একদিন বোটক্লাব থেকে ফিরছিলাম। ফিরতে ফিরতে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গেল। সন্ধ্যা মানে রাত ৮টা হবে হয়ত! শহুরে যানজটের কর্মকোলাহল থেকে বেরিয়ে আসা মাত্রই এক প্রশান্তির দীর্ঘশ্বাস নিলাম। তবে দিনের শহরের তুলনায় রাতের শহরটাকে কেন যেনো আমার কাছে অন্যরকম মনে হয়। অন্যরকম ভালোলাগে আরকি!
বিশেষ করে বাহারি আলোকছটাকে আমি খুব উপভোগ করি। তবে বর্ণালি আলোকছটা ভালোলাগলেও ভালোলাগে না অপরিমিতমাত্রার হর্ন। আমার ধারণা এ দেশের যানচালকেরা হর্নের মাত্রাজ্ঞান সম্পর্কে জ্ঞাত নয়; কিংবা সচেতন নয় হর্নের ভয়াবহ কুফল সম্পর্কেও। এদেশে লাইসেন্স প্রাপ্তির ব্যাপারটা এখন কে—না জানে বলুন? মোদ্দাকথা, বাঙালি মানেই আইন মানার চেয়ে না মানার প্রবণতাই বেশি।
সে যাইহোক। দীর্ঘ জার্নির ধকলে আমাদের অনেকেরই তন্দ্রা ভাব চলে এসেছিল। কেবল আমাদের সঙ্গী—সাথিদের মধ্যে নাবহান আলভি মুক্তই ছিল সবার চেয়ে ছোটো। সবার ছোটো হলে কী হবে? টিমের মধ্যে সে—ই ছিল সবচেয়ে চঞ্চল, বুদ্ধিদীপ্ত আর কর্মঠপ্রাণ। নানা খুনসুটির মধ্য দিয়েই আমরা বাসার দিকে ফিরছিলাম। এটা কেন? ওটা কেন? ওটা ওরকম কেন? এটা কী? ওটা এরকম হলো কেন? এরকম কত—শত প্রশ্ন! কখনো কখনো খুব বিরক্ত লাগত কিন্তু কখনোই উষ্মা প্রকাশ করিনি। করিনি একারণে যে—তার আগ্রহের জায়গাটাকে আমি সাপোর্ট করি, ভালোবাসি। শিশুর মনস্তাত্ত্বিক বিকাশে এটা খুবই জরুরি। তাদেরকে প্রশ্ন করার সুযোগ দিতে হবে; আবার গল্পে কৌতূহলও সৃষ্টি করতে হবে। কৌতূহল সৃষ্টি হলে তারা নিজ থেকেই সক্রিয় হয়ে অংশগ্রহণ করে। পঠনপাঠনেও একই নিয়ম প্রযোজ্য। তার মনে হলো পড়ার প্রতি তার আগ্রহ সৃষ্টি করতে হবে।
মুক্তর বহুমাত্রিক প্রশ্নে অন্যরাও খুব মজা পেত। আমিই একাধারে গল্প বলে যাচ্ছিলাম। গল্প শুনতে শুনতে কখন যে সে ঘুমিয়ে গেল কেউ টেরই পেলাম না! যখন টের পেলাম, তখন দেখলাম গাড়ি বাসার একেবারে কাছে চলে এসেছে। গাড়ি থেকে নেমে বাধ্য হয়েই তাকে কোলে নিলাম। একেবারেই গা ছেড়ে দিয়েছে। মনে হচ্ছিল অন্যদিনের তুলনায় যেনো ওজন দ্বিগুণ বেড়ে গেছে!
মুক্তর ওজন আঠারো কি উনিশ কেজি হবে! তিন তলার সিঁড়ি পর্যন্ত উঠতে খুবই কষ্ট হচ্ছিল। কেননা, সমস্ত দিনই আমরা হই—হুল্লোর করে কাটিয়েছি। সুতরাং সেদিক থেকে চিন্তা করলে শারীরিক স্টেমিনা অনেকটাই কমে এসেছিল।
যাইহোক, তাকে সরাসরি বেডরুমে নিয়ে গেলাম। বিছানায় শুইয়ে নকশিকাঁথাটা গায়ে জড়িয়ে দিয়ে প্রশান্তির দীর্ঘশ্বাস নিতেই ছেলেটি হেসে উঠল। কিউটকণ্ঠে বললো— আমি তো ঘুমাইনি, আব্বু! তোমাদের বোকা বানিয়েছি!
আমি অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। বিস্মিতকণ্ঠে বললাম—মানে কী? মুক্তর সমস্ত চোখেমুখে তখন হাসির বন্যা। অনেকটা মাউন্ট এভারেস্ট জয়ের মতোই ব্যাপার! পাঁচ বছরের ছেলেটা দেহ—মনে পৃথিবীর সেরা অভিনেতার মতো ভাব এনে বলল— আমি যদি ঘুমের ভাব না ধরতাম, তবে কি আমায় কোলে করে তিন তলায় আনতে?
পৃথিবী নামক রঙ্গমঞ্চে আমরা সবাই তো এক—একজন অভিনেতা! কেউ খুদে, কেউবা বৃহৎ, কেউ দক্ষ কেউ বা অদক্ষ! তবে দক্ষদের প্রাপ্তিযোগই বেশি।
কী একটা বলতে গিয়েও আমি থেমে যাই। ওর নিখুঁত অভিনয়ের প্রতি মুগ্ধ হয়ে পরক্ষণে আমরাও অট্টহাসিতে ফেটে পড়ি।
২১শে ডিসেম্বর ২০২২ খ্রিষ্টাব্দ
মুনশিপাড়া, মধ্যম হালিশহর, চট্টগ্রাম
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে ডিসেম্বর, ২০২২ রাত ১০:০২