ঢাকায় ইদানিং মাঝে মধ্যেই দোতলা বাসে চলাফেরা করি। গাঢ় লাল রঙের অশোক লেল্যান্ড। অধিকাংশ বাসের দোতলায় উঠলেই বাসের দেয়ালের কয়েক জায়গায় মার্কার দিয়ে একটা লেখা দেখতে পাই। লেখাটা এরকম- প্রথমে কাল কালির মার্কার দিয়ে কেউ লিখেছে ‘রাজাকারের ফাঁসি চাই’। তারপর কেউ একজন ‘চাই’ টা কেটে দিয়ে লিখেছে ‘চাই না’। এতে করে পাবলিক বাসের দেয়ালে যে পাবলিক মত টি প্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়েছে সেটা হল- ‘রাজাকারের ফাঁসি চাইনা’।
দোতলা বাসে যাওয়া আসার সময় খেয়াল করেছি (উত্তরা-মোহাম্মদপুর রুট) বাসে অনেক তরুন তরুনী যাতায়াত করে যাদের বয়স বিশের কম। বাসের দেয়ালের লেখাটা দেখে আমার মনে একটা আশা, একটা শঙ্কা এবং একটা হতাশা জেগে উঠেছে। আশাটা হল- বাসের দেয়ালে ‘রাজাকারের ফাঁসি চাই’ কথাটা এই তরুন প্রজন্মের কেউ লিখে দিয়েছে। শঙ্কাটা হল- তরুন প্রজন্মের কেউ ই ‘চাই’ কথাটাকে কেটে ‘চাইনা’ করে দিয়েছে। আর হতাশাটা হল- পাবলিক বাসের দেয়ালে শেষ পর্যন্ত ‘রাজাকারের ফাঁসি চাইনা’ কথাটার ই জয় হয়েছে।
বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পুর্ববর্তী অবস্থাটা ছিল অনেকটা এরকম- পশ্চিম পাকিস্তানী ‘উন্নত মুসলমান’ দের কাছে পুর্ব পাকিস্তান ছিল একটি দুধেল গাভীর মত এবং এই পুর্ব পাকিস্তানের ‘ মালাউন হিন্দু এবং তাদের সঙ্গদোষে দুষিত দুর্বল ঈমানের মুসলমান ছোটা ভাই’ রা ছিল দুর্বল বুকের হাড় বেরোনো বাছুরের মত। বাছুর কে উষ্ঠা মেরে সরিয়ে গাভির প্রোটিন সমৃদ্ধ দুধ নিয়মিত দোহন করাটা তারা তাদের অধিকার বলেই মনে করত। তাদের আশা ছিল মায়ের দুধের বদলে উচ্ছিস্ট ঘাস খেয়ে বেড়ে উঠা বাছুর টি বড় হয়ে দুইটা কাজ করবে। এক- উচ্ছিষ্ট ঘাস খেতে দেবার জন্য পাকি প্রভুদের দরবারে অসীম শোকরিয়া আদায় করবে। দুই- আরামে দুধ খেতে থাকা প্রভুর পায়ের কাছে বসে তার স্ফিত উদরের দিকে লক্ষ্য রাখবে এবং উদরের স্ফিতি অনুযায়ী মাঝে মাঝে প্রভুর পায়জামার গিট্টা আলগা করে দেবে যাতে দুধ খেতে সুবিধা হয়। দুই একটা ‘নিমকহারাম বাঈমান বাছুর’ মাঝে মধ্যে বেয়াদপি করলে তাদের ধর্মের নামে জবাই করে দিলেই ত ঝামেলা শেষ!
এই অবস্থায় গাভি আচমকা উলান সরিয়ে নিয়ে হা করে থাকা দুধের সর ভাসা মুখের ভেতর পেছনের এক পা তুলে প্রস্রাব করে দিলে যে অবস্থা হয় ১৯৭১ সালের ২৬ শে মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষনা দেবার পর পাকি দের অবস্থা হয়েছিল সেরকম। একটা মিসকিন আল গরিব পরাধীন জাতির এরকম ঔদ্ধত্ত্ব তাদের আঙ্গুর আপেল এবং দুধ খাওয়া চামড়ার উপর গরম পানির ফোস্কা ফেলে দিয়েছিল এবং তারা ‘পুর্ব পাকিস্তানের এই কৃতঘ্ন বাঈমান জাতি’র উপর অসম্ভব রকম চটে গিয়েছিল এবং এই বাঈমান জাতিকে উপযুক্ত শিক্ষা দেবার ব্যাপারে তারা দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছিল।
‘মুত্র নহর’ সরিয়ে নিজেদের দিকে ‘দুধের নহর’ আবার প্রবাহিত করতে চাইলে কি করতে হবে সেই বিষয়ে এদের পরিষ্কার ধারনা ছিল। মুক্তিযুদ্ধ কে একটা হিন্দুদের চক্রান্ত বানিয়ে আম মুসলমানের মধ্যে উগ্র ধর্মবোধ জাগিয়ে তুলতে হবে। ঠিকমত জাগিয়ে তুলতে পারলে তারা নিজেরাই হিন্দুদের লাথি মেরে ইন্ডিয়া পাঠিয়ে দেবে। প্রভুদের মুত খাওয়া মুখের দুর্গন্ধ নিজেরা চেটে পরিষ্কার করে সেখানে আবার বসিয়ে দেবে দুধের নহর! স্বাধিনতার পঁয়তাল্লিশ বছর পার হবার পর স্বাধীনতার সুফল ভোগ করতে করতে মস্তিষ্ক ভোঁতা এবং গায়ের চামড়া মোটা করে প্রায় আপাদমস্তক সাম্প্রদায়িক জাতিতে পরিনত হওয়া জাতিটা তখন সরাসরি ভুক্তভোগী ছিল বলেই হয়ত পাকিদের এসব ধর্মীয় বুজুরুকি বুঝতে পেরেছিল এবং তারা নিশ্চিত ছিল জাতি হিসেবে স্ত্রী পুত্র কন্যা নিয়ে খেয়ে পরে সন্মানের সাথে বাঁচতে চাইলে অসাম্প্রদায়িক চেতনার উপর প্রতিষ্ঠিত মুক্তিযুদ্ধের কোন বিকল্প নাই। বর্বর পাকি রাও বুঝতে পেরেছিল ব্যাপক গনহত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট, জ্বালাও পোড়াও করে এদের কোমর ভেঙ্গে না দিলে গাভির দুধ আরামে জ্বাল দিয়ে খাবার আর কোনও উপায় থাকবেনা! ঐতিহাসিক সত্য হল রাজাকার নামক বরাহ শাবক দের সহায়তায় এই ভু খন্ডে ব্যাপক গনহত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট, জ্বালাও পোড়াও করেও পাকিরা মুক্তিযুদ্ধে আমাদের অনিবার্য বিজয় কে রোধ করতে পারেনি। কারন সেই সময় আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা ছিল নির্ভিক এবং নিঃসংশয় চিত্ত। তারা এদেশ কে হিন্দুর দেশ ভাবেনি, মুসলমানের দেশ ভাবেনি। তারা এমন একটা দেশের ছবি তাদের মানসপটে ফুটিয়ে তুলতে পেরেছিল যেটা একটা অসাম্প্রদায়িক মানুষের দেশ। ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে এটা সব মানুষের জন্য সমান সম্ভাবনার দেশ। এই ‘অসাধারন মানবিক সবার জন্য সমান সম্ভাবনাময়’ দেশ প্রতিষ্ঠার স্বপ্নের কাছে তুচ্ছ হয়ে গিয়েছিল তাদের নিজেদের প্রান এবং সেই প্রানের বিনিময়ে আমরা পেয়েছিলাম স্বাধীন দেশ।
তারপর দীর্ঘ পয়ঁতাল্লিশ বছর স্বাধীনতার তেল চর্বিতে আমরা গায়ে গতরে বেড়ে উঠেছি। আমাদের তরুন প্রজন্মকে আমরা হয় মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস কে ‘পাস্ট ইজ পাস্ট’ বলে ‘সীসাবারের সীসার ধোঁয়া’র সাথে উড়িয়ে দিতে শিখিয়েছি অথবা ‘গরিব আত্নীয় স্বজন কে একটু দয়া করে মহান হবার মত’ ‘মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস কে একটু বুকে ধারন করে ক্রিকেট খেলার মাঠে জাতীয় পতাকা মাথায় বাহুতে বেঁধে দেশ দেশ বলে একটু কান্নাকাটি’ করে মহান হয়ে পরদিন ‘এই দেশে থেকে কি হবে’ চেতনায় অস্থির হয়ে চৌদ্দগুষ্টি সহ কানাডা ইমিগ্রেন্ট হবার স্বপ্নে বিভোর হতে শিখিয়েছি। মুক্তিযুদ্ধ যে আমাদের শিরায় প্রবাহিত রক্তের মতই একটা বাস্তবতা এই মেসেজ আমরা দিতে পারি নাই। শিরায় রক্তের বদলে নষ্ট দুষিত পুঁজ প্রবাহিত হলে শরীরের যে অবস্থা হতে পারে প্রজন্মের মাথায় মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারনা প্রবাহিত হলে জাতির ও যে সে অবস্থা হতে পারে সেটা আমরা এখনো টের পাই নাই।
টের পাই নাই বলেই স্বাধীনতার পঁয়তাল্লিশ বছর পর ‘রাজাকারের ফাঁসি চাইনা’ ডায়লগ বুকে নিয়ে অলস গতির লাল রঙের দোতলা বাসগুলো প্রতিদিন রাজধানীর বুক এফোঁড় ওফোঁড় করে দেয়!