কৃতজ্ঞতা এবং স্বীকারোক্তি: ছবিগুলো গুগল এবং ফেসবুক থেকে নেওয়া।
ফেসবুক বা ভার্চুয়াল মিডিয়াগুলো অপেন করলেই দেখা যায় অসংখ্য মানুষ হিরো আলমের ছবি বিকৃত করে তাকে নানা নামে ভূষিত করেছে। কেউ বা নাম দিয়েছে কবি হিরোন্দ্রনাথ! কেউবা হিরোন্দ্রনাথ ঠাকুর, কেইবা পুতিন্দ্রনাথ, আবার কেউবা হিরো গেইল! আরও যে কত কী, সে কী আর ইয়ত্তা আছে! যে ছবিগুলো ফটোশপে কাজ করেছে সে নিঃসন্দেহে ক্রিয়েটিভ। ফটোশপের একজন খুদে কর্মী হিসেবে আমি জানি, এই ছবি নিখুঁত করতে তাকে অনেক শ্রম দিতে হয়েছে। কিন্তু কুৎসা রটানোর কাজে কেন এমন সৃজনশীল সময়ের অপব্যয়? কেন এ বিকৃত মানসিকতা? তবে এটা ঠিক—অনেকেই তো বিকৃত যৌনাচারেও তৃপ্তিবোধ করে! তারা কি আর স্বাভাবিক প্রকৃতির?
আপনি বা আপনারা তো সুযোগ পেলেই হিরো আলমকে একহাত নিয়ে নেন! সুযোগ পেলেই তাকে নিয়ে ট্রলে মেতে ওঠেন। উপহাস করতে বিন্দুমাত্রও কার্পণ্যবোধ করেন না। কিন্তু কেন করেন—বলুন তো? সে দেখতে কালো বলে? সে খর্বাকায় কিংবা বেঁটে বলে? তার দাতেঁর পাটি উঁচু বলে? অভিনয় ভালো পারে না বলে? বারবার তার কর্মগুলো ভাইরাল হয় বলে? সে ভাইরাল হলে আপনার কি হিংসে হয়? একটু হিসাব মিলিয়ে দেখুন তো!
যদি প্রথম বা দ্বিতীয় কারণ হয়, তবে জেনে রাখুন—মানুষ সাদা কিংবা কালো, লম্বা বা খাটো হওয়াতে ব্যক্তির নিজের কোনো হাত থাকে না। মেডিক্যাল সাইন্স তাই বলে। এর প্রমাণের জন্য দূরে যাওয়ার প্রয়োজন নেই, আপনার পরিবারেই খেয়াল করে দেখুন। দেখবেন আপনার পরিবারের সদস্যরা একেকজন একেক বর্ণের, একেক মতের, একেক পথের। কাজেই যাতে ব্যক্তির কোনো হাত থাকে না, তা নিয়ে ট্রল না করাই ভালো।
বিখ্যাত ফুটবলার রোনালদিনহোর ওপরের পাটির দাঁত একটু উঁচু এবং সে দেখতে কৃষ্ণবর্ণের। কিন্তু তা হলে কী হবে—আবালেরা তাকে নিয়ে ট্রল করতেও ছাড়েনি। এক সাংবাদিক তো কটাক্ষের স্বরে সরাসরি রোনালদিনহোর প্রেমিকাকেই প্রশ্ন করে বসলেন—রোনালদিনহোর তো দাঁত উচু, দেখতেও কালো; আপনি কেন তাকে ভালোবাসেন? প্রেমিকাও ছিলো সেইরকম বিচক্ষণ। যে ইটকেলটির বিনিময়ে পাটকেলটি মারতে জানতো। সে মৃদু হেসে বললো—তার উঁচু দাঁতের কারণেই আমি তাকে ভালোবাসি। একবার ভেবে দেখুন, যারা তাকে নিয়ে ট্রল করেছিলো তারা কালের স্রোতে হারিয়ে গেছে। রোনালদো কিন্তু ঠিকই তার উদ্যম, পরিশ্রম ও সৃষ্টিশীলতা দিয়ে নিরন্তর সামনের দিকে এগিয়ে চলছে।
এতে কী বোঝা গেল? ট্রল করে অন্যের সাময়িক ক্ষতি করা যায় বটে, কিন্তু সত্যিকারের সৃষ্টিশীলদের পথ কখনোই রোধ করে রাখা যায় না। সূক্ষ্মদৃষ্টিতে বিচার করলে দেখবেন, ট্রলে কেবল আপনার দীনতার পরিচয় স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হয়ে উঠছে, আপনার জীবনের মূলবান সময়েরও অপচয় হচ্ছে!
এবার আসুন অভিনয়ের ব্যাপারে। অভিনয়ের সর্বজনীন ভালোর কোনো মাপকাঠি নেই। সর্বজননী ভালোর মাপকাঠি নেই সাহিত্যেও। ‘পথের পাঁচালী’ উপন্যাসের স্রষ্টা নোবেল পুরস্কার না পেলেও বাঙালির কাছে, বাংলা ভাষাভাষী পাঠকের কাছে তার আবেদন কোনো অংশেই কম নয়!
জীবনানন্দ দাশ জীবিতকালে বলতে গেলে কোনো পুরস্কারই তো পাননি; তাকে বলা হতো ছাগল কবি! কিন্তু দেখুন প্রকৃতির কী বিচার! বর্তমান তরুণ প্রজন্মকে সবচেয়ে বেশি আলোড়িত করে যাচ্ছে জীবনানন্দ দাশের কবিতাগুলো। কাজেই পুরস্কার এবং ভালোর সর্বজনীন মাপকাঠি নেই। অভিনয়েরও নেই। আপনার কাছে যে অভিনয় ভালো লাগে দেখবেন আপনার পরিবারের অন্য সদস্যেরই সে অভিনয় ভালো লাগছে না।
দেখুন, হিরো আলমের অভিনয়ের যারা সমালোচনা করে, হাসাহাসি করে; তাদের অভিনয় দেখে বলিউড দর্শকরা তো আরো বেশি হাসাহাসি করে। আবার বলিউডের অভিনয় দেখে সাউথের দর্শক সবগুলোকেই হিরো আলম মনে করে। ইন্ডিয়ান সিনেমা দেখে তো হলিউডের দর্শক বা অভিনেতারা হাসাহাসি করার মতো লেভেলেরও মনে করে না। এককথায়, সমাজের পাতা উলটালেই দেখবেন যে, আমরা সবাই কারো না কারো কাছে হিরো আলম!
তার কাজের মূল্যায়ন নাইবা করলেন; তাকে পছন্দ করার কথাও বলি ন। কেবল তার প্রচেষ্টাকে ইতিবাচক ভাবতে বলছি।
সে যে পরিবার থেকে উঠে এসেছে, যে প্রতিকূল অবস্থা থেকে উঠে এসেছে, আপনার দ্বারা কি এত এত প্রতিকূলতা অভারকাম করে এ পর্যন্ত আসা সম্ভব হতো? আপনি কয়জনের ভরণপোষণের দায়িত্ব নিয়েছেন? পরিবারের সদস্যদের? সমাজের কথা না-হয় নাইবা বললাম! উপরের দিকে থুথু দেওয়ার আগে ভাববেন, থুথু যেনো নিজের মুখে না পড়ে!
খোঁজ নিয়ে দেখুন, যাকে নিয়ে আপনি ট্রল করছেন সে অনেকেরই দায়িত্ব নিয়েছেন। অনেক ভালো কাজের সঙ্গেই সে জড়িত; যা আপনি আমি অনেকের পক্ষেই সম্ভব নয়! ওইযে, বলে না— কেবল ধন থাকলেই হয় না, মনও থাকতে হয়।
আপনি তো হিরো আলমকে নিয়ে হরহামেশাই ট্রল করছেন। আপনাকে নিয়ে কেউ ট্রল করলে আপনার কেমন লাগবে? কিংবা কড়া সমালোচনা? হজম করতে পারবেন তো? বলি আপনাকে কয়জনে চিনে? আপনার কী এমন সৃষ্টিশীল কর্ম রয়েছে? আর থাকলে তা একবার পাবলিক করেই দেখুন না—নিজের কর্মের অবস্থান বুঝতে পারবেন!
‘পবিত্র’ শব্দটি যেমন আপেক্ষিক তেমনই ভালো শব্দটিও। স্থান-কাল-পাত্র-ভেদে ভালো শব্দটিও ভিন্ন ভিন্ন অর্থ আর ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টি পরিগ্রহ করে। একের কাছে যা ভালো তা অন্যের কাছে তা ভালো নাও লাগতে পারে।
মনে করুন, ঘুসের ব্যাপার। আপনি হয়ত ধর্মগ্রন্থ এবং নৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করে ঘুসকে কোনোভাবেই সাপোর্ট করবেন না; কিন্তু সাবেক অর্থমন্ত্রী স্পিড মানিকে কাজ ত্বরান্বিত করার হাতিয়ার হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন। তাও খুদ পার্লামেন্টে!
হিরো আলমের ভুলভাল সংস্কৃতি চর্চায় হয়ত আমরা মুগ্ধ নই, কিন্তু তার চেষ্টা করার অধিকারের জন্য অবশ্যই আমাদের সমর্থন থাকা উচিত। কেননা, এটা যে আমাদের প্রত্যেকেরই মৌলিক অধিকারের প্রশ্ন।
আমরা নিজের বেলায় কেবলই উকিল কিন্তু অপরের বেলায় সর্বদাই কড়া সমালোচক! সমালোচনা সর্বদাই পজেটিভ যদি তা সত্যিকারের সমালোচনা হয়। কিন্তু বাংলাদেশে আমরা যা করি তা সমালোচনার নামে বিরোধীতা! কজেই এ জাতীয় সমালোচনার সমালোচক কখনোই পূজনীয় হতে পারেন না!
হিরো আলম শুধু বাংলাদেশেই নয়, পুরো দক্ষিণ এশিয়াতেই সে আলোচনায় বা জনপ্রিয়তায় দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে। তাকে নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার অন্ত নেই! অপ্রিয় হলেও সত্যি যে, একশ্রেণির সাংবাদিকরা, ইউটিউবাররা তার সংবাদ পরিবেশন করেই প্রতিনিয়ত জীবিকা নির্বাহ করছেন। সত্য-মিথ্যার মিশেলে কেবল টিআরপি বাড়ানোর ধান্দায় ব্যস্ত! হিরো আলমের সংবাদ অবলম্বনে জীবিকা নির্বাহ করলে কী হবে, এদের ন্যূনতম কৃতজ্ঞতাবোধ নেই। এদের প্রচারণায় কেবলই পাবেন নেতিবাচক তথ্য-উপাত্তের বিদঘুটে সমাহার। বলতে পারেন এরা এক-একজন অনন্য উচ্চতার নিন্দার স্পাম ডোনার!
তবে কেউ কেউ ইতিবাচক ভাবেই তার কর্মগুলোকে মূল্যায়ন করার চেষ্টা করছেন। এদের মধ্যে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ড. মীজানুর রহমান অন্যতম। তিনি তাঁর একটি বইয়ে হিরো আলমের নাম ইতিবাচকভাবেই উদ্ধৃত করেছেন। আবার কেউ কেউ তাকে নিয়ে কবিতাও লিখছেন। একেবারেই যে তাকে সাপোর্ট করে না বিষয়টি এমন নয়। তবে এদের সংখ্যা খুবই নগন্য। স্রোতের অনুকূলে ৯৯% শতাংশ লোকই হাঁটেন। যিনি স্রোতের প্রতিকূলে হাঁটেন, পলিসি এবং কর্মযজ্ঞের কারণে তিনি অনন্য।
নিত্য সমালোচনাকে হজম করে সকলেই টিকে থাকতে পারে না। যেমন পারেননি ৪০ বছর বয়সি অধ্যাপিকা খাইরুন নাহার। তিনি নাটোরের গুরুদাসপুর উপজেলার খুবজীপুর এম হক ডিগ্রি কলেজের সহকারী অধ্যাপক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। ২২ বছর বয়সি ছাত্র মামুনকে বিয়ে করাই তার জন্য কাল হলো। চরম সমালোচনায় পর্যবশিত হয়ে তাদের জীবন হয়ে উঠেছিল বিভীষিকাময়। বাকিটা তো ইতিহাস! কাজেই বলা যায়, প্রচণ্ড সমালোচনার বন্যায় সবাই টিকে থাকতে পারে না। যারা টিকে থাকে আর আত্মপ্রত্যয়ে বলিয়ান হয় মূলত দিনশেষে তারাই সফল হয়।
অবশ্যই এই হিরো আলমকে আমি ইতিবাচকভাবে দেখি। একের পর এক ভিন্ন রুপে নিজেকে উপস্থাপন করছে। কখনো অভিনেতা, কখনো, পরিচালক, প্রযোজক, রাজনীতিবিদ, সমাজসেবক ইত্যাদি। কঠোর পরিশ্রম করছে নিজেকে একটা পর্যায়ে পৌছানোর জন্য। কাউকে তো আর তোষামোদ করে ওপরে উঠার চেষ্টা করে না। তোষামোদী এই সমাজে তার পরিশ্রমকে স্যালুট না জানানোই বরং অপরাধ!
হিরো আলমের যারা বিরোধিতা করে; তারা হয় হিংসায় না হয় নিজের অযোগ্য ওই কাজের অথবা প্রেস্টিজ ইস্যুতে ভোগে। তারা এটাও বুঝে না যে, একজনের প্রতিভার মূল্যায়ন করা মানে তার কাজকে সমর্থন করা নয়। আমরা এখনো ৯৫% মানুষ ঔপনিবেশিক দাসত্বের শৃঙ্খলে বন্দি। আমাদের চিন্তা করার যোগ্যতা নাই; তাই কারো এগিয়ে যাওয়াকেও পছন্দ করি না।
একবার ভাবুন তো, আপনাকে ধরে নিয়ে রাষ্ট্রযন্ত্র যদি বলে আপনার নাম পরিবর্তন করতে— আপনার কি ভালো লাগবে? তা আপনি যে লেভেলেরই সংস্কৃতিকর্মী হোন না কেন! ভাবার মতো বিষয় হলো—একজন ফানিম্যানকে রাষ্ট্রযন্ত্র ধরে নিবে, তার নাম বদলাতে বলবে কীসের অধিকারে?
এটা মনে রাখা উচিত যে, কাঁটা দিয়েই কাঁটা তুলতে হয়। ফানকে ফান দিয়ে মোকাবিলা করতে হয়। আর তা না করে, অস্ত্র দিয়ে মোকাবিলা করছে রাষ্ট্র—এটা নিঃসন্দেহে প্রশ্নবিদ্ধ কাজ। বলতে গেলে বর্তমানে এটাই কর্পোরেট কালচারের অংশ। কারণ, কর্পোরেট শ্রেণি বিনিয়োগ করেও লস করছে, আর হিরো আলম বিনিয়োগ না করেও কামাচ্ছে। আর এটাই তাদের জন্য হুমকি। এতো অল্প পুঁজিতে এতো বিপুল ব্যবসা সে করে যাচ্ছে! তা-ই তাদের চরমভাবে ভাবাচ্ছে।
হিরো আলম কি রাষ্ট্রদ্রোহী? চিহ্নিত সন্ত্রাসী? ধর্ষক? দুর্নীতিবাজ? ধর্মচ্যুত? লোটেরা? কোনোটাই যদি না হয় তবে, আপনার বা আপনাদের বা রাষ্ট্রের এতো মাথা ব্যথা কেন? তার চেষ্টার অধিকার কেড়ে নেওয়ার অধিকার আপনার, আপনাদের বা রাষ্ট্রের নেই। এটা তার মৌলিক অধিকারের প্রশ্ন।
মনে রাখবেন, ট্রল করে কেউ কখনোই বড়ো হয় না, আপনি বড়ো হননি। বরং সূক্ষ্মদৃষ্টিতে বিচার করলে এটা স্পষ্ট হবে যে, আপনার বড়ত্বকেই ছোটো করেছেন। মিলিয়ে নিন—আপনি, আমি হিরো আলমকে চিনি, কিন্তু সে আমাদের কাউকেই চিনে না!
তার সকল কন্ট্রোভার্সি যদি আমরা বাদ দিই, তবে হিরো আলম থেকে আমাদের শিখার অনেক কিছুই আছে। সেটা হলো সামনে যাই আসুক না কেন, মানুষ যতই তাকে নিয়ে বাজে কথা বলুক না কেন, তাকে নিয়ে হাসাহাসি বা ট্রল করুক না কেন, এই পৃথিবীতে থেমে থাকলে চলবে না। সকল বাধা আর সমালোচনা পিছনে ফেলে সামনে এগিয়ে যেতে হবে । হিরো আলমের এই গুণ নিঃসন্দেহে অন্যকে অনুপ্রাণিত করে। এই পৃথিবীতে অনেকেই আপনাকে থামিয়ে দিতে চাইবে। কিন্তু আপনার লক্ষ্য অর্জনের পথে থেমে গেলে চলবে না। সৎসাহসের সঙ্গেই এগিয়ে যেতে হবে।
বাউল সম্রাট শাহ্ আব্দুল করিমকে একবার এক সাংবাদিক প্রশ্ন করেছিলেন—আচ্ছা, আপনার গান যে অনেক মানুষই বিকৃত স্বরে গায় এতে আপনার খারাপ লাগে না? বাউল সম্রাট মুচকি হেসে উত্তর দিয়েছিলেন, মোটেই না। সবাই একই সুরে কখনোই গানটি গাইতে পারবে বলে আমি বিশ্বাস করি না। তবে আমার ভালোলাগার ব্যাপার হলো—তারা আমার গানটিই তো গাইছে। ভালোবেসেই তো গাইছে। আমি যে আমার কথার মাধ্যমে তাদের মনে ঠাঁয় করে নিতে পেরেছি ওইখানেই আমার সার্থকতা।
অপ্রিয় সত্য হলো, জ্ঞাতসারে কেউ কখনোই কোনো জনপ্রিয় গান বিকৃত স্বরে গাইতে চায় না। চেষ্টা করে মূলের কাছাকাছি যেতে। মূলের কাছে যেতে পারলে ভালো। সাধুবাদ। কিন্তু প্রচেষ্টা সত্ত্বেও যেতে পারেনি এজন্য তাকে কোনোভাবেই দণ্ড দেওয়া যাবে না। বরং তার এই প্রচেষ্টাকেই স্বাগত জানানো উচিত।
বলছিলাম হিরো আলম সম্পর্কে। গান বিকৃত করার অপরাধে তার নামে আইনি নোটিশ হয়েছে। জেনে রাখা ভালো যে, হিরো আলম জনপ্রিয়তায় দক্ষিণ এশিয়ায় দ্বিতীয়তম স্থানে রয়েছে। শাহরুখখানের পরই হিরো আলমের স্থান। গুগল সেরকমই তথ্য দিয়েছে। ট্রল করেই হোক আর ভালোবেসেই হোক পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ তার কর্মকাণ্ড দেখার জন্য তার নাম দিয়ে গুগলে সার্চ করে।
বস্তুত জনপ্রিয় ব্যক্তিদের অনেকেই ঈর্ষা করে। হিরো আলমকে পছন্দ করে এমন মানুষও যেমন প্রচুর রয়েছে আবার হিরো আলমকে অপছন্দ করে এমন মানুষের সংখ্যাও নেহায়েত কম নয়। আবার কিছু মানুষ পছন্দ অপছন্দের ধার ধারে না। বরং নীরবে তার বিনোদনমূলক সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড দেখে পুলকিতবোধ করে। কেউ কেউ আবার হিংসাও করে। কেউ কেউ আবার ধান্দায় থাকে। মহা ধান্দায়! জনপ্রিয়দের পুটকি চুলকিয়ে মিডিয়ার মাধ্যমে যদি নিজে একটু জাতে ওঠা যায় তাতে মন্দ কী!
আসুন আরও কিছু বস্তুনিষ্ঠ যুক্তির মুখোমুখী হই—
আপনি কী করেন? কোনো জব? সরকারি বা বেসরকারি? ব্যবসা করেন? যাইহোক, দিনের কতটা সময় নিজের জন্য ব্যয় করেন আর কতটা পরিবারের জন্য আর কতটা সময় জনকল্যাণে? একটু হিসেব করুন তো! মনে করুন আপনি বর্তমানে সময়ের সবচেয়ে উচচ্চশিক্ষত, স্মার্ট লোক। সার্টিফিকেটের দোহাই দিয়ে কি ড্যান ব্রাউনের মতো ‘দ্য দা ভিঞ্চি কোড’ লিখতে পারবেন? আপনি চাইলেও রবীন্দ্রনাথ হতে পারবেন না, নজরুল হতে পারবেন না, জগতবিখ্যাত ড্যানব্রাউন হতে পারবেন না। কেউ কারো মতো হয় না। প্রত্যেকেই তার নিজের মতো করেই বড়ো হয়, বেড়ে ওঠে। প্রত্যেকের মধ্যেই নিজস্বতা রয়েছে। এটা অস্বীকারের উপায় নেই। ইংরেজিতে একটা প্রবাদ আছে, It is very easy to find fault with others অর্থাৎ অপরের দোষ ধরা সহজ। আমরা কখনোই আত্মসমালোচনায় বিশ্বাসী নয়, বরং আমৃত্যু অপরের সমোলোচনায় বিশ্বাসী।
আপনি কী পারেন? মানুষকে হাসাতে পারেন? কাঁদাতে পারেন? জনকল্যাণমূল কাজ করতে পারেন? কতটুকু পারেন? আসলেই কি পারেন? মানুষকে হাসানোর কাজ হলো পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী কাজ। বিশ্বাস না হলে হাসির গল্প লিখে দেখুন, হাসির নাটক লিখে দেখুন, আপনার সুচিন্তিত কর্ম দ্বারা মানুষকে হাসানোর চেষ্টা করুন। দেখুন তো কতটুকু পারেন?
ভাইরে, সাবেক অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান যখন সংসদে বক্তৃতা দিতেন তখন তার বক্তৃতার ভাঁজে ভাঁজে সিলেটী ভাষার সুঘ্রাণ পাওয়া যেত, বর্তমানে পরিকল্পনা মন্ত্রী যখন কথা বলেন, তখন দেখবেন তার কথাতেও কমলালেবুর ঘ্রাণ থাকে। কিন্তু এই কমলালেবুর দোহাই দিয়ে তাদের ছোটো করা মোটেই যুক্তিযুক্ত হবে না। বিচার করতে হবে তাদের কাজের জায়গা থেকে। অর্থাৎ তাদের কাজের জায়গায় তারা কতটুকু সফল? দেখবেন উভয়েই প্রায় শতভাগ সফল!
দার্শনিক এরিস্টল সম্পর্কে তার শিস্যরা বলতো, বিশ্বের তাবৎ জ্ঞান সম্পর্কেই সে ধারণা রাখে। জ্ঞান অন্বেষণের জন্য এরিস্টটল সর্বব্যাপী। এজন্য কখনোই তো কাউকে এরিস্টটলকে দোষ দিতে দেখিনি। কেউ তো বলেনি—এক হাতে সব ধরতে নেই!
এবার আসুন ক্রিকেট খেলার মাঠে। আইপিএল বলেন আর জাতীয় বা আন্তর্জাতিক খেলাই বলেন—সব অঙ্গনেই অলরাউন্ডারের অগ্রাধিকার বেশি। যারা অলরাউন্ডার হতে চায় আমরা কি তাকে কখনো দোষী হিসেবে চিহ্নিত করি?
এবার আসুন ড্রাইভিংয়ের ক্ষেত্রে। যে রিক্সা থেকে শুরু করে, সিএনজি, প্রাইভেট কার, নোহা, লাইটেস, বাস এমনকি ট্রাকও চালাতে জানে কিংবা ট্রাক চালানো শেখার চেষ্টা করে আমরা কি তাকে কখনো খারাপ ভাবি? মোটেই না। বরং অ্যাপ্রোশিয়েট করি। এই বলে যে, কাজ শিখে রাখা ভালো। কেননা, শেখা জিনিস জীবনের বাঁকে বাঁকে কাজে লাগে।
এবার আসুন সংস্কৃতির ক্ষেত্রে কেউ যদি আধুনিক গান গায়, লোকগীতি গায়, নজরুল গীতি গায় কিংবা রবীন্দ্র সংগীত গায় অর্থাৎ সংস্কৃতির সব শাখায়ই যে অবদান রাখতে চায় তাকে আমরা কেন খারাপ বলবো? বাংলাদেশের আইনে সংস্কৃতি চর্চা নিষিদ্ধ নয়। নির্দিষ্ট কারো জন্যও সীমাবদ্ধ নয়! রবীন্দ্রনাথ কি শুধু গান লিখেছেন? কিংবা শুধু উপন্যাস? নাকি সাহিত্যের সকল শাখাতেই বিচরণ করার চেষ্টা করেছেন? তাঁর ক্ষেত্রে অলরাউন্ডার হলে যদি দোষের কিছু না হয় তবে এ নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে।
এখন আসুন শুদ্ধাশুদ্ধির বিষয়ে। এই মুহূর্তে বাংলাদেশের সকল এমএ পাশ চাকরিজীবীদের প্রমিত ভাষা ব্যবহার করে একটি দরখাস্ত লিখতে বলুন, এটাও বাদ দিলাম প্রত্যেককেই বলুন অফিসে শুদ্ধ ভাষায় বা মান ভাষায় কথা বলতে-সম্ভব? মোটেই না। তাহলে ফলাফল কী দাঁড়ালো? সবোর্চ্চ ডিগ্রিই সব নয়। যারা শুদ্ধ করে কথা বলতে পারে না, তাদের নামে মামলা ঠুকে দিবেন?
এবার আসুন ধর্মীয় ক্ষেত্রে। এক লক্ষ খুব জানাশোনা লোককে কোরান তিলাওয়াত করতে দিন। সহিশুদ্ধ করে কয়জনে পারবে? ৫% বা ১০%। সর্বোচ্চ ২০%। বাকী যারা পারেনি, পারে না, তাদের নামে মামলা ঠুকে দিবেন?
এবার আসুন জাতীয় সংগীতে। দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই নানা ওকেশনে জাতীয় সংগীত গাওয়া হয়। সবাই কি ঠিকভাবে গাইতে পারে? প্রশিক্ষণ দেওয়ার পরও পারে? সব শিক্ষকও কী পারে? যারা পারে না, তাদের নামে কি রাষ্ট্রীয় মামলা হয়?কেই মামলা করে?
তাহলে অতি উৎসাহী হয়ে কে মামলা করে? কারা মামলা করে? বুঝতে হবে ঈর্ষাকাতর হয়েই এসব করে। উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবেই তারা করে। বাঙালিদের ন্যাচারাল ট্রেন্ট হলো কেউ উপরে উঠতে চাইলে তাকে নানাভাবে নিচের দিকে নামানোর চেষ্টা করা। কেউ উপরের দিকে তুলে দেবার চেষ্টা করবে না।
ভাইরালের যুগে এখন অধিক জনপ্রিয়রাই সবচেয়ে বেশি সমালোচনার শিকার হচেছন। পান থেকে চুন খসলেই ট্রলের শিকার হচ্ছেন, বোলিংয়ের শিকার হচ্ছেন?
এই ট্রল কারা করে? নিশ্চয়ই আপনার আমার মতো শিক্ষিত স্বজনরা! এই গড্ডলিকা প্রবাহে কে গা ভাসিয়ে দেয়? নিশ্চয়ই আপনার আমার মতো শিক্ষিত স্বজনরা!
ব্যক্তিভেদে রুচি ভ্যারি করে। সব উচ্চশিক্ষত লোকই রবীন্দ্রসংগীত পছন্দ করে না। কেউ নজরুল সংগীত, কেউ আধুনিক গান, কেউ লালগীতি, কেউ লোকগীতি, বাউল গান, ভাটিয়ালি, ভাওয়াই, পল্লগীতি… ইত্যাদি গান শোনে। কেউ দেশীয় সিনেমা পছন্দ করে আবার কেউ বিদেশী সিনেমা পছন্দ করে। কেউ ডিপ বিনোদন পছন্দ করে আবার কেউবা চটুল বিনোদন পছন্দ করে। পছন্দের রুচির জন্য ব্যক্তি একাও আবার দায়ী নয়। পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র দায়ী। সাংস্কৃতিক কোন সৃষ্টকর্ম আপনার পছন্দ না হলে এড়িয়ে চলুন। নিজেও চেষ্টা করবেন না, আবার অপর কেউ চেষ্টা করলেও বাধা দিবেন বা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবেন—এটা তো মোটেই শোভনীয় ব্যাপার নয়।
মনে করুন, নানা দিক থেকেই আপনি জনপ্রিয়। আপনার কোনো শত্রু নেই। আপনার এই আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা নিয়ে যেদিন আপনি নির্বাচনে নমিনেশন দাখিল করবেন দেখবেন কাকতালীয়ভাবে সেদিন থেকেই কোনো কারণ ছাড়াই আপনার জনপ্রিয়তা কমতে শুরু করেছে।
একশ্রেণির মানুষ অযথাই আপনার আপনার বংশের চুলচেরা বিশ্লেষণ করে আপনাকে নাকানিচুবানি খাওয়ানোর চেষ্টা করবে। অযথাই হয়রানির চেষ্টা করবে। জনপ্রিয়দের যেমন শোভাকাঙ্ক্ষীর অভাব নেই, তেমনই শত্রুরও কমতি নেই।
মানুষ তার সহজাত প্রবণতা নিয়েই জন্ম নেয়, বেড়ে ওঠে। বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি সমালোচনার তিরে বিদ্ধ হয় শিক্ষক, ইমাম আর সংস্কৃতিজগতের কর্মীরা।
সৃষ্টির আদি থেকে যারাই কিছু করতে চেয়েছে, তারাই কোনো না কোনোভাবে বাধাগ্রস্ত হয়েছে। সত্য হলো, যারা বাধা দিয়েছে মহাকাল কখনোই তাদের মনে রাখে না। বরং যারা করার চেষ্টা করে, করে দেখায় তাদের কর্মকেই মনে রাখে। আর সে কর্মের মধ্যে দিয়ে সে কর্মের স্রষ্টাও বেঁচে থাকেন।
কেউ কিছু করতে চাইলে বাধা প্রদান না করে বরং তাকে সহযোগিতার মনমানসিকতা দেখানো উচিত। সমালোচনার নামে বিরোধিতার মনমানসিকতা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে।
হিরো আলমের প্রতি স্যালুট। তার প্রচেষ্টার প্রতি শ্রদ্ধা। দেশের সমস্ত কর্পোরেট দাসত্বের মোকাবিলায় সে এক অনন্য উপমা। বাংলাদেশে গড্ডলিকা প্রবাহে গা ভাসানো দাসদের মোকাবিলায়, কর্পোরেট শ্রেণি ও সংস্কৃতির মোকাবিলায়—হিরো আলম কিংবা হিরো আলমদের উত্থান খুবই জরুরি। জয় হোক আত্মবিশ্বাসী আর পরিশ্রমীদের।
মুনশি আলিম
৩১.১০.২০২২
উপশহর, সিলেট
[email protected]
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই নভেম্বর, ২০২২ রাত ১২:২৭