দেশে অ্যানথ্রাক্স আতঙ্ক ছড়ানো হয়েছে সুকৌশলে। পরিকল্পিতভাবে। একটি মহল এ রোগের আতঙ্ক ছড়িয়ে ফায়দা লোটার চেষ্টা করছে। এ অভিমত প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের।
দেশের গবাদি পশু শিল্পকে ধ্বংস, চামড়া শিল্পকে ক্ষতিগ্রস্ত, অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব সৃষ্টি, অ্যানথ্রাক্সের প্রতিষেধক ভ্যাকসিন বিক্রি করে মুনাফা এবং মাংস ব্যবসায়ীদের দিয়ে আন্দোলন করিয়ে দেশের পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করার হীনস্বার্থে এ আতঙ্ক ছড়ানো হয়েছে। তদন্ত করে এমন তথ্য পেয়েছেন তারা। সারাদেশে এ রোগের আতঙ্কের পেছনের কারণ খুঁজতে গিয়েই গোয়েন্দারাও পেয়েছেন এ তথ্য। এখন জড়িতদের খুঁজে বের করার চেষ্টা চলছে। তাদের সন্দেহের তীর কতিপয় প্রভাবশালী পোল্ট্রি ও ওষুধ ব্যবসায়ীর দিকে। কয়েক জনের নাম জানা গেলেও আপাতত তা প্রকাশ করা হচ্ছে না। সূত্র জানায়, সামনে কোরবানি ঈদ। দেশের চামড়া শিল্পের ৬০ ভাগ কাঁচামাল আসে কোরবানি ঈদের সময়। এবার অ্যানথ্রাক্স আতঙ্ক এমনভাবে ছড়ানো হয়েছে এর প্রভাব যেন গিয়ে পড়ে ওই সময়। সূত্র জানায়, জিডিপি’র মোট ২ দশমিক ৬৭ ভাগ আসে চামড়া শিল্প থেকে। এ অবস্থায় ব্যবসায়ীরা কাঁচামাল সংগ্রহ করতে না পারলে যথাসময়ে পণ্য ডেলিভারি দিতে পারবে না। চামড়া রপ্তানিতেও এর ফলে ব্যাপক ধস নামবে। বাংলাদেশের চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে বিশ্ববাজারে। সেটিও ধ্বংস করে দেয়ার পাঁয়তারা চলছে।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, সরকারের সঙ্গে পোল্ট্রি শিল্প মালিকদের সম্পর্ক ভাল যাচ্ছে না। মুরগির বাচ্চা উৎপাদনে খরচ ১৮-২০ টাকা হলেও ৬৫ টাকা করে বিক্রি করতো তারা। সরকার বাচ্চার দাম নির্ধারণ করে দেয় ৩০ টাকা। এর বিরুদ্ধে কোর্টে রিট করে পোল্ট্রি ব্যবসায়ীরা। ওই রিট খারিজ হয়ে যায়। পরে তারা উচ্চ আদালতে গিয়ে নিষেধাজ্ঞা নেয়। ফলে এখন বাচ্চা বিক্রি হচ্ছে ৮৫-৯৫ টাকায়। তারা একচেটিয়া ব্যবসা করে যাচ্ছে। ডিমের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। মুরগির মাংস প্রতি কেজি ১৭০-১৯০ টাকা, কোথাও বেশি দরে বিক্রি হচ্ছে। দেশী মুরগি ২৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
সূত্র আরও জানায়, অ্যানথ্রাক্স রোগের ভ্যাকসিন বাংলাদেশ সরকারের তত্ত্বাবধানে ঢাকায় ও কুমিল্লায় তৈরি হয়। এ রোগের ভ্যাকসিনের সঙ্কট সৃষ্টি করে ওষুধ আমদানি তৈরি করে মোটা অঙ্কের টাকা আয় করার পরিকল্পনায় একটি স্বার্থান্বেষী মহল এ কাজের সঙ্গে জড়িত। গোয়েন্দারা এ তথ্যের ভিত্তিতে তাদের খুঁজে বের করার জন্য কাজ করছেন। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর জানায়, প্রতিবছর তারা ৩৫-৪০ লাখ ভ্যাকসিন তৈরি করেন। বর্তমানে তারা চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ২০ লাখ ভ্যাকসিন তৈরি করতে পেরেছেন। এর মধ্যে ১৮ লাখ অ্যানথ্রাক্সপ্রবণ এলাকায় পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। বাকি দুই লাখ ভ্যাকসিন আজকালের মধ্যে রাজশাহী পাঠিয়ে দেয়া হবে। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরে সহকারী পরিচালক বলেন, আমরা আগামী সপ্তাহে আরও ৫ লাখ টিকা উৎপাদন করবো। বছরে ৩৫ হাজার ভ্যাকসিন হলে চলে। কিন্তু এখনকার পরিস্থিতি বিবেচনা করে আমরা দেড় কোটি ভ্যাকসিন উৎপাদন করতে যাচ্ছি। আগে এ ভ্যাকসিন বিনামূল্যে দেয়া হতো না। ৫০ পয়সা নেয়া হতো। এখন সরকার থেকে তা বিনামূল্যে দেয়া হচ্ছে। তবে দেড় কোটি ভ্যাকসিন তৈরি করার জন্য যে বাজেট তা তাদের নেই। এ কারণে স্বাস্থ্যমন্ত্রী, স্বাস্থ্য সচিব তাদের আশ্বাস দিয়েছেন। বলেছেন, প্রয়োজনীয় সকল সুবিধা দেয়া হবে। টিকা তৈরির জন্য যে টাকা প্রয়োজন হবে তা-ও সরকার দেবে।
প্রাণিসম্পদ দপ্তরের ডা. সমর কুমার ঘোষ বলেন, আমাদের এত টিকা না-ও লাগতে পারে। তারপরও আমরা প্রস্তুতি রেখেছি। অবশ্য সব জায়গায় ভ্যাকসিনের দরকার নেই। যেসব এলাকায় অ্যানথ্রাক্সের প্রাদুর্ভাব রয়েছে কেবল সেখানে ভ্যাকসিন দিতে হবে। এ ছাড়া সব এলাকায় ওষুধ দেয়া যাচ্ছে না। কারণ অনেক এলাকায় এখনও ওষুধ পৌঁছেনি। আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি ওষুধের চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে। সূত্র জানায়, এক শ্রেণীর ওষুধ ব্যবসায়ী অ্যানথ্রাক্সের ভ্যাকসিন তৈরি/আমদানি করে বিপুল পরিমাণ মুনাফা লাভ করতে পারেন। গোয়েন্দাদের কাছে তথ্য রয়েছে, ভ্যাকসিন বাণিজ্য করার জন্য মুনাফালোভীরা চিকিৎসকদের নিয়ে হোটেলে বৈঠক করেছেন, তাদেরকে মোটা অঙ্কের অর্থ দিতে চেয়েছেন। প্রাণিসম্পদ সূত্র জানায়, অ্যানথ্রাক্স আতঙ্ক বলতেই ভয় পাওয়ার কিছু নেই। সবাই নিজের গরু-ছাগলকে ভ্যাকসিন দিতে চাইছেন, নিজেরাও নিতে চাইছেন- এটা ঠিক নয়। প্রাদুর্ভাব রয়েছে এমন এলাকায় আমরা সব গরুর জন্য ভ্যাকসিন দেবো। তবে সব মানুষকে ভ্যাকসিন দেয়া যাবে না। সম্ভব হবে না। এ ভ্যাকসিন মানুষের দেহে ক্ষতি করে। তবে গরু-ছাগলের ক্ষতি করে না।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী গত জুলাই মাসে প্রথম অ্যানথ্রাক্স চিহ্নিত হয়। এটি প্রাচীন রোগ তড়কা। অ্যানথ্রাক্স নামটি নতুন প্রচলন করেছে মহল বিশেষ। এ কারণে দ্রুত আতঙ্ক ছড়ায়। এ পর্যন্ত মোট ১০৩টি পশু ও ৫৮৫ জন মানুষ এ রোগে আক্রান্ত হয়েছে। ৮টি জেলায় ১৭টি উপজেলায় তা ছড়িয়েছে। মানুষ এ রোগে মারা যায় না। এটি একটি চর্ম রোগ।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক বলেন, সারা দেশে অ্যানথ্রাক্সে আক্রান্ত পশুর সংখ্যা খুবই কম। এ নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। গোয়েন্দা সূত্র জানায়, ২০০৮ সালে আরও বেশি সংখ্যক প্রাণী অ্যানথ্রাক্সে আক্রান্ত হয়েছে। তারপরেও এর ভয়াবহতা নিয়ে আতঙ্ক এবারের মতো করে ছড়ানো হয়নি। মানুষ যারা আক্রান্ত হয়েছেন তাদের ৮০ ভাগ সুস্থ হয়ে উঠেছেন। সাধারণত একজন রোগীর সুস্থ হতে ১৫ দিন লাগে। তবে গরু-ছাগল আক্রান্ত হলে ২৪-৪৮ ঘণ্টায় মারা যায়।
মুন লিংক