আমার ঈদ কেমন ছিলো? এই সময়ে এসে চিন্তা করলে আউলা ঝাউলা লাগে। ফরিদাবাদে যখন ছিলাম তখন ঈদ ছিলো এক রকম। আবার এই মুরাদপুরে আসার পর ঈদ হয়ে গেলো অন্য রকম।
এখন আমরা বলি ঈদুল ফিতর, ঈদুল আযহা। কিন্তু ছোটবেলায় বলতাম, রোজার ঈদ, কোরবানী ঈদ। এখন রোজার ঈদের কথাই বলি। ছোট বেলা থেকেই আমি রোজা রাখতে চাইতাম। কিন্তু আম্মু রোজা রাখতে দিতে চাইতেন না। আমার কষ্ট হবে এই ভেবে। যখন একদম ছোট ছিলাম তখন আম্মু বলতোঃ সবাই দিনে মাত্র একটা রোজা রাখে, তুমি তিনটা রোজা রাখবা ঠিক আছে?
আমিঃ এক দিনে তিনটা?
আম্মুঃ হুম
আমিঃ কিভাবে?
আম্মুঃ সেহেরি থেকে সকালের নাস্তা পর্যন্ত একবার। সকালের নাস্তা থেকে দুপুর পর্যন্ত এক বার আর দুপুর থেকে ইফতার পর্যন্ত একবার। মোট তিনবার।
ব্যস, আমি সানন্দে প্রতিদিন তিনটা করে রোজা রাখতে লাগলাম। তবে শর্ত হচ্ছে সেহেরি খেতে হবে। তা হলেই দিনে তিনটা রোজা হবে। সেহেরি না খেলে হবে না। কিন্তু, সেহেরিতে আমাকে ডেকে তোলা আরেক যন্ত্রণার। আমি কিছুতেই উঠতে চাইতাম না। তবু আমাকে ডাকা হতো।
এরপর একটু বড় হলে আমার চেয়ে একটু বড়রা আমাকে বললো, আমার তো আসলে রোজাই হয়না। আমিও বুঝলাম তাই তো দিনে তো তিনটা করে রোজা হতেই পারেনা। তখন আম্মু বললেনঃ আচ্ছা ঠিক আছে তুমি সারা মাস রোজা রাখতে চাও?
আমিঃ হ্যাঁ।
আম্মুঃ ঠিক আছে, প্রথম রোজা আর শেষ রোজা রাখো তবেই তোমার সারা মাস রোজা হয়ে যাবে।
আমিঃ তাই?
আম্মুঃ হুম।
আমিঃ আচ্ছা তাহলে আমি প্রথম রোজা আরা শেষ রোজা রাখে সারা মাস রোজা রাখবো। কিন্তু এই ফাঁকিও বেশি দিন দেয়া গেলো না। এরপর প্রতি দশদিনে একটা করে। এরপর প্রতি সপ্তাহে একটা দুটো করে রোজা রাখতে লাগলাম। আমি রোজা রেখে কাহিল হচ্ছি এই দেখে আম্মু একদিন বললেনঃ ধর তুমি রোজা রেখে কিছু খেয়ে ফেলো আর কেউ তা দেখলো না। তাহলে কিন্তু তোমার রোজা হয়ে যাবে।
আমিঃ এটা হয় নাকি?
আম্মুঃ হুম, ছোটদের জন্য হয় তো।
আমিঃ আচ্ছা, তাহলে তুমিও কিন্তু দেখবা না।
আম্মুঃ আচ্ছা, আমিও দখবোনা। এইবলে খাবার দিয়ে দরজা বন্ধ করে চলে গেলেন। আমিও পেটের চুচু সহ্য করতে না পেরে খেয়ে মুখ মুছে দেদারছে ঘুরতে লাগলাম। ভাব এমন আমিতো রোজা রেখেছি কই, আমারতো কষ্ট হচ্ছে না।
এরপর ইতিমধ্যে আমি জেনে গেছি, এভাবে আসলে রোজা হয়না। তখন শুরু হলো নতুন কৌশল। আমাকে ঘুম থেকে উঠানো যায়না। তাই আমাকে অনেক ডাকাডাকির পরও আমি উঠিনি। তাই রোজা রাখতে পারিনি। আসলে এমন অনেক দিন আমাকে ঘুম থেকে ডাকেইনি।
এভাবেই আস্তে আস্তে রোজাতে অভ্যস্ত হয়ে গেলাম। এখন আসি ঈদের আগের রাত চান রাতের কথা। চান রাতের দিন আমরা আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতাম সন্ধ্যার সময়। এর জন্য উঠে যেতাম তিনতলার ছাদে। পশ্চিম দিকে তাকিয়ে থাকতাম, সূর্য ডুবে গেলে উঠবে চাঁদ। চাঁদ দেখতে পেলে সে কি আনন্দ! সেই আনন্দ ধরা দিতো তারাবাত্বি জ্বালিয়ে। এরপর সবারই কেমন একটা ধোয়া মোছা, গোছ-গাছ লেগে যেত। কাল ঈদ তাই আজ রাতেই সব কিছু সুন্দর করে সাজিয়ে পরিপাটি করে রাখতে হবে।
ঈদের জামা অবশ্যই কাউকে দেখানো যাবেনা। এটা খুবই গোপনীয়। ঈদের জামা দেখানো মানেই হলো ঈদ শেষ। আমার ঠিক মনে পরেনা, আমি ঈদে একটার বেশি দুইটা জামা পেয়েছি। কিন্তু রনি-কেয়া আপাদের দেখতাম ওদের দুই-তিন সেট করে ঈদের জামা হয়। একটা সেট হয়তো মামা দিলো, একটা সেট চাচা এই করে ওদের দুই-তিন সেট হয়ে যেত। তাই একটা সেট দেখালেও ওদের ঈদ থেকে যেত।
ঈদের দিন সকালে উঠে আব্বুর সাথে যেতাম নামাজ পরতে। নামাজ পরতে যাওয়ার আগে সেমাই খেয়ে যেতে হতো। কোরবানীর ঈদের নিয়ম হলো, নামাজ পরার পর সেমাই খাওয়া। এখন কোরবানীর পর সেমাই খেতে হয়। নামাজ পরে এসে চলতো সালাম করার ধুম। সালাম করলেই সালামি। তখন সালামি পাওয়া যেত ২টাকা থেকে ১০ টাকা। কদাচিত কেউ বিশ টাকা দিতো। সারা দিন ঘুরতাম এই সালামি আদায় করা যাবে যেখানে সেখান সেখানে। সব বাসাতেই সেমাই, পায়েস, ফিন্নি কিছু না কিছু মিষ্টান্ন খেতে দিতো। এই মিষ্টি জাতীয় খাবার খেয়েই আর দুপুরে খাওয়া হতোনা। অথবা দুপুরেও খেয়ে নিতাম কারো বাসায়। খিচুরি, পোলাও আর মাংস (গরুর অথবা মুরগীর)।
সন্ধ্যায় এসে সব টাকা আম্মুকে দিয়ে দিতাম রাখতে। বলা বাহুল্য, সেই টাকা আর কোনো দিন ফেরত পাওয়া যায়নি। ঈদের দিনের মজা হলো, পড়তে বসতে হয় না। এই দিন যেখানে খুশি ঘোরাঘুরি কর, খেলো কোনো মানা নেই। সন্ধ্যার পর টিভি দেখতাম। নাটক, আনন্দ মেলা, এরপর এক সময় শুরু হলো ইত্যাদি। রাতে খাবার খেতাম আব্বু-আম্মুর সাথে। এরপর ঘুম।
বলতে গেলে আমার ফরিদাবাদের ঈদগুলো এমনই ছিলো। পঞ্চম শ্রেনী পর্যন্ত আমি ফরিদাবাদে ছিলাম। এরপর চলে আসি মুরাদপুর। মুরাদপুরের ঈদের কথা না হয় হবে অন্য কোনো এক সময়। সকলকে ঈদ মোবারক।
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে জুলাই, ২০১৪ রাত ১১:২৬