ছোটোবেলার কথা। সন-তারিখ ঘটা করে বলা সম্ভব নয়। কেন সম্ভব নয়, সে বিতর্ক আরেক দিনের জন্য জমা রইল! তো একদিন বড়ো ভাইকে সাথে নিয়ে শহরে এলাম। উদ্দেশ্য টেপ কেনা। বড়ো ভাই আসতে চাননি। আমার পীড়াপীড়ির কারণেই তিনি আসতে বাধ্য হয়েছেন। গ্রামদেশে তখন টেপওয়ালাদের বেজায় ভাব! আজকাল লন্ডনে যেমন ব্যক্তির অর্থনৈতিক মূল্যায়ন করা হয় রেস্টুরেন্ট সংখ্যার পরিমাণ দিয়ে। গ্রামেও তখন ব্যক্তির মূল্যায়ন করা হতো টেপওয়ালাদের টেপের আকার, সৌন্দর্য ও দামের পরিমাণ দেখে। যার টেপ সবচেয়ে বড়ো এবং দামি তার চলাফেরাও ছিলো একটু ভিন্ন। যদিও আজকের যুগে নতুন জেনারেশনের কাছে 'টেপ' শব্দটাই একটি বিস্মিত শব্দ। অনেকটা ধান গাছে তক্তা হয় কিনা এরকমই ব্যাপার! কাজেই আজকের প্রযুক্তিকে আগামী দিনের আবর্জনা বললে মোটেও অত্যুক্তি হবে না!
যাইহোক, দোকানের সবচেয়ে বড়ো টেপের দিকেই আমার চোখ পড়ল। বড়ো ভাইকে বলতেই তিনি অজুহাতের ছলে বললেন—তুই, এত বড়োটা নাড়াচাড়া করবার পারবি না। ভাইঙ্গা ফালাইবি। তরে, ছোটোটাই কিন্না দেই।
ভাইয়ের কথা শুনে অনেকটা চুপসানো আঙুরের মতোই আমার মনের অবস্থা হলো। মানে ভীষণ মনখারাপ হয়ে গেলো। কেননা, টেপ চালানোর প্রতি আমার যতটা না আগ্রহ তার চেয়ে বেশি আগ্রহ ছিলো লোকদের দেখিয়ে ভাব নেওয়াতে! গ্রামীণভাষায় যেটাকে বলে—ফুটানি মারা! মেঘের আড়ালে সূর্য হারিয়ে যাওয়ার মতো আমার আনন্দও কোথায় যেনো হারিয়ে গেলো।
ভাইয়া আমার মনখারাপ বুঝতে পারলেন। তিনি টেপের দিকে একমুহূর্ত তাকিয়ে কী যেনো ভাবলেন। আঙুল গুনে গুণে কী যেনো হিসাবনিকাশও করলেন। আমি সেদিকে একবার তাকিয়ে পরক্ষণেই চোখ নামিয়ে নিই। শিশুরা কি আর অত কিছু বোঝে? শিশু মাত্রেই বড়োদের সীমাবদ্ধতার কথা শুনতে নারাজ, বড়োদের দুঃখ নিতে নারাজ। কাজেই আমার শিশুমনটাও তখন অভিমানের সমুদ্রে একাই অবগাহন করে চলছে। কোথাও যেনো ঠাঁয় হচ্ছে না!
ভাইয়ের চোখেমুখে সহসাই হাসির ঝলক দেখতে পেলাম। সে হাসির আভায় আমার শিশুমনটাও কেমন যেনো ছায়া খুঁজতে লাগলো। তিনি আমার পিঠ চাপরিয়ে বললেন—আরে বোকা! মোন খারাপের কী আছে! আমি তো এটটু মজা করলাম! সাওস কইরা কঅ—কোনটা চাস?
বিদ্যুৎ চমকানোর মতো মুহূর্তেই আমার চোখেমুখে হাসির ঝিলিক ফুটে উঠলো। আমি হাত দিয়ে দেখিয়ে দিলাম—ওই-ই-ই-টা। আমাকে খুশি করতে ভাইয়াকে সেদিন তার বুকপকেট, প্যান্টের পকেট এমনকি তার গোপন পকেটের টাকাও একেবারে খালি করতে হয়েছিলো। নিজের প্রয়োজনীয় মৌলিক জিনিসপত্র কেনাও তিনি বিসর্জন দিলেন।
বড়ো ভাইদের মধ্যে নাকি পিতার ছায়া এবং কর্তব্য উভয়ই মিলে। আহা! বড়ো ভাইয়েরা এতো ভালো হয় কেন! টেপ কিনতে পেরে সেকি আনন্দ! মনে হলো মাউন্ট এভারেস্টের চূড়া জয় করার চেয়েও যেনো বড়ো কিছু জয় করেছি! মুই কী হনু রে—সেদিন এমন একটা ভাব নিয়ে, নিজের জানের চেয়েও বেশি মায়া করে টেপটাকে বগলে ধরে, ছাগলের তিন নাম্বার বাচ্চার মতো তিড়িং বিড়িং করে লাফাতে লাফাতে বাড়ি ফিরলাম।
পরের দিন। বড়ো টেপ দেখার জন্য গ্রামের ছেলেবুড়ো অনেকেই ভিড় করতে লাগলেন। দিন বাড়ার সাথে সাথে মানুষজনও বাড়তে লাগলো। দেখতে দেখতেই ঘর ভরে গেলো। এরপর উঠোন। কেউ কেউ লম্বা আলাপ জুড়ে দিলেন। যাওয়ার নামটি পর্যন্ত করেন না! নতুন বউ দেখার জন্য গ্রামে যেমন ভিড় করে ঠিক তেমনই নতুন টেপ দেখার জন্যও সেদিন ছিলো মানুষের উপচেপড়া ভিড়!
আমি ছোটো ভাইয়ের সঙ্গে বল খেলছিলাম। সে বুদ্ধিপ্রতিবন্দী। বয়সে আমার থেকে পাঁচ বছরের ছোটো। বাড়ির সবাই তাকে সবুজ বলে ডাকে। কিন্তু আমি তাকে ডারমট বলে ডাকি। কোনো গল্পের বইয়ে পড়েছিলাম—'ডারমট’ হলো সৌভাগ্যবান পাখি। ইউরোপিয়ানরা নাকি এ পাখিকে সৌভাগ্যের প্রতীক হিসেবে দেখে। কী জানি! দেশে দেশে সংস্কৃতি ও সংস্কারে কতই না ভিন্নতা! যাইহোক, সেই সৌভাগ্যবান পাখির নাম অনুসারে আমি ব্যক্তিগতভাবেই তাকে ‘ডারমট’ বলে ডাকি। আদর-সোহাগ করেই তাকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হয়। সহজ-সরল মানুষদের রাগ উঠলে যেমন সহসা ভয়ংকর হয়ে ওঠে, ওর অবস্থাও অনেকটা সেরকম। রাগ উঠলে আর রক্ষে নেই!
সেদিন ছোটো এক শিশু বলের জন্য কান্না করছিলো। ডারমটের কাছে থাকা বলের দিকে সে বারবার তাকাচ্ছিল। তার অভিভাবককে সে বল দেখিয়ে জোরে জোরে কান্না করছিলো। মানে হলো—ওই বলটিই তার চাই! তার অভিভাবক আমার কাছে এলেন। ছেলেটিকে বল দিতে আমারও খুব মন চাচ্ছিল; কিন্তু কেন যেনো কিছুতেই সাহস করে উঠতে পারছিলাম না। পাছে ডারমট কী থেকে কী করে বসে!
বাবাও বিষয়টি বুঝতে পারলেন। তিনি শিশুটির কান্না থামানোর জন্য দ্রুত ডারমটের কাছে ছুটে এলেন। ভালোভাবে ডারমটের কাছে বল চাইলেন। নানাভাবে অনুনয়-বিনয়ও করতে লাগলেন। কিন্তু ডারমট কী বুঝে যেনো সেদিন একেবারেই বেঁকে বসলো। এদিকে শিশুর কান্নাও কোনোভাবে থামানো যাচ্ছিলো না। বাবা অনেক অনুনয়বিনয় করেও যখন ডারমটের কাছ থেকে বল নিতে পারলেন না, তখন তিনি রাগে ফেটে পড়লেন। জোরে জোরে উচ্চবাচ্য করতে লাগলেন। শেষতক বলটি কেড়ে নিলেন। সেইসাথে আমাকেও ইশারা করলেন যাতে আমি ডারমটকে নিয়ে কিছুসময় অন্যকোথাও থেকে ঘুরে আসি।
আমি নিতে চাইলেও ডারমট কিন্তু মোটেও আমার সাথে এলো না। এভাবে বল নেওয়াতে সে খুব অপমানবোধ করলো। ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বলেন, বড়োদের মতো শিশুদেরও নাকি ব্যক্তিত্ব থাকে। সুকান্ত ভট্টাচার্যের ক্ষেত্রেও এমনটা ঘটেছিল। বাল্যে তাকে নিমন্ত্রণ না দেওয়ায় সে বিয়েবাড়িতেই যায়নি!
যাইহোক, রাগে-ক্ষোভে ডারমটও সাপের মতো ফুঁসতে লাগলো। আমি কেন বাবাকে বলেকয়ে বল রাখলাম না; সেজন্য আমার ওপরই ছিলো তার বেশি রাগ! তার হাতের কাছেই ছিলো লাঠি। আমি কিছু বুঝে ওঠার আগেই আমার পিঠে প্রচণ্ড জোরে দুই ঘা বসিয়ে দিলো। তারপর ফুঁসতে ফুঁসতে পড়ার ঘরের দিকে গেলো।
আমি প্রচণ্ড ব্যথায় সেখানেই বসে পড়লাম। ঘাড় ঘুরিয়ে আশাপাশে তাকালাম কেউ দেখলো কিনা! মা’র খেলে যতটুকু না ইজ্জত যায়, তার চেয়ে বেশি যায় কেউ তা দেখলে! আমি কখনোই ডারমটের গায়ে হাত তুলিনি। সে আমাকে দিনে পাঁচবার মারলেও আমি একবারের জন্যও তার গায়ে হাত তুলতাম না। শুধু ডারমট নয়, কোনো শিশুকেই বুঝমান হওয়ার পর থেকে মেরেছি বলে মনে হয় না। ডারমটের ওপর কখনোই কোনো প্রতিশোধ নিতাম না। কেন নিতাম না, সে ব্যাখ্যা আরেক দিন হবে।
মিনিট দুয়েক পরেই খুব জোরে শব্দ হলো। মনে হলো কেউ কিছু একটা ভেঙ্গেছে। আমার হঠাৎ মনে হলো—ডারমট তো পড়ার ঘরে! আর ওই ঘরে যে নতুন টেপ! মুহূর্তেই পিঠের ব্যথা ভুলে গেলাম। দৌড়ে পড়ার ঘরে ঢুকলাম। কিন্তু ততক্ষণে সবই শেষ! নতুন টেপ আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে কাচ ভাঙার মতোই টুকরো টুকরো হয়ে গেছে! বই-খাতাগুলোও ছেঁড়া। এদিক-সেদিক ছড়ানো ছিটানো।
আমার সব সাধ-আল্লাদ মাটি হয়ে গেল। মাটি হয়ে গেলো গ্রামের মানুষদের প্রতীক্ষা! দুদিন পরেই পরীক্ষা। ছেঁড়া বইগুলোর জন্যও আমার কান্না পাচ্ছিলো। আমি কান্না সামলাতে পারলাম না। আমার কান্না দেখে ডারমটও কেমন যেনো নিশ্চুপ হয়ে গেলো। অপরাধীর মতো মাথা নিচু করে আমার কাছে এলো। সহসা সেও আমাকে জড়িয়ে ধরলো। তার মুখে কান্নার কোনো শব্দ নেই। কেঁদেছিলো কিনা তা বোঝা গেলো অনেক পরে। যখন আমার পেটের অংশের শার্টের জামা ভিজে গেলো!
আমার তখন সেই বিখ্যাত গল্পটি মনে পড়তে লাগলো—‘নিউটন অ্যান্ড হিজ ডগ।‘ যে গল্পটির সারমর্ম ছিলো এমন—বাইশ বছর গবেষণা করার পর মূলনোটগুলো তার কক্ষে রেখেছিলেন। একদা তার প্রিয় কুকুরের পায়ে ধাক্কা লেগে জ্বলন্ত মোমবাতি কাগজগুলোর ওপরে পড়ে। মুহূর্তেই আগুন ধরে সব পুড়ে ছাড়খার হয়ে যায়। চোখের সামনেই বাইশ বছরের সাধনাকৃত কর্মযজ্ঞের ধ্বংশ দেখে—তিনি কেবল একবার ভেজা চোখ মুছলেন। তারপর প্রিয় কুকুরের গালে চুমু খেয়ে বললেন—ইটস ওকে!
আমিও ডারমটের গালে চুমু খেলাম। মাথায় হাত বুলালাম। হয়ত সেও যা বোঝার তা বুঝে নিলো। থাক না, আরকি!
বোধের পাঠশালা
২২.০৩.২০১৭
শিবগঞ্জ, সিলেট
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে মে, ২০২২ সকাল ১১:১৮