম কাকার এই বাণী শুনতাম। বাণীর মাঝে কেউই কথা বলতে পারতাম না, বললেই 'চেক দে ইন্ডিয়া'র কোচ শাহরুখের মত শাস্তির ব্যবস্থা রাখতেন...
সেই ভয়ে আমরা চুপসে যেতাম...
একবার মিথুন বাণীর মাঝে কথা বলেছিলো, আলম কাকা বললেন, এইটাতো বেয়াদবি। আমার সাথে বেয়াদবি করা মানে, ফুটবলের সাথে বেয়াদবি করা। আমি এই বেয়াদবি মেনে নিলেও ফুটবলতো মেনে নেবে না, তাই মিথুনকে ২ ম্যাচের জন্য নিষিদ্ধ করেছিলো আলম কাকা...
তখন আমাদের মাঠ বলতে ওই একটাই। আলম কাকাই ছিলেন ওই জায়গার কেয়ারটেকার। তাই বাধ্য হয়ে শাস্তি মেনে নেওয়া লাগতো...
অনেকদিনপর আজ আমার শৈশবের সেই মাঠ দেখতে গেলাম।
দেখলাম, সেখানে জাহাজের অবকাঠামোর সরঞ্জাম। পরে কাউকে জিজ্ঞেস করে শুনলাম, একটা জাহাজ কোম্পানী সেই জায়গাটি কিনে, জাহাজ সরঞ্জামের কারখানা তৈরি করেছে...
জাহাজ কোম্পানীর বাইরে দেখলাম, একটা টং দোকান। সেই দোকানে বসে আছেন, আমাদের শৈশবের কোচ লুইস ফিলেপে স্কলারি আলম কাকা...
নয়ন বড়ুয়া
জুন, ২০২২
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে জানুয়ারি, ২০২৪ রাত ১১:০৮