বাংলা একাডেমি হলো বাংলাদেশের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আইকন, সকল বাংলা ভাষাভাষীর আইকন; ঠিক যেভাবে সংবিধান রাষ্ট্রের তথা বাংলাদেশের সকল নাগরিকের জন্য আইকন, সম্মানের, গর্বের। সংবিধানের সকল নিয়ম যেমন মেনে নিতে হয় আবার মানিয়েও নিতে হয়; তেমনই বাংলা একাডেমির নিয়মকানুনও। সংবিধান যথাযথভাবে মেনে চলা রাষ্ট্রের সকল নাগরিকের যেমন দায়িত্ব ও কর্তব্য , তেমনই বাংলা একাডেমির নিয়মকানুন যথাযথভাবে মেনে চলাও সকল বাংলাদেশির দায়িত্ব ও কর্তব্য।
সংবিধানের নিয়ম কানুন যথাযথভাবে মেনে চলে এমন সুনাগরিকও যেমন এদেশে রয়েছে তেমনই সংবিধান যথাযথভাবে মেনে চলে না এমন কুনাগরিকেরও এদেশে অভাব নেই! কিন্তু সবারই কি শাস্তি হয়? হয় না। সুনাগরিকরাও কি সঠিক সময়ে রাষ্ট্র কর্তৃক পুরস্কৃত হয়? হয় না। আর যদিও বা হয় তা উদাহরণ হিসেবে টানার মতো নয়। আমাদের শিক্ষকদের কথাই ধরুন না—সারাবছরব্যাপী ক্লাসে কিংবা ক্লাসের বাইরে সৃজনশীল কাজের সঙ্গে জড়িত থাকলেন, খুব ভালো পারফরমেন্স করলেন; বছর শেষে কি প্রতিষ্ঠানপ্রধান কোনো পুরস্কার প্রদান করে? পুরস্কার বাদই দিলাম মোটের ওপর কোনো ধন্যবাদ দেয়?
যেকোনো প্রতিষ্ঠানের প্রশাসনের স্বরূপ বুঝলে রাষ্ট্রীয় স্বরূপ বুঝতেও সুবিধে হবে। কেননা, এসব ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রশাসন মিলেই রাষ্ট্রযন্ত্র! এককথায়, প্রশাসন রাষ্ট্রের বাইরের কিছু নয়।
বাংলা একাডেমির স্পষ্ট ৪০টি স্পষ্ট নির্দেশ রয়েছে; যা সকল মন্ত্রণালয় মানতে বাধ্য। কিন্তু সত্যিই কি মানছে? না মানছে না। না মানলে তো শাস্তির বিধান নেই। আর একারণেই মানছে না। মনে করুন, রাস্তায় আপনি হেলমেট ছাড়া মোটরবাইক চালাচ্ছেন। পুলিশ ধরতে পারলে নিশ্চিত আপনাকে শাস্তির আওতায় নিয়ে আসবে। জরিমানা করবে। এমনকি বাস্তবে করছেও। ঠিক এরকম যদি বাংলা একাডেমি নিয়ম প্রণয়নের পাশাপাশি শাস্তির বিধান রাখত, তবে কিন্তু অনেকেই সোজা হয়ে যেত। নিয়ম মানার প্রবণতা বেড়ে যেত। যদিও সব বাঙালিই সোজা হওয়ার নয়। যেহেতু প্রতিদিনই কোনো না কোনো স্থানে কোনো না কোনো মোটরসাইকেল আরোহী হেলমেট না থাকায় মামলার সম্মুখীন হচ্ছে। বাঙালি মানেই হলো আইন না মানার দলে!
কাজেই বাংলা একাডেমি ছাড়া অন্যকোনো প্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ডও উদাহরণ হিসেবে সামনে আনা যাবে না। যেহেতু সেসকল প্রতিষ্ঠান শুদ্ধ বানান প্রণয়ন করেনি বা নির্দেশনা দেওয়ার এখতিয়ারও রাখে না। রাষ্ট্র ভাষার আইকনও নয়। বাংলা একাডেমির সর্বশেষ সংস্করণ হলো জামিল চৌধুরী সম্পাদিত ‘বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধান’, যা বাংলা একাডেমি থেকে ২০১৬ সালে প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া ২০১৮ সালে এই বইটির পরিবর্তিত ও পরিমার্জিত সংস্করণ বের হয়েছে। এটিই বর্তমানে বাংলাদেশের, বাংলাভাষী বাংলাদেশিদের আইকন; যা বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা তথা মানভাষাকে প্রমোট করছে।
যুগের সঙ্গে অনেক কিছুই আপডেট হয়। যেমন আপডেট হয়েছে আমাদের বেতনভাতা (আগে যেমনটি ছিল এখন তেমনটি নেই, হয়ত ভবিষ্যতেও থাকবে না), যেমন আপডেট হয়েছে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির দাম, যেমন আপডেট হয়েছে নিত্যনতুন প্রযুক্তি।
আকাশ সংস্কৃতির কারণে বাঙালি সংস্কৃতিতেও অনেক কিছুর মিথস্ক্রিয়া ঘটছে। মানুষ কখনোই পুরোনোতে আবদ্ধ থাকেনি। নতুনের প্রতি এক দুর্বার নেশা তাকে মোহগ্রস্ত করে রাখে। সুতরাং আপডেট হওয়াই হলো সময়ের ধর্ম। আর বাংলা একাডেমি তো তার থেকে ব্যতিক্রম নয়। যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলাই সার্থকতা। আর যে তা পারে না বুঝতে হবে এটি কেবল তারই দীনতা!
আর বাংলা একাডেমি সে বার্তাটিই আমাদের দিয়ে যাচ্ছে। বাংলা ভাষার হাজার হাজার শব্দকে নির্দিষ্ট কিছু নিয়মের মধ্যে ফেলে সহজ থেকে আরও সহজতরো করার চেষ্টা করছে। প্রতিনিয়ত নতুন নতুন শব্দ জন্ম নিচ্ছে। বিদেশি ভাষা থেকে বাংলা ভাষায় সেসব শব্দগুলো এমনভাবে লেপটে যাচ্ছে যে, সেসব শব্দ বাংলা ভাষায় অন্তর্ভুক্ত না করে উপায় থাকে না। পরবর্তীতে এসব শব্দের বিকল্প বাংলা শব্দ খুজেঁ বের করাও আমাদের কাছে দুরূহ বলে মনে হয়। যেমন : মোবাইল, চেয়ার, টেবিল, ভাইরাল, করোনা ভাইরাস ইত্যাদি। এমনই অসংখ্য বিদেশি ভাষার শব্দগুলোকেও একই নিয়মের ছকে ফেলে সহজতরো করার চেষ্টা করেছে বাংলা একাডেমি। যাতে করে আমাদের বানান ভুল কম হয়। যাতে করে একই সূত্রে ফেলে অসংখ্য শব্দের বানান মনে রাখা যায়! আর এতসব জেনেও যারা বাংলা একাডেমিকে দোষারূপ করে বুঝতে হবে তাদের বোধেই সমস্যা, অথবা তারা জেগে ঘুমাচ্ছে!
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে দেশের অনেক প্রথিতযশা বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। সেসব বিশ্ববিদ্যালয়ের নোটিশবোর্ড দেখলেও আপনি চমকে যাবেন; চমকে যাবেন বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের নোটিশবোর্ড দেখে। সেখানে আমাদের বাংলা ভাষা ভালো নেই। কেবল রাষ্ট্রীয় উদাসীনতার কারণেই দিনকে দিন এমন ভ্রান্তির সংখ্যা বেড়েই চলছে। তবু ভাষার মান রক্ষার্থে কেউ যে কাজ করছে না, এমনটি নয়। সবাই তো অসৎ নয়, সবাই তো ঘুসখোর নয়, সবাই তো দুর্নীতিবাজ নয়; কেউ না কেউ তো সৎ, কেউ না কেউ তো দেশপ্রেমিক, কেউ না কেউ তো ভাষাপ্রেমিক। সেই মধ্যযুগে কবি আব্দুল হাকিম বলেছিলেন—'যেসব বঙ্গেত জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী। সেসব কাহার জন্ম নির্ণয় না জানি।।‘
এদেশের অধিকাংশ লোকই ভাষা সম্পর্কে উদাসীন; যেভাবে আইনের প্রতি উদাসীন! যদি বাংলা ভাষার প্রতি ন্যূনতম দরদ থাকে তবে আমাদের সকলেরই উচিত—ধর্তব্য নয় বা রাষ্ট্রীয় আইকন নয় এরকম কোনো প্রতিষ্ঠানের রেফারেন্স ধ্রুব হিসেবে মানা যাবে না। কেননা, তাতে ভুলের সংখ্যা বাড়বে বই কমবে না।
বিষয়টি অনেকটা এরকমই যে, অভিভাবক হিসেবে নিজের পিতামাতার তুলনায় অযোগ্য কাউকে আপনি আপনার জীবনের অভিভাবক বা নীতিনির্ধারক মনে করলেন। আর এটা শুধু বোকামিই হবে না চরম অন্যায়ও হবে।
কেবল এবং কেবল বাংলা একাডেমির সকল নিয়মকানুনগুলোকে নিজে অনুসরণ করা এবং আমাদের প্রজন্মকেও সে নিয়মকানুনগুলোকে মেনে চলতে উৎসাহপ্রধান করাই হলো সময়ের সবচেয়ে যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত। যেভাবে আমরা আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ঠিক সেভাবেই আমাদের বাংলা একাডেমির আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া উচিত।
জয় পরাজয় নয়। জানতে হলে পড়তে হবে। আবার পড়তে গেলেও জানতে হবে। আর শুধু জানলেই হবে না, মানার প্রবণতাও আমাদের মধ্যে থাকতে হবে।
বোধের পাঠশালা
২৫/০৩/২০২২ খ্রিষ্টাব্দ
উপশহর, সিলে
ছবিঋণ : ইন্টারনেট