আমাদের মত শিক্ষিত বলে কথিত সুশীলদের গালে সজোরে চড় বসিয়ে দিয়েছেন আরজ আলী মাতুব্বর। শুধু জীবিত অবস্থায় নিজেকে আর অন্যদের জ্ঞানের আলোয় আলোকিত করেননি, তিনি তার মৃত্যুর সময়েও এমন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন, যে সাহস এর আগে কোন শিক্ষিত সুশীলেরা করে দেখাতে পারেনি। তিনি তার মৃতদেহ কবরে দাফন না করে মানব কল্যাণে দান করার সিদ্ধান্ত নিলেন। মৃত্যুর কিছুদিন আগে লেখা ‘কেন আমার মৃতদেহ মেডিকেলে দান করেছি’ শীর্ষক প্রবন্ধে তিনি বলেন –
‘…আমি আমার মৃতদেহটিকে বিশ্বাসীদের অবহেলার বস্তু ও কবরে গলিত পদার্থে পরিণত না করে, তা মানব কল্যাণে সোপর্দ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছি। আমার মরদেহটির সাহায্যে মেডিক্যাল কলেজের শল্যবিদ্যা শিক্ষার্থীগন শল্যবিদ্যা আয়ত্ত করবে, আবার তাদের সাহায্যে রুগ্ন মানুষ রোগমুক্ত হয়ে শান্তিলাভ করবে। আর এসব প্রত্যক্ষ অনুভূতিই আমাকে দিয়েছে মেডিকেলে শবদেহ দানের মাধ্যমে মানব-কল্যাণের আনন্দলাভের প্রেরণা।
‘…এমন একদিন নিশ্চয় আসবে যখন সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ জীবন-মৃত্যুকে ব্যাখ্যা করার জন্য আত্মার দ্বারস্থ হবে না; আত্মার ‘পারলৌকিক’ শান্তির জন্য শ্রাদ্ধ-শান্তিতে কিংবা মিলাদ-মাহফিল বা চল্লিশায় অর্থ ব্যয় করবে না, মৃতদেহকে শ্মশান ঘাটে পুড়িয়ে বা মাটিচাপা দিয়ে মৃত দেহকে নষ্ট করবে না, বরং কর্নিয়া, হৃৎপিণ্ড, ফুসফুস, যকৃত, অগ্ন্যাশয় প্রভৃতি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো যেগুলো মানুষের কাজে লাগে, সেগুলো মানবসেবায় দান করে দেবে (গবেষণা থেকে জানা গেছে, মানুষের একটিমাত্র মৃতদেহের সর্বোচ্চ ব্যবহার করে ২২ জন অসুস্থ মানুষ উপকৃত হতে পারে)। এ ছাড়াও মেডিকেলের ছাত্রদের জন্য মৃতদেহ উন্মুক্ত করবে ব্যবহারিকভাবে শরীরবিদ্যাশিক্ষার দুয়ার। আরজ আলী মাতুব্বর তার মৃতদেহ মেডিকেল কলজে দান করার সিদ্ধান্ত নিয়ে এক সময় অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন। এ অনুপ্রেরণায় উজ্জীবিত হয়ে পরবর্তীতে মেডিকেলে নিজ মৃতদেহ দান করেছেন ড. আহমেদ শরীফ, ড. নরেন বিশ্বাস, ওয়াহিদুল হক, গায়ক সঞ্জীব চৌধুরী প্রমুখ। সমাজ সচেতন ইহজাগতিক এ মানুষগুলোকে জানাই আমার প্রাণের প্রণতি’।
আরজ আলী মাতুব্বর থেকে শুরু করে ড. আহমেদ শরীফ, ড. নরেন বিশ্বাস, ওয়াহিদুল হক, গায়ক সঞ্জীব চৌধুরী, ফয়েজ আহমদের উদাহরণ দেখলে বোঝা যায় মুক্তবুদ্ধির চর্চাকারী গণ্যমান্য ব্যক্তিদের মধ্যে মরণোত্তর দেহ দানের আগ্রহ বাড়ছে, প্রতি বছরই দৃষ্টান্ত হিসেবে তালিকায় উঠে আসছে বিদগ্ধজনদের নাম। জীবিত ব্যক্তিদের মধ্যেও সচেতনতা বাড়ছে। এর মধ্যে আমার চেনা জানা বাংলাদেশের সেলিব্রিটিদের মধ্যে আছেন যাদুশিল্পী জুয়েল আইচ। শুধু ইহজীবনে যাদু দেখিয়েই আমাদের তিনি মুগ্ধ করেননি, মৃত্যুর পরও কিভাবে মানুষের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত রাখা যায় সেই ভাবনায় মরণোত্তর দেহ দান করে বিমোহিত করে দিয়েছেন তিনি আমাদের। গড়ে তুলেছেন মানব কল্যাণে মরণোত্তর দেহদাতা সমিতি। তিনি এই সমিতির সাধারণ সম্পাদকও বটে। বাংলাদেশের মত পশ্চিমবঙ্গেও অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তি মরণোত্তর দেহদান করেছেন। এ মুহূর্তে প্রথমেই আমার যে নামটি মনে পড়ছে তিনি হচ্ছেন পশ্চিমবঙ্গের সাবেক পশ্চিমবঙ্গের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু।
জ্যোতি বসু জীবিত অবস্থাতেই বলে গিয়েছিলেন এভাবে –
“জানিনা আমার অশক্ত শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কারো কাজে আসবে কিনা! কিন্তু আমার ঐকান্তিক ইচ্ছা যে আমার মরদেহ যেন অন্তত গবেষণার কাজে লাগানো হয়।একজন কমিউনিস্ট হিসেবে জানতাম জীবিতকালে মানুষের সেবা করতে পারব। মৃত্যুর পরেও যে মানবতার কাজে লাগা যাবে, এটা জেনে প্রফুল্ল বোধ করছি।”
দুঃখজনক হলেও দেশে সাধারণ মানুষদের মধ্যে প্রক্রিয়াটি এখনো জনপ্রিয় করা যায়নি, না এ পার বাংলায়, না ওপারে। বেহেস্তের বা স্বর্গের অলীক হুর-পরীর লোভ, নরক কিংবা দোজখের ভয়, কুসংস্কার আর অপবিশ্বাসের পাশাপাশি অশিক্ষিত এবং অর্ধশিক্ষিত মোল্লা -- পুরোহিত আর লালসালুর মজিদদের ছড়ি ঘোরানো যে সমাজে প্রবল সে সমাজে এই ধরণের ব্রাত্য ধারণাকে জনপ্রিয় করাটা কষ্টকরই বটে। কিন্তু উদ্যোগ তো নিতে হবে কাউকে না কাউকে একটা সময়। সেই ভাবনা থেকেই লেখাটির শুরু। আমি নিজেও এ ধারনায় নতুন সৈনিক। এ নিয়ে জানার চেষ্টা করছি। যেটুকু বুঝেছি তার নিরিখেই প্রবন্ধটি লেখা। আমার দৃঢ ধারণা পাঠকেরাই এ প্রবন্ধটিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবেন সুগভীর আলোচনার মাধ্যমে। এই প্রবন্ধটি নেটের এক কোনায় এই মুহূর্তে থেকে গেলেও এই লেখাটিই রূপান্তরিত হয়ে উঠবে শুভবুদ্ধিধারী মুক্তমনা মানুষদের আগ্রহের চারাগাছে। চারাগাছ ধীরে ধীরে বড় হবে, একসময় মহীরুহ হয়ে ছড়িয়ে পড়বে আনাচে কানাচে। লিখেছেন: অভিজিৎ