মামার মাধ্যমেই তার সঙ্গে প্রথম পরিচয়। ডাক নাম জেনি। পুরো নাম জেনি অগাস্টা। বয়স উনিশ কী কুড়ি হবে। দেখতে ভারি সুন্দর। আহা! বঙ্গদেশে এমন সরস যুবতীর সঙ্গে আগে পরিচয় হলো না কেন? বাঙালি মেয়েদের মতোই তার চুলের গড়ন। হাসলে গালে টোল পড়ে। সে সৌন্দর্য বড়ই অদ্ভুত, বড়ই মনোহর। যেনো সে টোলপড়া গালের শৈল্পিক অংশজুড়ে খেলা করে পৃথিবীর সব সাজানো সুন্দর। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকি। গ্যাজ দাঁতওয়ালাদের হাসি যেমন অদ্ভুত সুন্দর তেমনই গালে টোলপড়া রমণীদের হাসিও। তার ভাঙা ভাঙা বাংলা কথা আমার বেশ লাগে। আমি মুগ্ধ হই,আপ্লুত হই। আমার কাছে মনে হলো সে যেনো এক জীবন্ত গোলাপ; যার জন্মই হয়েছে কেবল সুবাস ছড়ানোর জন্য।
কথা বলতে বলতেই সে মুচকি হাসে। তার সে হাসিজুড়ে ভালোলাগার পরাগরেণু ছড়িয়ে পড়ে। আমি সে দৃশ্যমান পরাগরেণুর সমুদ্রে হাবুডুবু খাই। বৈকালিক ফুরফুরে হাওয়ায় অনুভূতিগুলোকেও আজ বেশ সতেজ মনে হচ্ছে।
আমরা গ্রামের মেঠোপথ ধরে হাঁটছি। মেয়েটি মাঝেমাঝেই মান্দি ভাষায় কথা বলছে। যখন বুঝতে কষ্ট হয় তখন ফ্যালফ্যাল করে তার দিকে তাকিয়ে থাকি। সে বুঝতে পারে। মুচকি হেসে বাংলা অনুবাদ করে দেয়। বেশ ভালো লাগছে। মাঝে মাঝে রসিকতাও করছে। আমার মনে পড়ে গেল জহির রায়হানের একুশের গল্পে’র তপুর কথা! আমিও তপুর মতো করে কাব্যিকঢঙে বললাম—এই যে আঁকাবাঁকা মেঠোপথ, এ পথের যদি শেষ না হতো, অনন্তকাল ধরে যদি এভাবে পাশাপাশি হেঁটে যেতে পারতাম...। জেনি হাসে। সে হাসির সমুদ্রে একবার অবগান করলে আর ফিরতে ইচ্ছে করে না।
মেঠোপথ পাড়ি দিয়ে কখন যে আমরা ছোটো টিলার ওপর এসে পড়েছি তা টেরও পাইনি। এ যেনো আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্বের জীবন্ত উদাহরণ! টিলার চারপাশ জুড়ে আনারসের বাগান। কত কাঁচাপাকা আনারস! যতদূর দৃষ্টি যায় শুধু সবুজ আর সবুজ। সে সবুজের বুকে খেলা করছে কাঁচাপাকা আনারসের সমারোহ। জেনি আরও ওপরে উঠছে। আমাকে মুচকি হেসে বলছে—রি রি থিংরি থিংরি।
আমি কিছু না বুঝে বোকার মতো তাকিয়ে থাকি। সে মায়াময় টোলপড়া হাসি দিয়ে বলল—তাড়াতাড়ি এসো। মুহূর্তেই আমার হাঁটার স্পিড দ্বিগুণ বেড়ে যায়। চূড়াতে উঠতেই হঠাৎ কয়েকজন মুখোশপরা অস্ত্রধারী আমাদের ঘিরে ফেলে। আমি কিছু বুঝে উঠার আগেই কেউ একজন পেছন থেকে সজোরে মাথায় আঘাত করে। আমি মাটিতে লুটিয়ে পড়ি।
যখন জ্ঞান ফিরল তখন দেখি জেনির ক্ষতবিক্ষত দেহের ওপর দিয়ে সূর্য উঠছে।
২০.০৩.২০১৯
কালিগঞ্জ, জকিগঞ্জ, সিলেট
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই এপ্রিল, ২০২২ দুপুর ২:১৪