বাউল সম্রাট শাহ্ আব্দুল করিমকে একবার এক সাংবাদিক প্রশ্ন করেছিলেন-আচ্ছা, আপনার গান যে অনেক মানুষই বিকৃত স্বরে গায় এতে আপনার খারাপ লাগে না? বাউল সম্রাট মুচকি হেসে উত্তর দিয়েছিলেন, মোটেই না। সবাই একই সুরে কখনোই গানটি গাইতে পারবে বলে আমি বিশ্বাস করি না। তবে আমার ভালোলাগার ব্যাপার হলো—তারা আমার গানটিই তো গাইছে। ভালোবেসেই তো গাইছে। আমি যে আমার কথার মাধ্যমে তাদের মনে ঠাঁয় করে নিতে পেরেছি ওইখানেই আমার সার্থকতা।
অপ্রিয় সত্য হলো, জ্ঞাতসারে কেউ কখনোই কোনো জনপ্রিয় গান বিকৃত স্বরে গাইতে চায় না। চেষ্টা করে মূলের কাছাকাছি যেতে। মূলের কাছে যেতে পারলে ভালো। সাধুবাদ। কিন্তু প্রচেষ্টা সত্ত্বেও যেতে পারেনি এজন্য তাকে কোনোভাবেই দণ্ড দেওয়া যাবে না। বরং তার এই প্রচেষ্টাকেই স্বাগত জানানো উচিত।
বলছিলাম হিরো আলম সম্পর্কে। গান বিকৃত করার অপরাধে তার নামে আইনি নোটিশ হয়েছে। জেনে রাখা ভালো যে, হিরো আলম জনপ্রিয়তায় দক্ষিণ এশিয়ায় দ্বিতীয়তম স্থানে রয়েছে। শাহরুখখানের পরই হিরো আলমের স্থান। গুগল সেরকমই তথ্য দিয়েছে। ট্রল করেই হোক আর ভালোবেসেই হোক পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ তার কর্মকাণ্ড দেখার জন্য তার নাম দিয়ে গুগলে সার্চ করে। বস্তুত জনপ্রিয় ব্যক্তিদের অনেকেই ঈর্ষা করে। হিরো আলমকে পছন্দ করে এমন মানুষও যেমন প্রচুর রয়েছে আবার হিরো আলমকে অপছন্দ করে এমন মানুষের সংখ্যাও নেহায়েত কম নয়। আবার কিছু মানুষ পছন্দ অপছন্দের ধার ধারে না। বরং নীরবে তার বিনোদনমূলক সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড দেখে পুলকিতবোধ করে। কেউ কেউ আবার হিংসাও করে। কেউ কেউ আবার ধান্দায় থাকে। মহা ধান্দায়! জনপ্রিয়দের পুটকি চুলকিয়ে মিডিয়ার মাধ্যমে যদি নিজে একটু জাতে ওঠা যায় তাতে মন্দ কী!
আসুন আরও কিছু বস্তুনিষ্ঠ যুক্তির মুখোমুখী হই—
আপনি কী করেন? কোনো জব? সরকারি বা বেসরকারি? ব্যবসা করেন? যাইহোক, দিনের কতটা সময় নিজের জন্য ব্যয় করেন আর কতটা পরিবারের জন্য আর কতটা সময় জনকল্যাণে? একটু হিসেব করুন তো! মনে করুন আপনি বর্তমানে সময়ের সবচেয়ে উচচ্চশিক্ষত, স্মার্ট লোক। সার্টিফিকেটের দোহাই দিয়ে কি ড্যান ব্রাউনের মতো ‘দ্য দা ভিঞ্চি কোড’ লিখতে পারবেন? আপনি চাইলেও রবীন্দ্রনাথ হতে পারবেন না, নজরুল হতে পারবেন না, জগতবিখ্যাত ড্যানব্রাউন হতে পারবেন না। কেউ কারো মতো হয় না। প্রত্যেকেই তার নিজের মতো করেই বড়ো হয়, বেড়ে ওঠে। প্রত্যেকের মধ্যেই নিজস্বতা রয়েছে। এটা অস্বীকারের উপায় নেই। ইংরেজিতে একটা প্রবাদ আছে, It is very easy to find fault with others অর্থাৎ অপরের দোষ ধরা সহজ। আমরা কখনোই আত্মসমালোচনায় বিশ্বাসী নয়, বরং আমৃত্যু অপরের সমোলোচনায় বিশ্বাসী।
আপনি কী পারেন? মানুষকে হাসাতে পারেন? কাঁদাতে পারেন? জনকল্যাণমূল কাজ করতে পারেন? কতটুকু পারেন? আসলেই কি পারেন? মানুষকে হাসানোর কাজ হলো পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী কাজ। বিশ্বাস না হলে হাসির গল্প লিখে দেখুন, হাসির নাটক লিখে দেখুন, আপনার সুচিন্তিত কর্ম দ্বারা মানুষকে হাসানোর চেষ্টা করুন। দেখুন তো কতটুকু পারেন?
ভাইরে, সাবেক অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান যখন সংসদে বক্তৃতা দিতেন তখন তার বক্তৃতার ভাঁজে ভাঁজে সিলেটী ভাষার সুঘ্রাণ পাওয়া যেত, বর্তমানে পরিকল্পনা মন্ত্রী যখন কথা বলেন, তখন দেখবেন তার কথাতেও কমলালেবুর ঘ্রাণ থাকে। কিন্তু এই কমলালেবুর দোহাই দিয়ে তাদের ছোটো করা মোটেই যুক্তিযুক্ত হবে না। বিচার করতে হবে তাদের কাজের জায়গা থেকে। অর্থাৎ তাদের কাজের জায়গায় তারা কতটুকু সফল? দেখবেন উভয়েই প্রায় শতভাগ সফল!
দার্শনিক এরিস্টল সম্পর্কে তার শিস্যরা বলতো, বিশ্বের তাবৎ জ্ঞান সম্পর্কেই সে ধারণা রাখে। জ্ঞান অন্বেষণের জন্য এরিস্টটল সর্বব্যাপী। এজন্য কখনোই তো কাউকে এরিস্টটলকে দোষ দিতে দেখিনি। কেউ তো বলেনি—এক হাতে সব ধরতে নেই!
এবার আসুন ক্রিকেট খেলার মাঠে। আইপিএল বলেন আর জাতীয় বা আন্তর্জাতিক খেলাই বলেন—সব অঙ্গনেই অলরাউন্ডারের অগ্রাধিকার বেশি। যারা অলরাউন্ডার হতে চায় আমরা কি তাকে কখনো দোষী হিসেবে চিহ্নিত করি?
এবার আসুন ড্রাইভিংয়ের ক্ষেত্রে। যে রিক্সা থেকে শুরু করে, সিএনজি, প্রাইভেট কার, নোহা, লাইটেস, বাস এমনকি ট্রাকও চালাতে জানে কিংবা ট্রাক চালানো শেখার চেষ্টা করে আমরা কি তাকে কখনো খারাপ ভাবি? মোটেই না। বরং অ্যাপ্রোশিয়েট করি। এই বলে যে, কাজ শিখে রাখা ভালো। কেননা, শেখা জিনিস জীবনের বাঁকে বাঁকে কাজে লাগে।
এবার আসুন সংস্কৃতির ক্ষেত্রে কেউ যদি আধুনিক গান গায়, লোকগীতি গায়, নজরুল গীতি গায় কিংবা রবীন্দ্র সংগীত গায় অর্থাৎ সংস্কৃতির সব শাখায়ই যে অবদান রাখতে চায় তাকে আমরা কেন খারাপ বলবো? বাংলাদেশের আইনে সংস্কৃতি চর্চা নিষিদ্ধ নয়। নির্দিষ্ট কারো জন্যও সীমাবদ্ধ নয়!
রবীন্দ্রনাথ কি শুধু গান লিখেছেন? কিংবা শুধু উপন্যাস? নাকি সাহিত্যের সকল শাখাতেই বিচরণ করার চেষ্টা করেছেন? তাঁর ক্ষেত্রে অলরাউন্ডার হলে যদি দোষের কিছু না হয় তবে এ নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে।
এখন আসুন শুদ্ধাশুদ্ধির বিষয়ে। এই মুহূর্তে বাংলাদেশের সকল এমএ পাশ চাকরিজীবীদের প্রমিত ভাষা ব্যবহার করে একটি দরখাস্ত লিখতে বলুন, এটাও বাদ দিলাম প্রত্যেককেই বলুন অফিসে শুদ্ধ ভাষায় বা মান ভাষায় কথা বলতে-সম্ভব? মোটেই না। তাহলে ফলাফল কী দাঁড়ালো? সবোর্চ্চ ডিগ্রিই সব নয়। যারা শুদ্ধ করে কথা বলতে পারে না, তাদের নামে মামলা ঠুকে দিবেন?
এবার আসুন ধর্মীয় ক্ষেত্রে। এক লক্ষ খুব জানাশোনা লোককে কোরান তিলাওয়াত করতে দিন। সহিশুদ্ধ করে কয়জনে পারবে? ৫% বা ১০%। সর্বোচ্চ ২০%। বাকী যারা পারেনি, পারে না, তাদের নামে মামলা ঠুকে দিবেন?
এবার আসুন জাতীয় সংগীতে। দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই নানা ওকেশনে জাতীয় সংগীত গাওয়া হয়। সবাই কি ঠিকভাবে গাইতে পারে? প্রশিক্ষণ দেওয়ার পরও পারে? সব শিক্ষকও কী পারে? যারা পারে না, তাদের নামে কি রাষ্ট্রীয় মামলা হয়?কেই মামলা করে?
তাহলে অতি উৎসাহী হয়ে কে মামলা করে? কারা মামলা করে? বুঝতে হবে ঈর্ষাকাতর হয়েই এসব করে। উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবেই তারা করে। বাঙালিদের ন্যাচারাল ট্রেন্ট হলো কেউ উপরে উঠতে চাইলে তাকে নানাভাবে নিচের দিকে নামানোর চেষ্টা করা। কেউ উপরের দিকে তুলে দেবার চেষ্টা করবে না।
ভাইরালের যুগে এখন অধিক জনপ্রিয়রাই সবচেয়ে বেশি সমালোচনার শিকার হচেছন। পান থেকে চুন খসলেই ট্রলের শিকার হচ্ছেন, বোলিংয়ের শিকার হচ্ছেন?
এই ট্রল কারা করে? নিশ্চয়ই আপনার আমার মতো শিক্ষিত স্বজনরা! এই গড্ডলিকা প্রবাহে কে গা ভাসিয়ে দেয়? নিশ্চয়ই আপনার আমার মতো শিক্ষিত স্বজনরা!
ব্যক্তিভেদে রুচি ভ্যারি করে। সব উচ্চশিক্ষত লোকই রবীন্দ্রসংগীত পছন্দ করে না। কেউ নজরুল সংগীত, কেউ আধুনিক গান, কেউ লালগীতি, কেউ লোকগীতি, বাউল গান, ভাটিয়ালি, ভাওয়াই, পল্লগীতি… ইত্যাদি গান শোনে। কেউ দেশীয় সিনেমা পছন্দ করে আবার কেউ বিদেশী সিনেমা পছন্দ করে। কেউ ডিপ বিনোদন পছন্দ করে আবার কেউবা চটুল বিনোদন পছন্দ করে। পছন্দের রুচির জন্য ব্যক্তি একাও আবার দায়ী নয়। পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র দায়ী। সাংস্কৃতিক কোন সৃষ্টকর্ম আপনার পছন্দ না হলে এড়িয়ে চলুন। নিজেও চেষ্টা করবেন না, আবার অপর কেউ চেষ্টা করলেও বাধা দিবেন বা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবেন—এটা তো মোটেই শোভনীয় ব্যাপার নয়।
মনে করুন, নানা দিক থেকেই আপনি জনপ্রিয়। আপনার কোনো শত্রু নেই। আপনার এই আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা নিয়ে যেদিন আপনি নির্বাচনে নমিনেশন দাখিল করবেন দেখবেন কাকতালীয়ভাবে সেদিন থেকেই কোনো কারণ ছাড়াই আপনার জনপ্রিয়তা কমতে শুরু করেছে। একশ্রেণির মানুষ অযথাই আপনার আপনার বংশের চুলচেরা বিশ্লেষণ করে আপনাকে নাকানিচুবানি খাওয়ানোর চেষ্টা করবে। অযথাই হয়রানির চেষ্টা করবে। জনপ্রিয়দের যেমন শোভাকাঙ্ক্ষীর অভাব নেই, তেমনই শত্রুরও কমতি নেই।
মানুষ তার সহজাত প্রবণতা নিয়েই জন্ম নেয়, বেড়ে ওঠে। বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি সমালোচনার তিরে বিদ্ধ হয় শিক্ষক, ইমাম আর সংস্কৃতিজগতের কর্মীরা।
সৃষ্টির আদি থেকে যারাই কিছু করতে চেয়েছে, তারাই কোনো না কোনোভাবে বাধাগ্রস্ত হয়েছে। সত্য হলো, যারা বাধা দিয়েছে মহাকাল কখনোই তাদের মনে রাখে না। বরং যারা করার চেষ্টা করে, করে দেখায় তাদের কর্মকেই মনে রাখে। আর সে কর্মের মধ্যে দিয়ে সে কর্মের স্রষ্টাও বেঁচে থাকেন।
কেউ কিছু করতে চাইলে বাধা প্রদান না করে বরং তাকে সহযোগিতার মনমানসিকতা দেখানো উচিত। সমালোচনার নামে বিরোধিতার মনমানসিকতা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে?
বোধের পাঠশালা
২৩/০৭/২০২২
উপশহর, সিলেট
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে জুলাই, ২০২২ রাত ৯:৩২