গতকালকে ৪ নাম্বার বাসে চড়ে লালখান বাজার থেকে ফৌজদারহাট যাচ্ছি। বাইরে ঝির ঝিরে বৃষ্টি, মেঘলা আকাশ। বাস বা রাস্তা কোথাও সেরকম ভীড় নেই। জানালার কাঁচ সরিয়ে বাতাসে সবুজ গাছের দুলুনি দেখতে দেখতে পুরো যাত্রাটা বেশ উপভোগ করছি। সিটি গেট পার হবার পর বাসে এক ক্যানভাসার উঠল। তার আইটেম হল আংটি। হাল্কা সোনালী রঙ ইমিটেশনের এই আংটি পরলে স্বপ্নদোষ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়, যৌন ক্ষমতা বাড়ে! চোখের পলকেই আংটি পনের বিশ টা বিক্রি হয়ে গেল। প্রতিটা আংটির দাম তিরিশ টাকা। আমার সামনের সীটে বসা বাইশ তেইশ বছরের এক যুবক( দেখে বোঝা যায় শিক্ষিত) যার অনামিকায় অলরেডী একটা আংটি পরা আছে সে ত্রিশ টাকা দিয়ে আরেকটা কিনল! আমি রসিকতা করে জিজ্ঞেস করলাম- ‘কি ভাই, একটার পাওয়ারে কুলাইতেছেনা?’ যুবক আমার রসিকতা বুঝতে পারল বলে মনে হলনা। বিড় বিড় করে আংটি কিনার স্বপক্ষের যুক্তি বলে গেল। তার কথা কিছুটা অস্পষ্ট বোধ হওয়ায় আমি আর ঘাটালাম না। বাস চলতে লাগল।
আমার মনে পড়ল বার তের বছর আগের কথা। নারায়ণগঞ্জে একটা ছেলের সাথে বন্ধুত্ত্ব হল। ছেলে হাত দেখে। হাত দেখে গ্রহ রত্ন বিচার করে ভবিষ্যতের বিপদ আপদ ঠেকানোর জন্য এবং উন্নতির জন্য আংটি দেয়। বন্ধু একদিন আমার হাত দেখল। হাত দেখে অনাগত দিনের বন্ধু বিচ্ছেদ, ভবিষ্যত দাম্পত্য জীবন, ক্যারিয়ার, গুপ্ত অসুখ বিসুখ ইত্যাদি নিয়ে মন্তব্য করল। তারপর গোমেদ অথবা আকীক অথবা অন্য কিছু একটা পাথরের আংটি সাজেস্ট করল। আমি অনেক্ষণ চিন্তা করলাম। তারপর বন্ধুকে বললাম- বন্ধু আমার জীবনের যে বিষয় গুলো নিয়ে ভবিষ্যৎ বানী করলা সেগুলোর কোনটাই ডাইরেক্ট ভবিষ্যৎবাণী না। যেমন ধর- তুমি ভবিষ্যৎবাণী করছ আজ থেকে দুবছর পর আমার বন্ধু বিচ্ছেদ হবে। কোন বন্ধুর সাথে বিচ্ছেদ নির্দিষ্ট করে উল্লেখ কর নাই। যদি স্পষ্ট করে বলতা অমুক বন্ধুর সাথে বিচ্ছেদ হবে তাহলে পাত্থর নিতাম। দুবছর পরে তোমার ভবিষ্যতবাণী সত্য হলে পাত্থরের দাম দিতাম আর মিথ্যা হলে তোমার পাত্থর তোমারে খাওয়াতাম। দুবছরে স্বাভাবিক ভাবেই নতুন কারো সাথে বন্ধুত্ত্ব বাড়বে, পাশাপাশি পুরানো কারো সাথে বন্ধুত্ত্ব কমবে। বন্ধুত্ত্ব সব সময় গতিশীল জিনিষ। হয় বাড়ে নয় কমে। যারা বন্ধুত্ত্ব কে ফিক্সড ডেপোজিট মনে করে তারা খাঁটি বেকুব। এটা দার্শনিক তত্ত্ব। এখানে পাত্থর গিরি’র কিছু নাই।
এরপরে আস দাম্পত্যজীবন। তুমি বলেছ কিছুদিন খুব সুখে কাটবে। তারপর জীবন সংগ্রাম। আবার সুখের জীবন! এখানেও পাত্থরগিরি’র কিছু নাই বন্ধু! দাম্পত্য জীবনের প্রথম কিছুদিন টোনাটুনি। তারপর ট্যাঁ ট্যাঁ যখন কোলে আসবে তখন টোনাটুনির আসল জীবন যুদ্ধ শুরু। ট্যাঁ ট্যাঁ বড় হবে, একটু টাকা পয়সা হবে, মোটামুটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া। বুড়াকালে একটু আয়েশ হয়তবা। এগুলো চারপাশের যাপিত জীবনের গড় একটা চিত্র। এই জীবন চিত্র তোমার দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের মাধ্যমে পরিবর্তন হতে পারে। পাত্থরের মাধ্যমে নয়।
ক্যারিয়ার নিয়ে বলেছ- আমি যথেষ্ট মেধাবী। জীবনে বেশি পরিশ্রম না করেও সাফল্যের মুখ দেখব! তোমার এই ভবিষ্যৎবাণী সত্য হয়েছে। এই কঠিন দূর্মূল্যের বাজারে বিবি বাচ্চা নিয়ে দুটা ডালভাত খাই। এটা বিরাট সফলতা। কিন্তু আমি নিশ্চিত ভাবেই বিশ্বাস করিনা, তোমার পাত্থর নিলে এতদিনে আমার ঢাকায় দুটা আর চট্টগ্রামে দুটা ফ্লাট থাকত। আমি যদি খুবই ক্যারিয়ার সচেতন হতাম, অথবা খুবই ধান্ধানুভুতিসম্পন্ন মানুষ হতাম, অথবা প্রচন্ড পরিশ্রমী হতাম অথবা আমার পেটে বোমা মারলেও যদি এক লাইন কবিতা লেখানো না যেত, তাহলেই আমি এধরনের বড়লোকী অবস্থানে যেতে পারতাম ।
গুপ্ত অসুখ বিসুখ আছে কিনা জানিনা। সুপ্ত আগ্নেয় গিরি থাকলেও তোমার পাত্থর সেটাকে ঠেকা দিয়ে রাখতে পারবেনা। বৈজ্ঞানিক চিকিৎসা শাস্ত্র পারলে পারবে। গাঁজাখুরি কোন অপবিজ্ঞানের সাথে মানুষের রোগমুক্তির কোন সম্পর্ক নাই।
তো বন্ধু সেদিন নিরস্ত হয়েছিল। বন্ধুর সাথে দীর্ঘদিন দেখা নাই। হয়ত কোনদিন দেখা হবে। ভাল থেক বন্ধু।
বার তের বছর দীর্ঘ সময়। যা বুঝি চারপার্শ্বে এখনো বেশির ভাগ মানুষ ই বুজুরুকিতে বিশ্বাস করে। বিশ্বাস করে হাতে নির্দিষ্ট আংটি পরলে স্বপ্নদোষ সেরে যাবে। আজকে সদ্য এসএসসি পাশ এক তরুন অঙ্কে এ প্লাস না পাবার জন্য তার হতাশা জানাচ্ছিল। আমি তরুন কে বললাম- দেখ অঙ্কে বা বিজ্ঞানে কাউকে এ প্লাস না পেতে দেখলে আমি হতাশ হইনা। কিন্তু সত্যি হতাশ হই যখন দেখি বায়োলজীতে এ প্লাস পাওয়া কোন ছেলে ‘আংটি পরলে স্বপ্নদোষ কাটা যায়’ এই তত্ত্বে বিশ্বাস করে।
তরুণ প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাল। আমি ব্যাখ্যা করলাম-
দেখ, বায়োলজী যে পড়েছে তার জানা উচিৎ যে স্বপ্নদোষ কথাটাই ভুল। এতে দোষের কিছু নাই! বংশরক্ষার প্রয়োজনে ছেলেদের শুক্রাশয়ে সঞ্চারিত শুক্রের উদ্বৃত্ত টুকু ঘুমের মধ্যে মুত্রনালী দিয়ে নিঃসৃত হওয়া খুবই সুস্থ এবং স্বাভাবিক একটা ব্যাপার যেরকম সুস্থ এবং স্বাভাবিক ব্যাপার হল মেয়েদের মাসিক ঋতুচক্র। যে ছেলে এই সামান্য জিনিষ টা উপলব্ধি করতে পারেনা অথচ বায়োলজীতে এ প্লাস পায় তাকে নিয়ে আমার কোন উল্লাস নাই। তাকে নিয়ে ‘তার কোচিং সেন্টারের ষাঁড়’ এবং ‘ তার গরু গার্জিয়ান’ রা উল্লাস করুক!
শিক্ষার কাজ শুধু ভবিষ্যতের আলু নিশ্চিত করা নয়। মগজে কিছু আলো ছড়ানোও শিক্ষার গুরুত্ত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। আমাদের জং ধরা মগজে এসব কি আদৌ কখনো ঢুকবে?