আমাদের পরিবার-পরিজন সহ চারপাশে যারা আমাদের সবসময় আনন্দ দেয় যাদের থেকে আমরা লিটারেলী নি:স্বার্থ ভালবাসা পেয়ে থাকি তারা হলো সেই ছোট ছোট বাচ্চাকাচ্চাই। এরা কোন কারণ ছাড়াই আমাদের ভালবাসে, কারো মন খারাপ থাকলে একটা ছোট বাচ্চা নিমেষেই তার মন ভালো করে দেয়ার অসীম ক্ষমতা রাখে। কিন্তু এর প্রতিদানে কি আমরা সবসময় তাদের প্রতি সঠিক আচরণ দেখাই? একটা বাচ্চা মোটামুটি তরল পদার্থ। তাকে ছোটবেলা থেকে যা শেখানো হবে সেটাই একসময় সে সমাজকে ফেরত দেবে। বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে আমার সামান্য আতলামী মার্কা এই লেখায় আমি বাচ্চাকাচ্চাদের সাথে আমাদের কোন সিচুয়েশনে কেমন ব্যবহার করা উচিত সেটা নিয়ে আমার ব্যক্তিগত অভিমত প্রকাশ করবো। দ্বিমত হতেই পারেন আপনি।
* পড়স না ক্যান বেয়াদ্দপ? থাপড়াইয়া দাঁত ফালাই দিমু
বাচ্চাকাচ্চাদের যে ব্যাপারটা নিয়ে প্রত্যেক বাবা-মা সবচেয়ে বেশী দু:শ্চিন্তায় ভোগেন সেটা হলো বাচ্চা পড়েনা কেনো? ছোট্ট এই মানুষটাকে কিভাবে আইনস্টাইন, নিউটন বানানো যায় সেটা নিয়ে অনেকেই রাতের ঘুম হারাম করেন। তাকে কিভাবে পড়ানো যায়, পড়াশোনায় মনোযোগী করানো যায় এর জন্য বহুল ব্যবহৃত পদ্ধতিগুলো হলো
* খেলতে দেখলেই লাঠি নিয়ে দৌড়ানো
* পরীক্ষায় খারাপ করলে ঘর থেকে বের হয়ে যেতে বলা
* গল্পের বই থেকে একশ হাত দুরে রাখা
* টিভি দেখতে না দেয়া, তার মত ছোট থাকতে আমি কি হনু ছিলাম এবং দিনে ২৪ ঘন্টার মধ্যে ৩০ ঘন্টাই কিরকম পড়াশোনা করতাম সেটার বর্ণনা দেয়া
* তার পিছনে আট-দশজন টিচার লেলিয়ে দেয়া
* মারধর করা
আমি বলবো হোয়াই সো সিরিয়াস? পড়াশোনা ভালো লাগার জিনিস যেটা জোর করে হয়না। কারো যদি মন বসেনা বইয়ের পাতায় টাইপ সিচুয়েশন হয় তাহলে সেই বাচ্চার জন্য সবচেয়ে কার্যকর ওষুধ হলো গল্পের বই। বিশ্বাস হয় না? না হওয়ার কোন কারণ নাই। একটা বাচ্চা তখনই নিজের আগ্রহে বই পড়বে যখন সে সেটায় মজা পাবে, আনন্দ খুজে পাবে। বইয়ের পাতায় যে আনন্দ খুজে পাওয়া যেতে পারে সেটা বোঝানোর জন্য গল্পের বই হচ্ছে সবচাইতে সহজ সমাধান। পড়ার অভ্যাস একবার তৈরি হলে সেটা আস্তে আস্তে পড়ার বইয়ের দিকে নিয়ে যাওয়া খুব একটা কঠিন কাজ না। আর ঘরে বসে বাইরে দুনিয়াটা দেখার জন্য গল্পের বই অনেকটা ম্যাজিক কার্পেটের মত। আপনার বাচ্চার হাতে তার বয়স অনুযায়ী অনেক বই তুলে দিন। আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবকে বলে দেন আপনার বাচ্চাকে কাপড়-চোপড়, খেলনা গিফট না করে যেন গল্পের বই দেয়। একটা বাচ্চার মানসিক বিকাশের জন্য এই জিনিসটা অনেক দরকারী।
* প্রবলেম :@ :@ সুতান কুতাকার!! সারাদিন গল্পের বই পড়োস? স্কুলের পড়া কি আমি পড়মু?
কমন প্রবলেম। বাচ্চা গল্পের বইয়ের প্রতি এতটাই আসক্ত যে পড়ার বইয়ের ভিতরে গল্পের বই লুকিয়ে পড়ে। এইবার দেখলেন? আপনার বাচ্চার কিন্ত বইপড়ার প্রতি ভালবাসা জন্মিয়ে গেছে। অথচ আপনিই এতদিন বলতেন আপনার বাচ্চা বই থেকে ১০০ হাত দুরে থাকে। মিথ্যা বুলেন কেনু? আমরা সবই বুঝি।
এই কেইসে চ্যালেঞ্জ হলো তার মনোযোগের একটুখানি গল্পের বই থেকে পড়ার বইয়ের দিকে ডাইভার্ট করা। এটা কিন্তু তেমন একটা কঠিন কাজ না। গল্পের বইয়ের উৎস কি? আপনার পকেট নিশ্চয়ই। কোন কারণ ছাড়া গল্পের বই কিনে দেয়ায় একটু বিরতি দেন। বাচ্চা অমুক-তমুক বই কিনতে চাইলে তাকে বলেন যে এই বইটা পেতে হলেতো তোমাকে একটু কষ্ট করতে হবে বাপধন।
- কি কষ্ট?
- আমার একটু কাজ করে দিতে হবে।
- কি কাজ?
- তোমার অংক বইটা নিয়ে অমুক চ্যাপটারের অমুক তমুক এবং সমুক অংকটা করলে তোমাকে এই বই কিনে দেয়া হবে।
অবাক হচ্ছেন? খুবই কার্যকরী পদ্ধতি। আমি নিজেই এর শিকার। আমি ছোটবেলা থেকে এখন বড়বেলা পর্যন্ত খুবই ফাকিবাজ ছাত্র। আমার বাবার কাছে যদি বলতাম এইটা কিনবো, সেইটা কিনবো তাহলে তার সোজা সাপ্টা উত্তর ছিলো নিজের টাকায় কিনো। কিন্তু স্কুলপড়ুয়া আমার কাছে টাকার উৎস তো স্কুলে হেটে গিয়ে টাকা বাচানো ছাড়া আর কিছুই নেই। সমাধান কি? তখন আমার বাবা কাজ দিতো আমাকে। কাবিটা(কাজের বিনিময়ে টাকা) কর্মসূচীটা ছিলো অনেকটা এইরকম।
‘তার সামনে বসে ইংরেজী বইয়ের এক পৃষ্ঠা রিডিং পড়ে শুনালে ১ টাকা, পুরা পৃষ্ঠা লিখে ফেললে ২ টাকা। অথবা ৪-৫টা অংক করলে ১ টাকা। টাকার হিসাব রাখা হতো। আর আমিও তাড়াতাড়ি টাকা কামানোর জন্য তাড়াতাড়ি পড়তাম। যে কারণে রিডিং স্কিল, রাইটিং স্কিল, বেসিক নলেজ ভালো ছিলো। তাছাড়া বইয়ের কত নাম্বার পৃষ্ঠায় কি জিনিস আছে সেটা মোটামুটি জানা থাকতো। আর টাকা জমলে এইটা সেইটা কেনা তো আছেই।'
এই সিস্টেমে যেটা মূলমন্ত্র সেটা হলো খুবই সিম্পল। একটা বাচ্চা নিজের জন্য পড়তে শিখে। বেশীরভাগ বাচ্চাই পরীক্ষার জন্য, মার থেকে বাঁচার জন্য পড়তে শিখে। কিন্তু নিজের জন্য, নিজের আনন্দের জন্য যে পড়া সেটার স্বাদ থেকে বঞ্চিত থাকে সবসময়ই। একটা বাচ্চা চিত্তবিনোদনের জন্য টিভি না দেখে বই পড়ছে, ম্যাথ করছে এই দৃশ্যটা কি সুখকর না?
* তরে পাইলে হাড্ডি ভাইঙা দিমু। পোলারে কি ব্যবসায়ী বানাইতে কস?
এই পর্যায়ে মনে এই প্রশ্ন আসাই স্বাভাবিক। ব্যবসায়ী কেনো বানাবেন? টাকার হিসাব আপনি রাখবেন। অথবা পয়েন্ট সিস্টেম চালু করতে পারেন। যেমন আমার ছোটভাই গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে বায়না ধরেছে তার সাইকেল লাগবে। তাকে বলা হয়েছে বার্ষিক পরীক্ষায় প্রতি নাম্বারের জন্য ৩ পয়েন্ট। এভাবে ৩০০০ পয়েন্ট হলেই সাইকেল কিনে দেবো। লক্ষ করে দেখেন শুধুমাত্র বার্ষিক পরীক্ষার নাম্বার দিয়ে ৩০০০ পয়েন্ট হওয়া সম্ভব না। পরের ক্লাশে প্রথম সাময়িক পরীক্ষায়ও যদি ভালো করে তাহলেই সম্ভব। কিন্তু দুই পরীক্ষার একটাতে একটু খারাপ করলেই তাকে অপেক্ষা করতে হবে ২য় সাময়িক পর্যন্ত। সুতরাং তার জন্য অপশন হলো এই দুই পরীক্ষাতেই ভালো করা। সে চেস্টা করছে। এক সময় সে নিজের তাগিদেই পড়বে। সাইকেলের লোভ লাগবেনা। চ্যালেঞ্জ নিতে পছন্দ করে বাচ্চারা। তাদেরকে সেই সুযোগ দেয়া উচিত।
* আমার বাচ্চারে কি তাহলে কামলা খাটাইতে বলেন? এত্তগুলো পচা আপনি?
এটা নেগেটিভ ভাবে নেয়ার কিছু নেই। এখন আপনি আপনার বাচ্চাকে সাপোর্ট দিচ্ছেন। কিন্তু একসময় তাকে পুরা দুনিয়াতে নিজের শক্তিতে দাড়াতে হবে। তাকে এখন থেকেই শিক্ষা দেয়া ভালো যে কষ্ট ছাড়া কিছু পাওয়া যায়না। যা তুমি পেতে চাও সেটা কষ্ট করে অর্জন করো। আর নিজে কষ্ট করে কিছু পেলে সেটার আনন্দ অনেক। এই আনন্দের সাথে যত আগে পরিচিত হওয়া যায় ততই মঙ্গল। বাচ্চাকে নিজের পায়ে দাড়াতে শেখানো উচিত। ননীর পুতুল বানাইয়া তাহাকে ঘরে বসাইয়া রাখিয়া চাহিবার পূর্বেই তাহাকে সকল দ্রব্যাদি প্রদান করা ও কর্নগহ্বরের নিকটে পড় পড় বলিয়া সারাটি দিবস ঘ্যানঘ্যান করা তাহার মানসিক বৃদ্ধির অন্তরায়। তাকে শক্ত সমর্থ করে তুলুন। নিত্য নৈমিত্ত চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিন তার প্রতি।
* ধুর!! এত্ত কষ্ট করতারমুনা। টেকাছে। টিচার রাখমু। সে পড়া গিলাইয়া দিবে তাহার উদরে
খুবই বাজে স্ট্র্যাটেজি। একগাদা টিচার মানসিক চাপ বাড়িয়ে দেয় আর অন্যের উপর নির্ভরশীল হওয়া শিখায়। পড়াশুনা কি ভয়ে ভয়ে হয় বলেন? একটা সময় তো তাকে নিজে নিজেই পড়তে হবে। টিচারের করে দেয়া নোট সাজেশনের উপর যদি সে পড়ার অভ্যাস করে ফেলে তাহলে একটা সময় গিয়ে যখন সে দেখবে নিজের পড়া তার নিজেরই পড়তে হচ্ছে তখন সে বড় একটা ধাক্কা খাবে। নিজের পড়ার বোঝা বহন করার জন্য নিজের ঘাড়টাকেই শক্ত করা শেখানোই কি বুদ্ধিমানের কাজ না? তাকে উৎসাহ দিন, চ্যালেঞ্জ দিন, ভাল কাজের জন্য পুরষ্কার দিন। আর সবাইকেই যে আইনস্টাইন, নিউটন হতে হবে, প্রতি পরীক্ষায় ফার্স্ট হতে হবে এমন তো কোন কথা নেই। প্রতি পরীক্ষায় ফার্স্ট হওয়া আপনার ছেলেটা যদি নিজের কাজ নিজে করতে না পারে, আর দশটা বাইরের মানুষের সাথে মিশতে না পারে, অজানা কোন কিছুতে ভয় পায় সেটার দায় থেকে কি আপনি কি নিজেকে এড়াতে পারবেন?
বলতেই পারেন, টিচার থাকলে দুষের কি? সময় পাইনা। কাজের চাপে বাচ্চারে পড়ামু কখন? বাচ্চাটা আপনার। তাকে একটু সময় দিতে পারবেন না?
ক্ষেত্রবিশেষে হয়তোবা একজন টিচার রাখা জরুরী হয়ে পড়ে। কিন্তু তবুও তার পড়াশোনার খোজ খবর রাখুন। প্রতিদিন। টিচার আর বাবা-মা এক না।
* হাত থাকতে মুখে কি? পিঠে ধুমধাম পড়লে ঠিকই সোজা হপে
আপনাকে কেউ যদি মারে আপনার কেমন লাগবে? আপনিও মানুষ, আপনার ছোট বাচ্চাটাও মানুষ। কারো গায়ে হাত তোলা তার প্রতি চুড়ান্ত অপমান। বাচ্চাটা হয়তোবা ভয়ে আপনাকে কিছু বলবেনা, চোখের জল ফেলতে ফেলতে পড়বে। কিন্তু সে কি ভালোবাসা থেকে পড়বে, নিজের আনন্দে পড়বে? পুরো পৃথিবীতে তার শেষ আশ্রয় আপনি। সেই আপনিই যখন তাকে মারবেন সে যাবে কোথায়? তাকে সাহস দিন, ভালোবাসা দিন। আপনি তাকে যেভাবে মোটিভেট করবেন সেভাবেই সে চলবে। তার গায়ে হাত তোলার কোন অধিকার আপনার নেই। সে একটা মানুষ। তার অপমানবোধ আছে, নিজের একটা মন আছে, চিন্তাভাবনার ক্ষমতা আছে। আপনার কাজ হলো সেগুলোকে ভালোভাবে চালিত করা, আরো কর্মক্ষম করা।
আপনি আজকে আপনার বাচ্চাকে যা শেখাবেন সেটাই সে একসময় আপনাকে ফেরত দেবে। সুতরাং, সাধু সাবধান।
বি.দ্র. ভিন্নমত থাকতে পারে অনেকের। এগুলো জাস্ট পার্সোনাল অপিনিয়ন। তবে সবই নিজের চোখে দেখা, অনুভব করা। যে কোন ধরণের আলোচনা ওয়েলকাম। সময় পেলে ২য় পর্ব লিখতে পারি।
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই জানুয়ারি, ২০১৪ রাত ৯:১৩