somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বুক রিভিউঃ হৃদয়পুরে দেশান্তরী

১৩ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ দুপুর ১:৩২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



বলে গুণীজনে বিরহের গুণে ভালোবাসা হয় হিরন্ময়,
এ অধম তাতে ঈমান আনে না, বিরহকে তার ভীষণ ভয়।
পলক ফেলার সমান বিরহ মনে হয় যেন অন্তহীন
দুনিয়া আখের নিমেষে ফুরায় শেষ হয় না সে বিরহ দিন!

কি অদ্ভুত কথা! কি অদ্ভুত বাণী! কি অদ্ভুত তার প্রকাশ! যে ভালোবেসেছে, যে বিরহে কাতরেছে সেই জানে এই চারটি লাইন কত মূল্যবান। বিরহ সহজে ফুরনোর নয়। দুনিয়া- আখেরাত ফুরিয়ে গেলেও মনে হয় বিরহ কাল যেন ফুরায় না। চোখের এক পলক কালের বিরহ সময়কেও মনে হয় যেন অনন্তকাল।

আরেকটা দেখি-

ভাগ্য লেখেন আল্লাহতালা দুঃখে তিনি দেন নিদান।
জীবনজোড়া দুঃখ লেখা এটাও মানি তাঁর বিধান।
এমন কেনো ভাগ্য আমার, জানবো আমি কার কাছে?
হাজার পাহাড় টপকে এসেও পৌছাবো না তার কাছে!

এই যে আহাজারি, এই যে বিলাপ, এই যে দুঃখ গাঁথা, তাকে কবি চমৎকারভাবে ছন্দে ছন্দে আবদ্ধ করেছেন। কেউ যদি বলেন এর মধ্যে কোনো দর্শন নেই তা আমি মানতে রাজী নই। এতো আমাদের সহজিয়া জীবনের আত্ম জিজ্ঞাসা। এই আত্ম-জিজ্ঞাসার মধ্য দিয়েই আমরা পাড়ি দিতে চাই জীবনের উত্তাল সময়, পৌঁছতে চাই আমাদের কাঙ্খিত লক্ষ্যে। সক্রেটিস যখন বলেন, 'নিজেকে জানো', লালন যখন বলেন, 'আপন ঘরের খবর লে না' তখন আমরা এই জানতে পারি, কিছু প্রশ্নের জবাব কেবল আত্মজিজ্ঞাসাতেই পাওয়া যায়। কবি প্রকারান্তরে সেই একই দর্শনকেই ছুঁয়ে গেছেন।

কবি এ, টি, এম, মোস্তফা কামালের 'হৃদয়পুরে দেশান্তরী' বইটি সাজানো হয়েছে এমনি আটানব্বইটি চতুষ্পদী নিয়ে। কবি দেশান্তরী হতে চাইছেন হৃদয়পুরে। কেননা এই চতুষ্পদীগুলোতে একবার আপনি ডুব দিলে আপনি নিজেকে কেবল হৃদয়পুরেই খুঁজে পাবেন। যে আঁচে হৃদয় জ্বলে সেই ঝাঁঝটুকু নিয়ে রচিত বুদ্ধিদীপ্ত অথচ রোমান্টিক ধাঁচের এই চতুষ্পদীগুলো অত্যন্ত সুকোমল এবং সহজ পাঠ্য। কেবল কবিতা নয়, কাব্যগ্রন্থের প্রচ্ছদ এবং অলংকরণ ও হয়েছে অত্যন্ত চমৎকার।

চতুষ্পদী কবিতা মানে চার লাইনের কবিতা। চার লাইনের কবিতা মানেই মনের জানালায় উঁকি মারে রূবাইয়াতের কথা। কিন্তু 'হৃদয়পুরে দেশান্তরী' রূবাইয়াৎ নয়। যদিও রূবাইয়াতের একটা নির্দিষ্ট গঠনপ্রনালী রয়েছে। রূবাইয়াতে বাক্য শেষের শব্দটি মিলকরনের ক্ষেত্রে ক ক খ ক এই রীতিকে অনুসরণ করে লেখা হয়। কিন্তু কান্তি ঘোষ, ওমর খৈয়ামের যে অনুবাদ করেছেন তাতে সেই রীতিকে ভেঙে ক ক খ খ রীতিতে রূবাইয়াত রচনা করায় অনেকের কাছে এই চতুষ্পদীকেও রূবাইয়াৎ মনে করাটা অস্বাভাবিক নয়। কেবল এই রূবাইয়াতগুলোতে সুফিবাদ বা মরমি দর্শন থাকে এখানে তার অনুপস্থিতি আমাদের বিশেষভাবে জানান দেয় এগুলো চতুষ্পদী কবিতা।

বইয়ের চতুষ্পদী সম্পর্কে কবির ভাষায়, 'বাংলা চিরকালই কবিতার দেশ। সে কবিতায় গীতিমাধুর্য আর ছন্দোময়তার প্রবল প্রতাপ। রোমান্টিকতা, নানা দর্শন আর তীক্ষ্মবুদ্ধির পরিমিত মিশেলেই চলে বাংলা কাব্যসাধনা। এ বইতে বাংলা কবিতার সেই আবহমান রূপই গলাগলি করে আছে। গীতিপ্রবণ কবিতাগুলোতে রুবাই আর শের- এর কিছু ছাপও হঠাৎ চোখে পড়ে। বৈষ্ণব পদাবলী আর রোমান্টিক প্রণয়োপাখ্যানে ভালোবাসা নানা ভঙ্গিমায় রূপায়িত হয়েছে। হৃদয়পুরে দেশান্তরীর চতুষ্পদী কবিতায় সেই প্রেমকেই ছোট ছোট টুকরা করা আয়নার মতো ভেঙ্গে ভেঙ্গে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। .... একুশ শতকের ব্যস্ততার যুগে যে মানব-মানবীর বসবাস তাদের সবার জীবন এখন ছোট হয়ে মুঠোফোন, ক্ষুদে বার্তা আর ফেসবুকের স্ট্যাটাস দিয়ে আবৃত। দীর্ঘ কবিতার রস সেবনের সময় কি আছে তাদের? কিন্তু মানুষের জীবন যাই হোক ভালোবাসার আকুতি তার জীবনের অপরিহার্য অঙ্গ। ছোট ছোট অবয়বে সেই ভালোবাসাকেই এখানে সেঁটে দেয়া হয়েছে। শুভ হোক সবার হৃদয়পুরের দেশান্তরী হবার যাত্রা।'

নিজের কাব্যগ্রন্থ সম্পর্কে এমন চমৎকার বিশ্লেষণের পর আর বেশি কিছু বলার থাকে না। তার পরও ভালো লেখার গুণগ্রাহী পাঠকের জন্য ভালো বই গুলোর প্রচার হওয়া প্রয়োজন, প্রয়োজন পৃষ্ঠপোষকতা। বইটির যে পৃষ্ঠাই মেলে ধরুন আর পড়ুন আপনি পাবেন এক অদ্ভুত আবেশ। মনে হবে এতো আপনার মনের কথাই। আর যে কবি আমার আপনার সকলের মনের কথা পড়তে পারে, তিনিই তো সত্যিকারে কবি।

চতুষ্পদী কবিতাগুলো নিয়ে অনেক বিচার বিশ্লেষণ করা যায় তবে লেখা অনেক বড় হয়ে যাবে তাই কেবল ছন্দ নিয়ে বলি। পদ রচনায় বেশির ভাগই মাত্রাবৃত্ত ছন্দে লেখা চতুষ্পদীগুলোর কোথায়ও ছন্দের পতন হয়েছে এমন নজরে আসেনি। এ নিয়ে বইটির মোড়ক উন্মোচন বক্তৃতায় ডঃ তপন বাগচী কবির ছন্দ জ্ঞানের বিশেষ তারিফ করেন। পাঠক মাত্রেই বইটি পাঠ কালে অনুভব করবেন।

আমার আছে আরো একটি বিষয় চোখে পড়েছে। সেটি হলো কিছু নতুন শব্দ বা শব্দ গুচ্ছের ব্যবহার করা চেষ্টা করেছেন যা অত্যন্ত স্বার্থকভাবে ব্যবহৃত হয়েছে। যেমনঃ
প্রত্ন-প্রতিমা
চাঁদ-বিছানা
উড়াল-আচল
ঘাম-সুরভি
এগুলো চমৎকার ভাবে উপমা হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছে। আরো কিছু যেমন

দামের চুলায় আগুন দিতে
কাজের খোলস পরাই
কথার বাঁধা পাহাড় সেজে

এমনি অনেক সূক্ষ্ম কাজ চোখে পড়ে। এই সব ধরতে পারা, বুঝতে পারার মধ্যেই রয়েছে পাঠকের আনন্দ। আমি আশা করবো পাঠকশ্রেনি এই অনাবিল আনন্দ থেকে নিজেকে বঞ্চিত করবেন না। সংক্ষেপে বইটি সম্পর্কে জানিয়ে শেষ করছি 'হৃদয়পুরে দেশান্তরী'র পাঠ পরিচিতি।

কবিঃ এ, টি, এম, মোস্তফা কামাল
বইয়ের নামঃ হৃদয়পুরে দেশান্তরী
প্রকাশকঃ অনুপাণন প্রকাশন
প্রচ্ছদ ও অলংকরণঃ নবী হোসেন
মূল্যঃ ১৫০ টাকা
প্রকাশ কালঃ নভেম্বর ২০১৪
উৎসর্গঃ মাহফুজা খন্দকার তিথি (কবির অর্ধাঙ্গিনী)

সবাইকে বইটি কিনে পাঠের অনুরোধ রইলো। সকলে ভালো থাকবেন, সুন্দর থাকবেন। বইমেলায় এসে বই কিনবেন। ভালো বই কিনবেন। এতে ভালো লেখক আরো ভালো কিছু সৃষ্টিতে উৎসাহী হবে। ধন্যবাদ।
১০টি মন্তব্য ১০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ফখরুল সাহেব দেশটাকে বাঁচান।

লিখেছেন আহা রুবন, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৯:৫০





ফখরুল সাহেব দেশটাকে বাঁচান। আমরা দিন দিন কোথায় যাচ্ছি কিছু বুঝে উঠতে পারছি না। আপনার দলের লোকজন চাঁদাবাজি-দখলবাজি নিয়ে তো মহাব্যস্ত! সে পুরাতন কথা। কিন্তু নিজেদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হচ্ছে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। প্রধান উপদেষ্টাকে সাবেক মন্ত্রীর স্ত্রীর খোলা চিঠি!

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:০৩




সাবেক গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনকে মুক্তি দিতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে খোলা চিঠি দিয়েছেন মোশাররফ হোসেনের স্ত্রী আয়েশা সুলতানা। মঙ্গলবার (২৯... ...বাকিটুকু পড়ুন

কেমন হবে জাতীয় পার্টির মহাসমাবেশ ?

লিখেছেন শিশির খান ১৪, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:৫৬


জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে বিক্ষুব্দ ছাত্র জনতা আগুন দিয়েছে তাতে বুড়ো গরু গুলোর মন খারাপ।বুড়ো গরু হচ্ছে তারা যারা এখনো গণমাধ্যমে ইনিয়ে বিনিয়ে স্বৈরাচারের পক্ষে কথা বলে ,ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ হওয়াতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

দ্বীনদার জীবন সঙ্গিনী

লিখেছেন সামিউল ইসলাম বাবু, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১২:১৩

ফিতনার এই জামানায়,
দ্বীনদার জীবন সঙ্গিনী খুব প্রয়োজন ..! (পর্ব- ৭৭)

সময়টা যাচ্ছে বেশ কঠিন, নানান রকম ফেতনার জালে ছেয়ে আছে পুরো পৃথিবী। এমন পরিস্থিতিতে নিজেকে গুনাহ মুক্ত রাখা অনেকটাই হাত... ...বাকিটুকু পড়ুন

জাতির জনক কে? একক পরিচয় বনাম বহুত্বের বাস্তবতা

লিখেছেন মুনতাসির, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৮:২৪

বাঙালি জাতির জনক কে, এই প্রশ্নটি শুনতে সোজা হলেও এর উত্তর ভীষণ জটিল। বাংলাদেশে জাতির জনক ধারণাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে একজন ব্যক্তিত্বকে জাতির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়। তবে পশ্চিমবঙ্গের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×